১০০ বছর: নারী মুক্তির লড়াই
-
বৃন্দা কারাত
- Oct 17, 2020 19:52 [IST]
- Last Update: Oct 17, 2020 19:52 [IST]
১৯২০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পর, গোড়া থেকেই নারী মুক্তি আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে ভারতের সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে মার্কসীয় তত্ত্ব এবং প্রয়োগের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করছে। ‘মহিলাদের প্রশ্নে’ পার্টির বোঝাপড়া ফুটে উঠেছে তার কাজের মধ্যে দিয়েই, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির মহিলাদের আন্দোলন এবং অভিজ্ঞতায়। দীর্ঘসময় ধরে আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত মহিলাদের সমস্ত অধিকারকেই আজ বিজেপি-আরএসএস’র রাজত্বে পিছনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখনও একইভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে মহিলাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে জোরালো ভূমিকা নিয়ে কমিউনিস্টরাই হয়ে উঠেছেন মহিলাদের অন্যন্য সাথী।
শুরুর দিনগুলি
স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেই মহিলাদের সমঅধিকারের লড়াইয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নতুন দিক উন্মোচিত করেন কমিউনিস্টরা: প্রথমত, শ্রমিক শ্রেণির অংশ হিসাবে মহিলাদের শোষণ এবং সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্তর্নিহিত যোগ, দুই, মহিলাদের নাগরিকত্ব এবং আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে জাতপাত ব্যবস্থা বিলোপ করার সংগ্রাম এবং তিন, রীতিনীতি, ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়ে এবং পুঁজিবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে মহিলাদের উপর নির্যাতন। পার্টি তৈরির কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯২৯ সালে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার দোষীসাব্যস্ত ১৮জন কমিউনিস্টের বিবাদী পক্ষের সওয়ালেই প্রতিফলিত হয় কমিউনিস্টরা এবিষয়ে ঠিক কী ভাবেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি হিসাবে থেকে গিয়েছে এই সওয়ালটি। বলা হয়েছিল, ‘‘পরিবারকে ঘিরে থাকা সংবেদনশীলতাকেই সবসময় ব্যবহার করা হয় নির্যাতন আড়ালে। আমরা দাবি করি যে, একমাত্র সমাজতন্ত্রেই মহিলা ও শিশুদের শোষণ করার জন্য পরিবারকে ব্যবহার করার প্রক্রিয়ার অবসান ঘটানো সম্ভব...’’ পুরুষের কাছে বরাবরই মহিলারা নিকৃষ্ট এক জীব এবং কিছু সময়ে কার্যত দাসী.. সোভিয়েত ইউনিয়নে যে নারী মুক্তির আন্দোলন চলছে, তাই এগিয়ে চলার রাস্তা দেখাচ্ছে...’’ শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সময়েই পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোর বিরুদ্ধেও কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন কমিউনিস্টরা।
শ্রেণি সংগ্রাম ও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মহিলাদের যুক্ত হতে উৎসাহ যোগানো
স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসাবে যখন মহিলারা আইন অমান্য, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে একত্রিত হচ্ছেন, কমিউনিস্টরা সেইসময় শ্রমিক সংগঠনগুলিকে সঙ্গে নিয়ে শ্রমিক এবং কৃষক শ্রেণির মহিলাদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ন্যায্য ভাতা, প্রাপ্য জমি এবং মর্যাদার মতো মৌলিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত করতে বম্বের বস্ত্র কারখানার শ্রমিক, সোলাপুরে বিড়ি শ্রমিক, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের খেতমজুর এবং দরিদ্র কৃষক পরিবারের মহিলাদের কমিউনিস্টরা এক ছাতার তলায় জড়ো করতে থাকেন। শ্রমিকদের সংগঠিত করার এই বৃহত্তর কর্মকাণ্ডের কয়েকটি হয় ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ (এআইটিইউসি)-এর নেতৃত্বে। এই সংগঠন ১৯২০ সালে তৈরি হওয়ার পরই কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। এআইটিইউসি তৈরির পরই সংগঠনে যোগ দেন সন্তোষ দেবী। তিনি পশ্চিমবঙ্গে পাট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেন। গত শতাব্দীর তিরিশ-চল্লিশের দশকে বম্বেতে পার্বতী ভোরে, অহল্যা রঙ্গনেকর, উষাতাই দাঙ্গে, বিমল রণদিভে এবং আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৬ সালে ‘অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা’ তৈরি এবং জমি ও মর্যাদার প্রশ্নে মহিলা কৃষকদের মধ্যে কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিপুল সংখ্যক মহিলা কৃষককে একত্রিত করে। তেভাগা, তেলেঙ্গানা, সুরমা ভ্যালি আন্দোলন ভারতের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের অন্যতম নিদর্শন হয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক ন্যায় বিচারের সেই লড়াইয়ে মহিলারা শুধু কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন তাই নয়, লালঝাণ্ডা হাতে আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছেন।
পার্টির নেতৃত্বে মহিলাদের শ্রেণিভিত্তিক আন্দোলন চলে আসা সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। একদিকে শ্রেণি অন্যদিকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ একসঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দ্বিগুণ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।
১৯৪৫ সালে মহারাষ্ট্রের থানেতে ওরলি আদিবাসীদের মধ্যে গোদাবরী পারুলেকরের সক্রিয়তা এই বিষয়টিকেই আরও স্পষ্ট করে। জমির মালিকদের মারাত্মক নিপীড়নের শিকার আদিবাসী মহিলারা মুক্তির সংগ্রামে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার আস্বাদ পান। শ্রেণি সংগ্রামের সমবেত শক্তিতে কীভাবে শোষক শ্রেণির সঙ্গে তাঁদের সামাজিক সম্পর্কের বদল ঘটেছে, জমির মালিকদের যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেয়েছেন— নিজেদের সেই সব অভিজ্ঞতার কথা বলেন আদিবাসী মহিলারা।
ত্রিপুরায় দশরথ দেববর্মার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি সর্বাধিক শোষিত-নিপীড়িত আদিবাদী সম্প্রদায়ের মানুষকে বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতা এবং সামাজিক চেতনা বোধ নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। যার ফলস্বরুপ সামন্ততান্ত্রিক ‘তিতুন’ প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত হয়, শহিদ হন তিন আদিবাসী মহিলা।
শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য
সমাজের কোনও একটি শ্রেণির মধ্যেই নারী ও পুরুষের যে বৈষম্য চিরকালীন ঘটে এসেছে, মহিলারাই তাতেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। তেলেঙ্গানার সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের লেখালেখি থেকেই এমন অনেক বিষয় উঠে এসেছে। পারিবারিক সমীকরণগুলি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মহিলারা। এমনকী, স্বামীরা এই সংগ্রামে পাশে না থাকায় ভেঙে দিতে চান ‘সম্বন্ধ’ করে হওয়া বিয়েও। পি সুন্দরাইয়া তাঁর বিভিন্ন লেখায় এমন বহু উদাহরণ তুলে ধরেছেন। এই আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী মাল্লু স্বরাজ্যমের লেখা থেকে জানা গিয়েছে, কীভাবে মহিলাদের সোচ্চার হওয়ার সাহস জুগিয়েছে পার্টি। যদিও এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া পুরুষরাও বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যান, একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসতে থাকায়। একই পরিবারের পুরুষ এবং মহিলা সদস্য এই আন্দোলনে অংশ নিলে, মহিলারা গৃহস্থালীর কাজ ভাগাভাগির প্রশ্নও তুলতে থাকেন। এইভাবেই বিভিন্ন পর্যায়ে মহিলাদের সমঅধিকারের লড়াইয়ে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সদর্থক পদক্ষেপ নেয় পার্টি। ঐক্যবদ্ধ এই আন্দোলনে পুরুষ-মহিলা উভয়েই অগ্রণী ভূমিকা নেন।
