আর ‘বুরবক’ বনতে চান না জাহাঙ্গীর
-
পীযুষ ব্যানার্জি
- Feb 24, 2021 09:46 [IST]
- Last Update: Feb 24, 2021 09:46 [IST]
সিঙ্গুর, ২৩ ফেব্রুয়ারি— গ্রামের ঢালাই রাস্তার সঙ্গেই মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে ভাই-ভাই কোম্পানির সিমেন্ট। এই কোম্পানির সিমেন্ট দিয়েই নাকি হয়েছে গ্রামের ঢালাই রাস্তা। আর তাতেই আস্থা রেখেছে তৃণমূলের পঞ্চায়েত। এমন সিমেন্ট কোম্পানির নাম শুনে হোঁচটই খেতে হলো। ‘পিসি-ভাইপো’র স্পনসরশিপে ভাই-ভাই কোম্পানির সিমেন্টে মাত সরকারের পথশ্রী প্রকল্প।
দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরে মোটরগাড়ির কারখানার প্রোজেক্ট এরিয়া শেষ হওয়ার পরপরই গাড়ি নামলো বাঁদিকে। পিচ রাস্তা ধরে জয়মোল্লা গ্রাম ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে মসজিদের ডান হাতি রাস্তা পার করে গ্রামের ঢালাই পথ। ঢালাই পথের ধারেই বাঁশের মাচার ওপর প্লাস্টিকের ছাউনি করে বসে আছে গ্রামের একদল যুবক।
দেখলেই বোঝা যাচ্ছে সিমেন্ট দিয়ে সদ্য হয়েছে রাস্তা ঢালাইয়ের কাজ। রাস্তার কথা উঠতেই এক যুবক জানালেন, ‘‘এমন রাস্তা করেছে তিনদিনের মধ্যে হার্ট লিক হয়ে গেছে রাস্তার। ছয় মাসও টেকেনি রাস্তা।’’
ছয় মাসে দু’বার ঢালাই হয়েছে রাস্তার। বাঁশের মাচার পাশে টিউবওয়েলে স্নান করছিলেন এক বৃদ্ধ। স্নানের মধ্যেই তাকিয়ে বললেন, ‘‘যে সে সিমেন্ট দিয়ে কী আর রাস্তা হয়েছে। ভাই-ভাই কোম্পানির সিমেন্ট আছে রাস্তায়।’’ এবারই থমকাতে হলো। ভাই-ভাই কোম্পানির সিমেন্ট!
এবার মুখ খুললেন বৃদ্ধ। ততক্ষণে স্নান শেষ। ‘‘ধুর, ধুর ঢালাইয়ের সময় দেখলাম তো সিমেন্টের কোনও নামই ছিল না। তা নাম যখন নেই, আমরা তাই নাম দিয়েছি ভাই-ভাই কোম্পানি।’’
মোটে এক কিমি রাস্তা। পূর্বপাড়া থেকে শুরু করে পশ্চিমপাড়ায় ইতি। তাতেই দুবার ঢালাই হয়েছে। ভাই-ভাই সিমেন্টের জোর এমনই।
ভিত্তিহীন সিমেন্ট কোম্পানির নাম দিয়ে এখন দুর্নীতিকে নিয়ে রসিকতা করছে গ্রামের মানুষ। ভাই-ভাই রহস্য উন্মোচন হতে ভাবছেন কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছে তৃণমূলীরা। তার জো নেই। ঢালাই রাস্তার পাশেই একটি পুকুর দেখালেন গ্রামের মানুষ।
এটা পীরপুকুর। কতবার শুকিয়েছে জানেন এই পুকুর? চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, ‘‘তিনবার শুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাটি কাটা হবে বলে। তিনবারই মাটি কাটা হয়নি। কিন্তু ১০০দিনের কাজ দেখিয়ে লুটে নেওয়া হয়েছে টাকা,’’ বলছিলেন গ্রামের যুবক।
‘ভাই-ভাই সিমেন্ট’এর ঢালাই রাস্তার রহস্য থেকে তিনবার শুকিয়ে ফেলা পুকুরের ঘটনা এল স্রেফ একটি বুথ থেকেই। সিঙ্গুর বিধানসভার বেড়াবেড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩নং বুথ থেকে। মাঝেরপাড়া, পূর্বপাড়া আর পশ্চিমপাড়া— সংখ্যালঘু এলাকার এক বুথেই ভোটার সাড়ে ৮০০। কিন্তু লুটে নজির গড়েছে তৃণমূল।
‘‘আরে ও তো হাঁ করে আছে বোয়াল মাছের মতো। যা আসবে তাই গিলে নেবে।’’ বেড়াবেড়ির প্রধানের বিরুদ্ধে শ্লেষ উঠে এল জটলা থেকে। বাড়িটা দেখেছেন প্রধানের। গিয়ে দেখে আসুন গিয়ে। কোটি টাকা খরচের বাড়ি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে ১৮লাখ টাকা খরচ করে। ভিড় জানাচ্ছে ‘সততার প্রতীক’র বেড়াবেড়ি সংস্করণের নমুনা। থামে না মানুষের ক্ষোভ। ‘‘আলিবাবা চাল্লিশ চোরের কথা জানেন তো। প্রধানের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘খুল যা সিম, সিম’ বলবেন, দেখবেন দরজা খুললে ঘরের ভিতরে কত ধন সম্পদ আছে।’’ বলছেন গ্রামের মানুষ।
