ছাব্বিশের মহড়া বোঝালো বড় লড়াইয়ের জন্য তৈরি কৃষকরা
-
-
- Jan 08, 2021 01:18 [IST]
- Last Update: Jan 08, 2021 03:00 [IST]
‘‘আজকের র্যালিটা তো শুধু দিল্লির চৌহদ্দি বরাবর। নেতারা যখন মনে করবেন আমাদের রাজধানীর মধ্যে ঢোকা দরকার, তখন আমরা তাই করব।’’ চলমান ট্রাক্টরে বসেই বলছিলেন পাঞ্জাবের হোসিয়ারপুর থেকে আসা হরজিন্দর সিং। সেই কথার ফাঁকেই, পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হরজিন্দরের সহযোদ্ধারা তখন তাঁর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন একটার পর একটা জিনিস। কেউ দিচ্ছেন বাদাম, কেউ বা কচুরি। চায়ের সঙ্গে একজন আবার এগিয়ে দিলেন সকালের খবরের কাগজটাও।
সকাল এগারোটা নাগাদ সিঙ্ঘু থেকে যখন হরজিন্দরদের ট্রাক্টরগুলো একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন সেই ট্রাক্টরে বাঁধা মাইকে ঘন ঘন স্লোগান উঠছে। কোনোটায় আবার চলছে লড়াইয়ের গানও। আশপাশের ট্রাক্টর এমনকি নিচে বিদায় জানাতে হাজির লোকজনও তাতেও গলা মেলাচ্ছেন। সেই মিছিলের কোনও ট্রাক্টরে তখন উড়ছে সংগঠনের পতাকা- লাল, সবুজ, হলুদ নানান রঙের মিলন। সেই মিলিত সুরের মিছিলেই আবার মাঝে মাঝেই নজরে পড়ছে জাতীয় পতাকার তিনটে রংও। গান-স্লোগানেই মালুম হচ্ছে কৃষকদের জোশ।
এর মধ্যেই অনেকটা পথ সফর করেছেন হরজিন্দররা। প্রবল শৈত্যপ্রবাহ, মাঝে মধ্যে দুর্যোগের ঝড়-বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে এই ফাঁকা জায়গায় রাত কাটানো মোটেই সহজ হবে না বুঝেও এই সিন্ধু সীমান্তে এসে বসেছেন হরজিন্দররা। সঙ্গে বাড়ির মহিলা, বাচ্চা ছাড়াও এসেছেন বুজুর্গ লোকজনও। পেরিয়ে গেছে চল্লিশের বেশি দিন। তবু লড়াইয়ের জমি ছেড়ে যাননি লড়াকু কৃষকরা। হরজিন্দার জানিয়ে দিয়েছেন, আইন তুলিয়েই ঘরে ফিরবেন। ‘‘সরকার তো শুধু মিটিংয়ের পর মিটিংই ডেকে চলেছে। ওরা তো জানে, আমরা কী চাই। আমরা চাই আইনগুলি প্রত্যাহার হোক। কিন্তু পরের পর নিষ্ফলা বৈঠক থেকে আমরা কী পেলাম!’’
