‘দুয়ারে’ উঠে আসছে সেই ক্ষোভের কথাই
-
-
- Dec 02, 2020 10:32 [IST]
- Last Update: Dec 02, 2020 10:32 [IST]
‘দিদিকে বলো’তে বলা হয়েছিল ফোন করে, লিখে অভিযোগ জানাতে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ফোন করে, ফেসবুকে লিখে অভিযোগ জানিয়েছিলেন।
কোনও লাভ হয়নি। কারও প্রাপ্য মেলেনি।
এবার ‘দুয়ারে সরকার।’ মমতা ব্যানার্জির নতুন চাল।
মঙ্গলবার থেকে তা শুরু হয়েছে। প্রথম দিনেই মানুষ বিস্তর দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে মমতা শাসনের বিরুদ্ধে সরকারের শিবিরগুলিতে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। এদিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নবান্নে জানিয়েছেন, ‘‘দুয়ারে সরকার প্রকল্প শুরু হয়েছে। ৩টে ৩৫ পর্যন্ত ১লক্ষ ১৮ হাজার রিকোয়েস্ট পেয়েছি। পাবলিকের সাড়া আসছে। যতটুকু পারবো আমরা করব।’’ কিন্তু এতদিন এসব ভাবেননি কেন?
সিউড়িতে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, ‘‘যে সরকার লকডাউনে মানুষের দরজায় সামান্য স্যানিটাইজার, সাবান, খাবারটুকুও পৌঁছাতে পারেনি, তাদের ‘দুয়ারে সরকার’ হাস্যকর। এইগুলি নিয়ে দুয়ারে কে পৌঁছেছিল মানুষ জানে। আমফানের পর সরকার কোথায় ছিল? এত বছরই বা কোথায় ছিল? এখন ভোটের জন্য সরকার এইসব করছে। পঞ্চায়েত, পৌরসভার কথা মনে পড়েছে। পঞ্চায়েত, পৌরসভা বলে কিছু আছে নাকি আর! সব তো উঠে গেছে। এখন ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও ভোট হয় না। সব দখল করে চলছে। মানুষকে ভোট কেন্দ্রের দরজায় যারা যেতে দেয় না তাদের এখন হঠাৎ করে ‘দুয়ারে সরকার’ মনে পড়েছে। মানুষ সব বুঝছে।’’
যেমন স্বাধীন দলুই। বীরভূমের সিউড়ি-১নং ব্লকের নগরী পঞ্চায়েতের পাথরা গ্রামের দিনমজুর। ধান কাটার কাজ ফেলেই ছুটেছিলেন পঞ্চায়েতে। এসসি সার্টিফিকেটের জন্য। তাহলে বাকি সব প্রকল্পের সুবিধা কি পেয়ে গিয়েছেন? এদিক ওদিক তাকিয়ে খেপে ওঠেন স্বাধীন, ‘‘কিছুই পাইনি। দেখি এটাও পাই কিনা।’’ তবে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘পুজোর আগে মোটে দু’দিন একশো দিনের কাজ করেও মজুরি মেলেনি। তালিকায় নাম আছে। এখনও জোটেনি বাড়ি। আর কত বলব।’’
বৃদ্ধা ঝাপু দলুই ‘সরকারের দুয়ারে’ হয়েছেন দিনভর হয়রান। সব কাগজ নিয়ে এদিন সকালেই এসেছিলেন বার্ধক্য ভাতার আবেদন করতে। আধার কার্ডের জেরক্স না থাকার জন্য তাকে ফিরতে হয়েছে। ছুটতে হয়েছে। জেরক্স করে নিয়ে আসার জন্য। এই ছোটাছুটির পথেই ঝাপু দলুইয়ের ক্ষোভ, ‘‘আগে পাঁচবার আবেদন করেও ভাতা মেলে নি। আর একবার দেখি। কতজনকে কতবারই না বললাম।’’
তৎপর ছিলেন এলাকার তৃণমূলীরাও। তাই তো বগলদাবা করে গাদা খানেক ফরম নিয়ে পঞ্চায়েতে দেখা গিয়েছে এদের অনেককেই। নিজেকে দিদির সৈনিক আখ্যা দেওয়া এমনই একজন জানিয়েছেন, ‘‘এই তে এক ঘণ্টায় এগারোটা বার্ধক্য ভাতার ফরম জমা পড়েছে। বয়স্ক মানুষদের সাহায্য করে দিচ্ছি আর কি।’’ এতে কাজ কিছু হবে ? ‘‘হাল খুব খারাপ’’, জবাব দিয়ে হাঁটা লাগিয়েছেন।
