‘লড়াই হুকুমতের সঙ্গে’
-
অরূপ সেন
- Jan 13, 2021 10:28 [IST]
- Last Update: Jan 13, 2021 10:28 [IST]
নয়াদিল্লি, ১২জানুয়ারি— সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ফাঁক দেখছেন কৃষকরা। কেন্দ্রের তিন আইনের রূপায়ণ আপাতত স্থগিত রাখাকে স্বাগত জানিয়েও মঙ্গলবার কৃষক আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, সরকার আইন করেছে, সরকার আইন প্রত্যাহার করবে। কৃষকরা আদালতের কাছে যায়নি, আদালতের হস্তক্ষেপও চায়নি। সরকার চাইছে নিজেদের দায়িত্ব আদালতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে। শীর্ষ আদালতের তৈরি কমিটির সামনে কৃষক সংগঠনগুলি যাবে না। আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এদিন সংযুক্ত কৃষক মোর্চা বলেছে, সুপ্রিম কোর্ট কৃষকদের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারকে মান্যতা দিয়েছে। কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন এবং কুৎসাপূর্ণ অভিযোগকে খারিজ করে দিয়েছে। আদালতে আবেদনগুলির কোনও কোনওটি কৃষকদের প্রতিবাদস্থল থেকে উৎখাত করতে বলেছিল।
মোর্চা তিন আইন রূপায়ণ স্থগিত রাখার আদেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে এই আইনগুলি অসাংবিধানিকও বটে। কিন্তু এই স্থগিতাদেশ অস্থায়ী, তা যে কোনও সময়ে পালটে যেতে পারে। আমরা আইন স্থগিত রাখার জন্য লড়াই করিনি, আইন প্রত্যাহার করার জন্য লড়াই করছি। সুতরাং শুধু এই রূপায়ণ স্থগিত রাখায় আমাদের আন্দোলনের পরিবর্তন ঘটবে না।
মোর্চা বলেছে, আমরা কমিটি সম্পর্কে আমাদের অবস্থান আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলাম। সুপ্রিম কোর্টকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু তাদের মধ্যস্থতা চেয়ে আমরা কোনও আবেদন করিনি, এই ধরনের কোনও কমিটির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্কও নেই। আদালত তার নিজের জন্যই হোক, বা কৃষকের সঙ্গে মধ্যস্থতার জন্যই হোক, যে কারণেই কমিটি তৈরি করে থাকুক তার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে মোর্চার নেতারা বারংবার বলেন, সরকারের সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। আমরা কমিটি গঠনের আবেদন জানাইনি। আমরা কেন কমিটির কাছে যাব? সুপ্রিম কোর্টের গঠিত কমিটির চার সদস্যই খোলাখুলি কৃষি আইনের সমর্থক। তাঁরা তা লাগাতার বলেও চলেছেন। তাহলে এ কেমন কমিটি? এটি দুঃখের যে নিজেদের তৈরি কমিটিতে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকেও রাখেনি সুপ্রিম কোর্ট। আদালত যদি এখন নামও বদলে দেয়, কৃষি আইনের বিরোধী কাউকে কমিটিতে নেয় তাহলেও কৃষকরা এই কমিটির কাছে যাবে না।
সারা ভারত কৃষকসভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছে আত্মসমর্পণের দিকেই ঠেলে দেবে। আইনের রূপায়ণ স্থগিত রেখেছে সরকার, আইন থাকছেই। কৃষকরা ঘরে ফিরে গেলেই আবার স্থগিতাদেশ তুলে দেওয়া হতে পারে। কৃষকরা প্রথম থেকে বারবার বলেছে, কমিটির কাছে যাব না। সরকারের কাজ সরকারকেই করতে হবে। তার পরেও এই কমিটি হলো। সরকার যা চাইছিল। আমরা যে আশঙ্কা করছিলাম তা সত্যি প্রমাণ করে সুপ্রিম কোর্ট এমন চার জনকে নিয়ে কমিটি বানিয়েছে যারা খোলাখুলি কর্পোরেটপন্থী, কৃষক বিরোধী। তাহলে তাঁরা কী রায় দেবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। সরকারেরই ইচ্ছা আদালতের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তা দুঃখজনক। সরকার বা আদালত কারোর কাছেই ন্যায়বিচার পেল না কৃষকরা। আন্দোলন চলতে থাকবে। তা দেশজুড়ে ছড়িয়েও যাবে।
সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতা দর্শন পাল, বলবীর সিং রাজওয়াল, জগবীর সিং প্রমুখ এদিন সাংবাদিকদের কাছে বলেন, আন্দোলনের কর্মসূচি বহাল থাকছে। ২৬ জানুয়ারি কৃষক প্যারেড হবে। শান্তিপূর্ণভাবে সেই প্যারেড হবে। তবে সেদিনই আন্দোলন শেষ হবে তা নয়। প্রয়োজনে লড়াই চলতে থাকবে।
এদিন তিন কৃষি আইনে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশকে স্বাগত জানিয়েও সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি (এআইকেএসসিসি) এদিন এক বিবৃতিতে স্পষ্ট বলেছে, ‘‘তিনটি আইনের পুরোপুরি প্রত্যাহারই কৃষকের দাবি। সুতরাং আইন প্রত্যাহৃত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’’
এআইকেএসসিসি’র পর্যবেক্ষণ, ‘‘সর্বোচ্চ আদালতের এই স্থগিতাদেশের ফলে আইনগুলির প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। সুতরাং এটি একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা, স্থায়ী কোনও সমাধান নয়। যে কোনোদিন ফের এই আইন জারি করা যাবে। সকলকে বুঝতে হবে, ভারতের জনগণ এবং কৃষকসমাজ এই আইনের তীব্র বিরোধী। তাই অবশ্যই এই আইন তিনটি খারিজ করা উচিত সরকারের।’’
কেন্দ্রের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এআইকেএসসিসি বলেছে, ‘‘তিন কৃষি আইনের কুফল সম্পর্কে নিজেদের ব্যাখ্যা স্পষ্টভাষায় কেন্দ্রকে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। সরকারকে ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে, তাদের এই তিন আইনের ফলে দেশের কৃষি উৎপাদন, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ এবং কৃষি বিপণনের পুরো ব্যবস্থাটাই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এই আইন কার্যকরী হলে কৃষি উপাদান তথা চাষের খরচ আরও বাড়বে। কৃষকের ঋণ আরও বাড়বে। ফসলের দাম আরও কমবে। কৃষকের লোকসান আরও বাড়বে। ফসল সংগ্রহের সরকারি ব্যবস্থা চুরমার হয়ে যাবে। গণবণ্টন ব্যবস্থার বিদায়ঘণ্টা বাজবে। খাদ্যসামগ্রীর দাম আরও বাড়বে। আরও বেশি সংখ্যক কৃষক ও খেতমজুর আত্মঘাতী হবেন। অনাহারে মৃত্যু বাড়বে। ঋণজালে জড়িয়ে আরও কৃষক জমি হারাবেন। অথচ এই রূঢ় বাস্তবের দিকটি দেশের মানুষ, এমনকি আদালতের কাছেও লুকিয়ে রাখছে কেন্দ্রীয় সরকার।’’
এআইকেএসসিসি এদিন জানিয়েছে, ‘‘২৬জানুয়ারি সারা দেশের সঙ্গে রাজধানী দিল্লিতেও শান্তিপূর্ণভাবে বিশাল ‘কিষান প্যারেড’ বের করবে কৃষক সংগঠনগুলি। কৃষকরা সেদিন সাধারণতন্ত্র দিবস উদযাপন করবেন। এব্যাপারেও আদালতকে ভুল বোঝাতে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার। এছাড়াও পূর্বঘোষণা মতো ১৩এবং ১৮জানুয়ারি কৃষক আন্দোলনের কর্মসূচি বহাল থাকবে।’’
কেন্দ্রের তিন কৃষি আইনে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশে এদিন সন্তোষ প্রকাশ করেছে কংগ্রেস। তবে কোর্ট গঠিত কমিটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে তারাও। এদিন দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সূরযেওয়ালা বলেন, ‘‘কমিটির সদস্যরা তো নয়া আইনের সমর্থক। ওঁদের হাত থেকে কৃষকরা ন্যায়বিচার পাবেন কি করে!’’ সর্বোচ্চ আদালতের এদিনের আদেশকে ‘‘কৃষকদের পক্ষে বিরাট স্বস্তি’’ আখ্যা দিয়েছেন এনসিপি নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শারদ পাওয়ার। ডিএমকে নেতা এমকে স্টালিন বলেছেন, এই স্থগিতাদেশ ‘‘ভারতজুড়ে আন্দোলনরত কৃষকদের জয়। এবার সংসদের আগামী অধিবেশনে এই তিন আইন প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিক কেন্দ্র।’’