শ্রেণি সংগ্রাম যখনই মহিলাদের চেতনার বদল ঘটিয়ে দেয়, তখন আপনাআপনিই লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতিও বদলে যেতে থাকে। গুরুত্ব পায় লিঙ্গবৈষম্যও। এরফলে শ্রেণি সংগ্রাম আরও জোরদার হয়ে ওঠে। বিটি রণদিভে, যিনি এর বহু বছর পর প্রাথমিক বাধা উপেক্ষা করে শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শ্রমজীবী মহিলাদের নিয়ে পৃথক পৃথক কমিটি এবং মঞ্চ তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, তিনি বলতেন, ‘‘মার্কস যখন দুনিয়ার মজদুরদের এক হওয়ার কথা বলেন, তখন শুধু পুরুষ শ্রমিকদের কথা বলেননি।’’ অন্যভাবে বললে, শ্রেণি সংগ্রামকেই পুঁজিবাদের দ্বারা লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই এবং নারী মুক্তির আন্দোলন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত
সমাজ সংস্কার এবং দলিত মুক্তির জন্য জাতপাত বিরোধী বহু আন্দোলন শুরুর দিন থেকেই করছেন কমিউনিস্টরা। সমাজের সবথেকে নিপীড়িত অংশের মহিলাদের উপর যা দারুণ প্রভাব ফেলে। তথাকথিত উঁচুজাতের মধ্যে মহিলাদের অবজ্ঞাও উঠে আসে প্রতিবাদ-আন্দোলনের মঞ্চে। কেরালায় নাম্বুদিরিতে ইএমএস-এর নেতৃত্বে একটি আন্দোলন সংগঠিত হয়। তা-ও নিপীড়িত মহিলাদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়।
তারপর ‘হিন্দু কোড বিল’ সংশোধনের সময় তর্ক বিতর্ক এবং লড়াই-সংগ্রামে সেই সংশোধনকে সমর্থন জানিয়ে সামনের সারিতে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কমিউনিস্ট পার্টির মহিলারাই। এতদিন কমিউনিস্ট পার্টির মহিলারা জাতপ্রথার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন, তার সঙ্গেই জুড়ে যায় এই সংগ্রামও। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত হিন্দু আইনের সংশোধনের দাবিতে লড়াই সাক্ষী থেকেছে বড়মাপের মহিলা আন্দোলনের।
একইভাবে জন্মগতভাবে জাত বৈষম্য, শ্রেণিশোষণ, লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হওয়া দলিত মেয়েদের মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যান কমিউনিস্ট পার্টির মহিলারা। তাঁদের সংগঠিত করেন। সেই ধারা আজও বহমান। জাতপাতের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির বোঝাপড়া এবং লড়াই-সংগ্রাম কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল এবং আছে, তার অন্যতম উদাহরণ হাথরসের সাম্প্রতিক নৃশংসতা।
মহিলাদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয়তা
প্রথম দিকে কমিউনিস্ট পার্টির মহিলারা কাজ করতেন এআইডব্লিউসি’র মতো যৌথ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে। কংগ্রেসের মহিলা সদস্যরাও ছিলেন এই সংগঠনে। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সকল স্তরের মহিলাদের একত্রিত করাই ছিল এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য। বিশেষত, দরিদ্রতর অংশের মহিলাদের কাছে পৌঁছে তাঁদের দাবিগুলি শুনে সেই দাবি তুলে আনা হতো বৃহত্তর আন্দোলনের ময়দানে। জাতপাত এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই সংগঠিত আন্দোলনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তখনই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুধুমাত্র বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মহিলাদের নিয়েই একটি সংগঠন তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই মধ্যে কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন পড়ুয়ারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ নেন, এআইএসএফ-এর নেতৃত্বে। ১৯৩৬ সালে তৈরি হয় এই ছাত্র সংগঠন। তিন বছর পর, ১৯৩৯ সালে আরো বেশি করে ছাত্রীদের সংগঠিত করতে ছাত্রী কমিটি তৈরি করা হয়। যার প্রথম আহ্বায়কদের অন্যতম ছিলেন কনক মুখার্জি। সেই কমিটিতে ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অন্যতম সেনানী কল্পনা দত্ত। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে বিভিন্ন রাজ্যে যেমন, কেরালা, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, অন্ধপ্রদেশে কমিউনিস্ট নেত্রীরা মহিলা সমিতি তৈরির উদ্যোগ নেন। উল্লেখ করার মতো বিষয়, ১৯৪২ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিস্ট পার্টির মহিলারা তৈরি করেন ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’। গরিব পরিবারের মহিলাদের দুরবস্থার দিকে নজর দিতেই মূলত তৈরি হয় এই সমিতি। রেনু চক্রবর্তী তাঁর ভারতের মহিলা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে লেখা বইয়ে এর বর্ণনা করেছেন।
রাজ্যে রাজ্যে গড়ে ওঠা সেই মহিলা সমিতিগুলিকে একত্রিত করে ১৯৫৪ সালে তৈরি হয় ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উওমেন’ (এনএফআইডব্লিউ)। যেখানে অন্যদের সঙ্গেই কমিউনিস্ট পার্টির মহিলারাও লড়াই-আন্দোলন চালিয়ে যান। স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা বজায় রেখেই এনএফআইডব্লিউ-র বহু রাজ্যের শাখা বা বিভাগ আবার স্বাধীনভাবে কাজ করতে শুরু করে। পরে ১৯৮১ সালে এই শাখাগুলিকে একসঙ্গে করে তৈরি হয় ‘অল ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক উওমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ (এআইডিডব্লিউএ)। এক কোটিরও বেশি মহিলা সদস্য নিয়ে সর্ববৃহৎ মহিলা সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই সংগঠন। কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা সদস্যরা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করলেও একে কমিউনিস্ট মহিলাদেরই সংগঠন বলা যায় না। এই সংগঠনের নারীমুক্তি আন্দোলন নিয়ে একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও এটি কমিউনিস্ট সংগঠন বা ফ্রন্ট নয়। কখনও কখনও এই ভুল ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলের মতো এই সংগঠনের নিজস্ব সংবিধান বা কর্মসূচি আছে, তা-ই নয়, সংগঠনের বিপুল সংখ্যক সদস্যের কোনও রাজনৈতিক সংযোগই নেই।
সিপিআই(এম)-এর ভূমিকা
নারী মুক্তি আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা আরও জোরদার হয় ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) তৈরির পর। কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সিপিআই(এম) ১৯৬৪ সালে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি এবং পরে ২০০০ সালে সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচিতে নারী মুক্তি আন্দোলনে শ্রেণিভিত্তিক মতাদর্শগত স্বচ্ছতা স্পষ্ট করে।
২০০০ সালে সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচিতে জনগণতান্ত্রিক কর্মসূচির অংশে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে শিশুদের যত্ন এবং এবং গৃহস্থালীর কাজে উপযুক্ত সহায়তার বিষয়টি যুক্ত করা হয়, পারিবারিক কাঠামোকে গণতান্ত্রিক চেহারা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। এই ভাবেই শ্রমের ক্ষেত্রে লিঙ্গ ভেদের বিরুদ্ধে এবং ‘পবিত্র’ পারিবারিক প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিস্তার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও স্পষ্ট করে। কৃষি বিপ্লবের অংশ হিসাবে জাতপাত এবং লিঙ্গ শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে পার্টি কর্মসূচিতে। পিতৃতন্ত্রে মদত জোগানো পাঁচ দশক ধরে চলে আসো বুর্জোয়া জমিদারতন্ত্রের শাসনকেই অভিযুক্ত করা হয়। মহিলা হিসেবে, শ্রমিক হিসেবে, নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে মহিলাদের শোষণের ছবি ফুটে ওঠে পার্টি কর্মসূচিতে। মহিলাদের সমস্যা ও তার সমাধানে কী ভূমিকা নিতে হবে সেই সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় কমিটির দলিলে এই বোঝাপড়াই পরে আরো বিস্তৃত আকারে তুলে ধরা হয়। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তা গৃহীত হয়। গৃহস্থালির কাজসহ ‘মহিলাদের প্রশ্নে’ মার্কসবাদীদের মনোভাব, সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা বুঝতে চাইলে এই দলিলটি অবশ্যই পড়া উচিত।
বিভিন্ন নীতি
এই রূপরেখার মধ্যে থেকেই আজও পার্টি মহিলাদের যে কোনও সমস্যায় সরাসরি তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। জোরালো অবস্থান নেয়। আন্দোলন সংগঠিত করে। সিপিআই(এম) তৈরির সময় থেকে আজ পর্যন্ত পার্টি যে সকল ঘটনায় পদক্ষেপ নিয়েছে, হস্তক্ষেপ করেছে, তার সব বলা সম্ভব না হলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আজ পর্যন্ত পরিবারসহ সমস্ত ক্ষেত্রে মহিলাদের সমঅধিকারের লড়াইয়ে তাঁদের পাশে সিপিআই(এম)’কে পাননি, সিপিআই(এম) সামনের সারিতে থেকে লড়াই করেনি, এমন একটি ঘটনাও নেই। নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মহিলাদের সমস্যা এবং তাঁদের দাবিগুলি সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে পার্টি। সংসদে, রাজ্য বিধানসভায় সিপিআই(এম) সদস্যরা বরাবর মহিলাদের সম অধিকারের লড়াইয়ে শক্তিশালী সৈনিক হিসেবে পাশে থেকেছেন। সম অধিকার, ন্যয়বিচার সুরক্ষিত করতে আইন প্রণয়নে জোর দিয়েছেন। পছন্দের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার, সমকামিতার পাশাপাশি সংখ্যালঘু মহিলাদের অধিকারসহ নানা বিষয়ে সিপিআই(এম) নিরবিচ্ছিন্নভাবে মহিলাদের পাশে রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কেরালায় সিপিআই(এম) ক্ষমতায় থাকায় প্রতিশ্রুতির বাস্তব রূপায়ণও ঘটেছে। কেরালার এলডিএফ সরকার আজ গোটা দেশের কাছেই একটি উদাহরণ। ‘কুদুম্বশ্রী’ প্রকল্পসহ একাধিক অভিনব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে মহিলাদের ক্ষমতায়নে। সবরিমালার মতোই সমাজ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ এমন সব উদ্যোগ নেয়, যা মহিলাদের জীবনই আমূল বদলে দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলায় ভূমি সংস্কার আন্দোলন জমি আইনে পরিবর্তন আসার বহু আগেই মহিলাদের সম অধিকার সুরক্ষিত করে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্য পাট্টা, কখনও একা মহিলাকেও পাট্টা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে, সংসদে এক তৃতীয়াংশ মহিলা সংরক্ষণের দাবিতে এখন যে আন্দোলন চলছে, তা কয়েক দশক আগে বাংলায় হয়েছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকেন্দ্রীভবনের মাধ্যমে। গ্রাম বাংলায় দরিদ্রতর অংশের মধ্যে আন্দোলন চালিয়ে নীতি নির্ধারণ স্তরে মহিলা প্রতিনিধিত্ব সুরক্ষিত করেছে পার্টি।
কমিউনিস্ট পার্টির মহিলাদের আত্মত্যাগ
কমিউনিস্ট আন্দোলন জোরদার করে তুলতে মহিলাদের কঠোর পরিশ্রম, পুরুষ কমরেডদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁদের লড়াই উল্লেখ করার মতো। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় পার্টি যখন শাসক শ্রেণীর প্রবল আক্রমণের মুখে পড়েছে তখনও লড়াইয়ের ময়দানে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়ছেন মহিলারা।
আজ পার্টির ১০০ বছরের ঐতিহাসিক এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা শহিদ কমরেডদের স্মরণ করছি, কুর্নিশ জানাচ্ছি। অগুনতি সেই সমস্ত মহিলা কমরেডদের কথা মনে পড়ছে, যাঁরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লাল ঝান্ডা কাঁধে সামাজিক-অর্থনেতিক মুক্তির লড়াই লড়েছেন এবং মৃত্যু বরণ করেছেন।