মোটরগাড়ির কারখানার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে বহু আগেই। সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে সিঙ্গুর। কাজের জন্য মানুষ ছুটছে ভিনরাজ্যে। চককালিকাবুড়ির সংখ্যালঘু মহল্লার এমন কোনও পরিবার নেই যে ঘর থেকে যুবকরা বাড়ির বাইরে।
কোথায় যাচ্ছে ছেলেরা? উত্তর আসে উত্তরাখণ্ডের উধম সিং নগর। সেও এক কাহিনি। রুদ্রপুরের পন্থনগরে কাজের জন্য লকডাউনের আগে পর্যন্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর মল্লিক। কাজ করবেন কী? পন্থনগরের বাসিন্দাদের কাছ থেকে তো কম কথা শুনতে হয়েছে সিঙ্গুরের পরিযায়ী শ্রমিককে! সেই দুঃখের কথা বলছিলেন জাহাঙ্গীর মল্লিক। ‘‘ওখানে যেতেই আমাকে বলল বাঙালিরা তো মাছ-ভাত খায়। মাথায় খুব বুদ্ধি আছে শুনেছি। তা নিজেদের এলাকা থেকে কারখানা তাড়িয়ে আমাদের রাজ্যে কাজ করতে এসেছো। এমন বুরবক কী করে হলে তোমরা?’’ এমন অভিজ্ঞার কথা বলছিলেন জাহাঙ্গীর মল্লিক।
কাজ হাহাকারে বিদীর্ণ গোটা এলাকা। মানুষ চাইছে কাজ। মাচার আড্ডাতেই এসে বসেন এক মাঝবয়সি। সাইকেল করে বাড়ি ফেরার সময় এলাকাতেই মোটরবাইকের ধাক্কায় দুর্ঘটনার মুখে পড়েন। গুরুতর চোট পান হাতে। চিকিৎসা খরচের জন্য বাইক চালকের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায়ে এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। কী অভিজ্ঞতা? ‘‘১০হাজার টাকা জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু শর্ত ছিল ৫হাজার টাকা সদস্য নেবে। টাকা হাতে এল না, ভাগ চেয়ে বসল। ভাবতে পারেন?’’ বলছিলেন প্রৌঢ় মানুষটি।
কারখানা গড়ার শুরু থেকে বিরোধিতা করে এসেছেন সিঙ্গুরের যেসব মানুষ তাঁরা এখন ভাবছেন। বামপন্থীদের কথা শুনছেন। বাজেমেলিয়ার মালিকপাড়ায় খেতমজুর ইউনিয়নের সদস্য করার জন্য গিয়েছিলেন সংগঠনের নেতা কাশীনাথ খামরুই। তিন ঘণ্টা ছিলেন মালিকপাড়ায়। গরিবপাড়ার বাড়ি, বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করছিলেন সংগঠনের সদস্য। তাঁরই অভিজ্ঞতা, ‘‘এক বাড়িতে গেছি, মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, কী হবে এসব করে? আমিও ছিলাম সেদিন মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বিডিও অফিসে। পুলিশের মারও খেয়েছি। এতকিছুর পর সরকার হলো। আমার বাড়িতে যোগ্য ছেলে বসে আছে। কাজ নেই। ছেলের কাজের জন্য সবার কাছে গেছি। কিছু হয়নি।’’ বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন মহিলা। সদস্য করার ফাঁকে খেতমজুরের নেতা বলেছিলেন, ‘‘মা, একটা কথা বলি, ছেলেদের কাজের জন্যই তো আমরা কারখানাটা চেয়েছিলাম। খুব ভুল করেছিলাম কি?’’ মহিলা বলেছেন, ‘‘এখন বুঝছি আমরাই ভুল করেছি। বাড়িতে এখন আলোচনা চলছে। যে জায়গায় ছিলাম সেখানেই আমাদের ফিরতে হবে।’’
জয়মোল্লা আর চককালিকাবুড়ি থেকে এবার তাই একটা বাস আর একটা ট্রেকার আসবে ব্রিগেডে। এলাকার সিপিআই(এম) কর্মী শেখ সারাফত আলির কাছে লিস্ট জমা পড়ছে ব্রিগেডের। সারাফত বললেন, ‘‘গতবার বুথ থেকে ৮-১০জনকে নিয়ে ট্রেনে করে গিয়েছিলাম। এবার ১৭-১৮জন এসে জানিয়ে গেছে তারা যাবে ব্রিগেড।’’ ব্রিগেডে যাবেন জাহাঙ্গীর মল্লিকও। এই প্রথমবার।