শিবির ছিল দুবরাজপুর ব্লকের যশপুর পঞ্চায়েতেও। সেখানেই এসেছিলেন বোদাকুড়ি গ্রামের সাজু বিবি। তিন প্রতিবন্ধী সন্তানের মা তিনি। মানবিক ভাতার জন্য নাম লিখিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘খুব দরকার টাকা। তিনটে ছেলেই তো প্রতিবন্ধী। খুব আশা নিয়ে এসেছি।’’ আশা নয়, বরং চেপে রেখেছেন ক্ষোভ। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝে।
এদিন কর্মসূচি পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন বীরভূমের জেলাশাসক। সিউড়ি-২নং ব্লকের পুরন্দরপুরে জেলা শাসক বিজয় ভারতী বলেছেন, ‘‘প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা খুব ভালো। মানুষ এসেছেন শিবিরে। অনেক কাজ সঙ্গেই সঙ্গেই করে দেওয়া হচ্ছে। আর তা যা সম্ভব নয়, সেগুলি শীঘ্রই করে দেওয়া হবে। দু-মাস সময় আছে তো।’’
তবে জেলা শাসক যাওয়ার আগে সেই পঞ্চায়েতে দাঁড়িয়েই পুরন্দরপুরের বুলু বাগদি উগরেছেন ক্ষোভ, ‘‘একবার বাড়ির টাকা পেয়েই বন্ধ। বহুদিন হয়ে গেল। তাই জানাতে এসেছি। আমি একটা বাড়ির টাকাই পুরো পেলাম না। কতজনের দুটো-তিনটে হয়ে গেল।’’ বেশ বোঝা গিয়েছে এলাকায় এলাকায় কড়া নজরদারি ছিল শাসকদলের। বোলপুরের রূপপুর পঞ্চায়েতের শিবিরে আসা রূপরাম হাঁসদা উদাহরণ। তার কথায়, ‘‘গতকাল ফোন করে এগারোটার সময় আসতে বলা হয়েছিল। এসেছি। ভালো লাগছে কাস্ট সার্টিফিকেটের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।’’ কি কি সুবিধা পান ? সটান উত্তর রূপরামের, ‘‘সরকারের সব সুবিধাই পাই!’’
অন্যদিকে মঙ্গলবার বিষ্ণুপুর শহরের ১৪নং ওয়ার্ডে সরকারি আধিকারিকরা মানুষের দুয়ারে এলে মানুষের কাছ থেকে একাধিক অভাব অভিযোগের ক্ষোভের মুখে পড়লেন। বিষ্ণুপুর পৌরসভা থেকে এই এলাকার মানুষজন যে কোনও রকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না তা সরাসরি সরকারি আধিকারিকদের জানান। এখানকার বাসিন্দারা সরকারি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির প্রশ্নে সরাসরি শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির স্পষ্ট অভিযোগ তোলেন। এখানকার বাসিন্দা ঝরনা লোহার জানান, দেড়শো বছরের পুরানো ভাঙা ঘরে বাস করি। তিনি জানান, আমরা স্থানীয় কাউন্সিলরকে বারে বারে বলেছি একটা মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই করে দিতে। সরকারের প্রকল্পই তো আছে বাড়ি করে দেওয়া। কিন্তু আমরা বাড়ি পেলাম না, উলটে এই এলাকাতেই অবস্থাপন্ন ব্যক্তির পাকা বাড়ি ভেঙে সেখানে নতুন বাড়ি বানিয়ে দিচ্ছে বিষ্ণুপুর পৌরসভা। কি করে এটা হয়? এখানকার বাসিন্দারা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু ব্যক্তির নামও তুলে ধরেন আধিকারিকদের কাছে। ঝরনা লোহার জানান, অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে কোনমতে সংসার চালাই। আমাদের পক্ষে কি বাড়ি করা সম্ভব? এখানকার বাসিন্দা পুতুল করঙ্গা জানান, আমার বাড়ি পড়ে যাওয়ার পর কাউন্সিলরের কাছে যাই। তিনি একবার দেখতেও আসেননি। খালি একটা ছোট ত্রিপল আমাকে দেয়। পরিবারের ১২জনকে নিয়ে সেই ছোট্ট ত্রিপলের মধ্যে দিন কাটাই। বাড়ি তৈরির জন্য আবেদন জমা দিয়েও বাড়ি পাচ্ছি না। কেউ দেখাই করে না আমাদের সঙ্গে। মহকুমা প্রশাসনের লোকজন প্রত্যক্ষ করলেন এতদিন ধরে এলাকায় কিভাবে উন্নয়ন ঘটেছে।