আক্রান্ত শ্রমজীবীই তৈরি করবেন আন্দোলনের নতুন পরিসর
-
-
- May 01, 2020 13:05 [IST]
- Last Update: May 01, 2020 11:13 [IST]
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস, মে দিবস শ্রমিকের অধিকারবোধের দিন, ঐক্যের শপথের দিন, লড়াইয়ে দৃপ্ত থাকার দিন, তাই উৎসবের দিন। পুঁজির নির্মম শোষণের মধ্যে মজুরি-দাসত্বে বেঁচে থাকলেও, কোথাও প্রায় মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হলেও শ্রমজীবী মার খেতে খেতে ঘুরে দাঁড়ায়। বারংবার ইতিহাস জ্বলে ওঠে সেই প্রদীপ্ত লড়াইয়ে। মে দিন সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করার দিন।
এবারের মে দিবস এসেছে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে। বিশ্বজোড়া করোনা মহামারীর প্রকোপে আক্রান্ত মানুষের স্বাস্থ্য, মানুষের জীবন। ২ লক্ষের ওপরে মানুষ ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন এই রোগে। আক্রান্ত আরও তিন লক্ষের বেশি। অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ দেশেই। চলছে লকডাউন।
করোনা মহামারীও উন্মোচিত করেছে পুঁজিবাদী সমাজের বাস্তবতাকে। উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে এই রোগের বেশি শিকার হয়েছেন গরিব মানুষ, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, অভিবাসীরা। সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়েছে শহরের গৃহহীন, বস্তিবাসী, শ্রমিক মহল্লায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে বিভিন্ন প্রদেশে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অনুপাত জনসংখ্যায় যত করোনায় মৃতের সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি। ব্রিটেনে গরিব মানুষ, অভিবাসীদের আক্রান্ত হবার সংখ্যা বেশি। এই সঙ্গেই মানবিক মূল্যবোধহীন সমাজ একেবারে সামনে চলে এসেছে। ইউরোপ,আমেরিকায় বৃদ্ধাবাসে, কেয়ার হোমে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এই কেয়ার হোমগুলিকে বলা হচ্ছে ‘মৃত্যু গহ্বর’।
সংক্রমণের বাইরেও মৃত্যু ও ক্ষুধা এসে হানা দিয়েছে শ্রমজীবীর ঘরে। দেশে দেশে কোটি কোটি শ্রমিক ইতিমধ্যেই কাজ খুইয়েছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মে দিবসের প্রাক্কালেই জানিয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা ১৬০ কোটি শ্রমিক এখনই কাজ হারানোর ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির তা প্রায় অর্ধেক। ভারতেও কাজ গেছে প্রায় ২ কোটি মানুষের। এই সংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের আয় প্রায় শূন্য। অনেক দেশে তাঁরা বেঁচে আছেন সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সাহায্যের ওপরে। আন্তর্জাতিক স্তরের সমীক্ষক সংস্থাগুলি জানিয়েছে, বিপুল পরিমাণ শ্রমজীবী নতুন করে দারিদ্রের কবলে পড়বেন। পৃথিবীর শহরগুলি হয়ে উঠবে ছিন্নমূল, কর্মহীন, অনিশ্চিত জীবনের মানুষের বসতি।
ভারতে এই মে দিবসে রাস্তায় পরিযায়ী শ্রমিকরা। অপরিকল্পিত লকডাউনের পরেই আমরা দেখেছি লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক আয় হারিয়ে, কাজ হারিয়ে, ছাদ হারিয়ে চেষ্টা করছেন নিজেদের ঘরে ফেরার। রাজপথ ভরে উঠেছে পরিযায়ীদের স্রোতে। তারপর তাঁদের ঠেকিয়ে রাখা হলেও ওই রাস্তায় বা ত্রাণ শিবিরে বিপজ্জনক জীবন যাপন করছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় সরকার বুধবারই ঘোষণা করেছে পরিযায়ীদের ঘরে ফেরার অনুমতি দেওয়া হবে কিন্তু দায়িত্ব রাজ্যগুলির। এখন কোন রাজ্য এঁদের ফেরানোর উদ্যোগ নেবে, কেউ নেবে না। আধুনিক ভারত নির্মাণ করছেন যাঁরা তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ব্রাত্য সরকারের পরিকল্পনায়। বস্তুত দেশে পরিযায়ীরা কারা, তাঁদের সংখ্যা কত, কীভাবে তাঁরা জীবন যাপন করেন, এই প্রথম তা যেন নজরে এল।
এই মহামারী আরও দেখিয়ে দিয়েছে মহিলা শ্রমজীবীরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন। কাজ হারানোর দলে রয়েছেন তাঁরা, অথচ সংসারের হাল ধরতে হচ্ছে তাঁদের। খাদ্যের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে তাঁদের। পৃথিবীজুড়েই স্বাস্থ্যকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ মহিলা। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসার কাজে যুক্ত। স্পেন থেকে ব্রিটেন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে নার্সরা, তাঁদের সুরক্ষা নেই বলে। ভারতে আশা কর্মীরা প্রায় কোনও রকম সুরক্ষা ছাড়াই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করছেন।
করোনা মহামারীর মধ্যেই ধীরে ধীরে উঠতে থাকবে শ্রমিকদের অধিকারের দাবি। জীবনের বাধ্যতাতেই গড়ে উঠতে থাকবে প্রতিবাদ। নতুন করে সংগঠিত হতে থাকবেন শ্রমিকশ্রেণি। বস্তুত শ্রমজীবীর আন্দোলনের নতুন পরিসর তৈরি হতে চলেছে।