কেডি সিং-কে জেরায় আতঙ্ক তৃণমূল শিবিরে
-
-
- Jan 15, 2021 10:39 [IST]
- Last Update: Jan 15, 2021 10:39 [IST]
অ্যালকেমিস্ট চিট ফান্ডের টাকাতেই হয়েছিল তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়। শুধু তাই নয়, এই চিট ফান্ড কারবারি কেডি সিং-কে আবার উত্তর ভারতে ‘সংগঠন বাড়ানোর’ প্রধান দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তখন ২০১২ সাল। আবার দিল্লিতে এক বিলাসবহুল হোটেলে তৃণমূলের প্রভাবশালী সাংসদের বিয়েতে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচও করেছিলেন ইডি’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এই প্রাক্তন তৃণমূলী সাংসদ।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে দাবি, যখন কেডি সিং-কে উত্তর ভারতে তৃণমূলের ইনচার্জ করা হয় তার অনেক আগেই সেবি সহ একাধিক নজরদারি সংস্থার নজরে কেডি সিং ও তাঁর সংস্থা। ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের গোয়েন্দা বিভাগ কেডি সিং-র অ্যালকেমিস্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তারপর আরও একাধিক নজরদারি সংস্থার আওতায় আসেন তিনি।
কেডি সিংয়ের গ্রেপ্তারির পরে দায় এড়াতে তৃণমূলের তরফে দাবি করা হয়েছে, তাঁর সঙ্গে নাকি দলের যোগ নেই। অথচ এখনও পর্যন্ত কেডি সিং-কে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এমন কোনও তথ্য জানাতে পারেননি তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাও।
ঝাড়খণ্ডে জাল বিস্তার করা পনজি স্কিমের কারবারিকে সরকারি আতিথেয়তা দিয়ে এরাজ্যে ডেকে এনেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। বিনিময়ে ভরেছিল দলের তহবিল, নির্বাচনী মিলেছিল হেলিকপ্টার পরিষেবা। তদন্তকারী সংস্থার জেরার মুখে কেডি সিং বৃহস্পতিবার এমন কিছু তথ্য জানিয়েছেন যা তৃণমূলের একেবারে মাথার লোকেদের বিপদ বাড়াতে পারে। ইডি’র একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল ও প্রশাসনের সহযোগিতাতেই বেড়েছিল অ্যালকেমিস্টের পনজি স্কিমের কারবার। ১৯০০ কোটি টাকার বেশি বাজার থেকে তুলেছিল তৃণমূলের এই প্রাক্তন সাংসদের সংস্থা।
অ্যালকেমিস্টের বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যে গত কয়েকবছরে পঞ্চাশটিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছিল একাধিক থানায়। শুধু পূর্ব বর্ধমান জেলাতেই একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। যদিও কার্যত তা উপেক্ষা করেই চলেছে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন। তবে নারদকাণ্ডে কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পরেই তড়িঘড়ি মামলা দায়ের হয়ে তৃণমূলের এই ব্যবসায়ী সাংসদের বিরুদ্ধে। তালুকদার কমিটির তৈরি হওয়ার পরে সাম্প্রতিককালে অ্যালকেমিস্টের আমানতকারীদের কিছু অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু তাও যৎসামান্য। এক থেকে তিন হাজার টাকা মাত্র ফেরত পাচ্ছেন আমানতকারীরা।
সিবিআই তদন্ত ঠেকাতে আদালতে অ্যালকেমিস্ট সংস্থার তরফে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে দাবি করা হয় যে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। আদালত সেই দাবির মান্যতা দেয়। অ্যালকেমিস্টের তরফে জানানো হয়, ২০১৭’র ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত যাদের বিনিয়োগ ম্যাচুউরিটি হয়েছে তাঁদের টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে ৭৪ হাজার আমানতকারীরা তালিকাও তৈরি হয়। কিন্তু আদালতে জানালেও টাকা প্রক্রিয়া ফেরতের প্রক্রিয়ায় ফের প্রতারণা। কার্যত রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই তৃণমূলী সাংসদের সংস্থার এই প্রতারণার কারবার বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। সারদা থেকে নারদ কেলেঙ্কারির পালটা চাপে কলকাতা পুলিশকে দিয়ে অ্যালকেমিস্টের বিরুদ্ধে তদন্তের ঘোষণা করা হলেও তদন্তও তাই বন্ধই ছিল।
কয়লা থেকে গোরু পাচারে এমনিতেই বেসামাল শাসক তৃণমূল। কেডি সিংয়ের গ্রেপ্তারির তৃণমূলের আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। এদিন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দফায় দফায় জেরার মুখে প্রথম দিকে অনড় থাকলেও ইডি’র আধিকারিকদের বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন। মমতা ব্যানার্জিকে তাঁকে এরাজ্য থেকে সাংসদ করেছেন সেকথাও জানিয়েছেন কানওয়ারদীপ সিং।
চণ্ডীগড়ে একসময় পার্টি অফিস খুলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তৃণমল সূত্রেই জানা গিয়েছে ২০১২ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চণ্ডীগড়ে এই বিলাসবহুল পার্টি অফিস খোলা হয়। মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে তৎকালীন তৃণমূল নেতা মুকুল রায় চণ্ডীগড়ে গিয়ে তা উদ্বোধন করেন। তৃণমূলের তরফে উত্তর ভারতে সংগঠন বাড়ানোর প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হয় কেডি সিংকেই। বিপুল টাকা ঢালেন। ওই পার্টি অফিসও কেডি সিংয়ের টাকায়। তখন তিনি ঝাড়খণ্ড থেকে তৃণমূলের সাংসদ। ২০১০ সালে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার হয়েই রাজ্যসভায় প্রথমে সাংসদ হন। ওই নির্বাচনে বিপুল টাকায় ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। পরে ২০১১ সালে তৃণমূলে যোগ দেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানা গিয়েছে, ২০১২ সালে যখন ওই পার্টি অফিস উদ্বোধন হচ্ছে তখনও তিনি অ্যালকেমিস্টের এমডি পদে রয়েছেন। যদিও পরে তৃণমূলের সেই অফিস পাততাড়ি গোটায়।
খোদ কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের তথ্যেই দেখা গিয়েছে কেডিএস কর্পোরেশন নামে যে সংস্থা রয়েছে তাতে কেডি সিং, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ ও দু’জন ঘনিষ্ঠেরই রয়েছে সিংহভাগ শেয়ার। এই কর্পোরেশনের মালিকানাধীন একাধিক সংস্থা রয়েছে যাদের কোনও অর্থনৈতিক লেনদেনের চেহারা খুঁজে পাওয়া যাবে না, কী তাদের কারবার তা ব্যালান্সশিটেও বোঝা যাবে না। অথচ সেই কোম্পানিগুলিতেই বেবাক বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে কীভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কারা করছে? ভিনরাজ্য থেকে জহুরির চোখ দিয়ে বেছে বেছে যেভাবে এত বড় প্রতারককে এরাজ্য থেকে কেন সাংসদ করে রাজ্যসভায় পাঠানো হলো তাতেই স্পষ্ট চিট ফান্ডের টাকাতেই বেড়েছে শাসক তৃণমূলের চেহারা।