শুক্রবার কেন্দ্রের সঙ্গে অষ্টম দফার ঠিক আগে আজ হাজার হাজার কিষান ট্রাক্টর নিয়ে মিছিলে বেরিয়েছিলেন সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর আর রেওয়াসান বর্ডার থেকে। চারটে আলাদা আলাদা জায়গা থেকে চারটে আলাদা আলাদা মিছিল। ১৩৫কিলোমিটার দীর্ঘ কুণ্ডলি-মানেসর-পালওয়াল (কেএমপি) এক্সপ্রেসওয়ের ছয় লেন জুড়ে ট্রাক্টর মিছিল বের হলো। গাজিপুর থেকে যখন বিকেইউ নেতা রাকেশ টিকায়িতের নেতৃত্বে একটা ট্রাক্টর মিছিল এগিয়ে গেল পালওয়ালের দিকে, ঠিক সেসময়েই সিঙ্ঘু থেকে হরজিন্দরদের ট্রাক্টর মিছিল বেরোলে টিকরির দিকে। দিকে। টিকরির থেকে আরেকটা ততক্ষণে রওনা হয়ে গেছে কুণ্ডলির দিকে। পথে সাঁপলায় যেখানে সার্ভিস রোড জুড়েছে জাতীয় সড়কে সেখানে আগে থেকে এসে অপেক্ষা করছিলেন কৃষকসভার নেতা হান্নান মোল্লা, বিজু কৃষ্ণাণরা। পতাকা নাড়িয়ে হান্নান মোল্লা আনুষ্ঠানিক সূচনা করে একটা ট্রাক্টরে উঠে পড়লেন। তেমনই হরিয়ানার রেওয়াসান থেকে পালওয়াল রওনা হলো চতুর্থ ট্রাক্টর মিছিল।
কিষান নেতা জোগিন্দর সিং উগ্রাহান হিসাব দিলেন, সবমিলিয়ে সাড়ে তিন হাজারের উপর ট্রাক্টর, ট্রলি এদিনের মিছিলে ছিল। সংযুক্ত কিষান মোর্চার আরেক নেতা অভিমন্যু কোহারের হিসাব, শুধু হরিয়ানা থেকেই আজ আড়াই হাজার ট্রাক্টর মিছিলে এসেছে। ওঁর কথায়, ‘‘সরকারকে আমরা হুঁশিয়ার করছি, ওরা যদি আমাদের দাবি না মানে, তাহলে আগামী দিনে লড়াই কিন্তু আরও তীব্র হবে।’’
সেই তীব্র লড়াইয়ের আঁচ পাওয়া গেল আজকের ট্রাক্টর মিছিলেই। ‘‘আজকের ট্রাক্টর র্যালিটা দিয়েই আমরা সরকারকে বুঝিয়ে দিতে চাই, একটা ঝলক দেখাতে চাই যে আমরা কী করতে পারি আর ২৬ জানুয়ারি কী করব। আজকেরটা তো শুধুই ট্রেলার। পিকচার আভি ভি বাকি হ্যায়। ’’ বলছিলেন হরজিন্দর।
বাকি পিকচারের আন্দাজ দিয়ে গেলেন একের পর এক কৃষক নেতারা। জানিয়ে দিয়েছেন, সেদিন দিল্লির রাজপথে ট্যাঙ্কারের কুচকাওয়াজের সময় হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ট্রাক্টর ঢুকে পড়বে রাজধানীর মধ্যে। আজকেরটা ছিল তারই ‘মহড়া’।
আর জলন্ধরের কিষান নবপাল সিংয়ের কথায়, ‘এই মহড়াটা আসলে কৃষকদের তাকত্ আর জোশ প্রদর্শন। ছব্বিশের ট্রেলার।’
টিকরি বর্ডার থেকে ট্রাক্টর নিয়ে কুণ্ডলির দিকে এগোনোর পথে নবপালের সঙ্গী, যশপাল সিং দেওল বললেন, ‘‘আমরা হলাম মাটির সন্তান। আইন চালু থাকলে আমরা না খেতে পেয়ে মরে যাব। এই সালটা আর নরেন্দ্র মোদীকে ইতিহাস মনে রাখবে ট্রাক্টরকে জমি থেকে রাস্তায় টেনে আনার জন্য।’’ তবে জয় নিয়ে প্রত্যয়ী পাঞ্জাবের চমকার সাহিব থেকে আসা কিষানের কথায়, ‘‘আজকের র্যালিটা আসলে সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া আমরা আমাদের দাবি আদায় না করে ফিরছি না।’’
হরজিন্দররা অবস্থান স্থল ছেড়ে এগিয়ে যাওয়ার পর সিঙ্ঘু দিনভর অনেকটাই শুনশান। অন্য দিনের তুলনায় বেশ কিছুটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তবে জীবন চলতে থাকল নিজের মতোই। লঙ্গরগুলিতে তখন বিকালের খাবার তৈরির ব্যস্ততা। যাঁরা রয়ে গেলেন বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, মহিলা-বাচ্চাদের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার সমান তৎপরতাই নজরে পড়ল মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলিতে। রাতে আগুন পোহানোর ব্যবস্থাতে খামতি নেই। আসলে লড়াইয়ের জমিতে কোনও জায়গাতেই ঢিলেমি দিতে নারাজ লড়াইয়ে থাকা কিষানরা।
অনেকটা পথ যেতে হবে তো।