মোদী সরকার থাকতে,আর কোনও দালালের দরকার আছে কি!
-
নীলোৎপল বসু
- Sep 25, 2020 20:07 [IST]
- Last Update: Sep 25, 2020 16:07 [IST]
তিনটি কৃষি সংক্রান্ত আইন নিয়ে যে ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছে দেশে, তা নিঃসন্দেহে সরকারকে কিছুটা ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। স্বয়ং মোদী যেভাবে কোমর বেঁধে ময়দানে নেমে পড়েছে তার থেকেই এটা আরও স্পষ্ট। মোদীর প্রচারে কেন্দ্রবিন্দু, কৃষি পণ্যের বিপণনে দালালদের উৎখাত করবে সরকার। আসলে এখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, দেশের মানুষের অধিকাংশই বিপন্ন। মহামারীর আবহে দুনিয়াজুড়েই নয়া উদারবাদ বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, কোভিড সংক্রমণ সমকালীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটাকেই ভেঙেচুরে দিচ্ছে। কিন্তু যাঁরা দুনিয়ায় হাল হকিকত সম্পর্কে খবর রাখেন তাঁরা ঐকমত্য যে, নয়া উদারবাদতাড়িত পৃথিবী ভাঙাচোরাই ছিল। মহামারী উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছে। মহামারীর প্রকোপে বিপন্নতা অর্থনীতির ভঙ্গুর রেখাচিত্র থেকেই স্পষ্ট। আর এর ভয়ানক প্রভাব সবচেয়ে বেশি প্রকট, সবচেয়ে মাতব্বর পুঁজিবাদী অর্থনীতিগুলিতে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অবলীলাক্রমেই শীর্ষস্থানে রয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অর্থনীতির এই বিপর্যয় সবথেকে তীক্ষ্ণ প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। সারা পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন। কিন্তু এখানেও, একটা প্রবণতা স্পষ্ট। এই অবস্থার যারা শিকার তাদের বেশিরভাগটাই একই সঙ্গে আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্যের ভয়ংকর প্রভাবে আগে থেকেই ক্ষতবিক্ষত। কোভিড মহামারীর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় তা সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত। কারণগুলোও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি বিমা সংস্থার করাল গ্রাসে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই লোপাট হয়ে গেছে। আর এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপট আরও স্পষ্ট হচ্ছে মহামারী মোকাবিলার ব্যবস্থাপনায় চীন সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক এবং সামাজিক গণতন্ত্রের নীতি অনুসরণকারী দেশগুলোর তুলনামূলক সাফল্য। আর এখানেই কোভিড পরবর্তী পৃথিবীর নতুন অর্থনীতির চালচিত্রের আভাস, তাকে কোনওভাবেই অবরুদ্ধ করে রাখা যাচ্ছে না। পৃথিবীর অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে জি২০-র অন্তর্ভুক্ত সমস্ত দেশই এক ভয়ংকর মন্দার শিকার এবং জিডিপি’র অধোগতি ঋণাত্মক। একমাত্র চীনের অর্থনীতিই সদর্থক বৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করছে।
পৃথিবীর অর্থনীতির নতুন এই প্রবণতার নির্যাস উপলব্ধি করা জরুরি কোভিড পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের স্বার্থেই। লগ্নি পুঁজিবাদের গুরুত্বপূর্ণ মুখপত্র লন্ডনের ফাইনান্সিয়াল টাইমসের ৪এপ্রিলের সম্পাদকীয় মন্তব্যেই তা স্পষ্ট। অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকার অনেক বেশি সক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া এটা অসম্ভব। যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠেনি এবং নয়া উদারবাদের তীক্ষ্ণ বৈষম্য সৃষ্টির প্রবণতা প্রবল এবং অতিধনীদের সম্পদ এবং মুনাফা বৃদ্ধির রেখাচিত্র অব্যাহত। কিন্তু বেশিরভাগ বড় অর্থনীতিতে পুনরুজ্জীবনের প্যাকেজে খুঁটিনাটি থেকেই স্পষ্ট সরকার টাকা ব্যয় করছে কাজ এবং বেতন সুরক্ষিত করার লক্ষ্যেই। যদিও এই প্যাকেজে বেশিরভাগটাই ঋণ দেবার মাধ্যমেই, তবুও গড়ে আনুমানিক জিডিপি’র ৫% সরাসরি ক্যাশ ট্রান্সফার করেছে সরকার। এই পদক্ষেপ নয়া উদারবাদী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর এখানেই মোদীর ভারত সম্পূর্ণ উলটো পথে হাঁটছে। ক্যাশ ট্রান্সফারের পরিমাণ জিডিপি’র মাত্র ১%। সরকার ছাড়া, প্রায় সবাই পূর্ণ ঐকমত্যে যে দেশের অর্থনীতির এই সঙ্কটের উৎস -চাহিদার প্রায় বিলুপ্তি। মানুষের কাজ নেই। মজুরি এবং বেতন হ্রাস পাচ্ছে। ব্লু কলার জবেও পিঙ্ক স্লিপের ছড়াছড়ি। এই সময়েই ১৫ কোটি চাকরি তো গেছেই, আরও ভয়াবহ গত ২ মাসে প্রায় ২ কোটি মাস মাইনের চাকরিজীবী কাজ হারিয়েছেন। আর যাঁরা চাকরি হারাননি, তাঁদেরও বেতনে কোপ পড়ছে। ফলে ক্রয়ক্ষমতা যদি না থাকে কোথা থেকে আসবে বিনিয়োগ? কারণ, বিনিয়োগ যারা করবে তাদের তো পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করতে পারার গ্যারান্টি চাই। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!!
সরকার যে মাত্রায় ব্যয় বাড়ানো দরকার তা কিছুতেই করতে প্রস্তুত না। এটাই বেসরকারিকরণের উন্মাদ অভিযানের ভয়াবহ পটভূমি। এই বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে একটিও নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম— সরকারি আনুকূল্যপুষ্ট কর্পোরেট চাঁইদের হিমালয়সদৃশ মুনাফা, দেশের অধিকাংশকে ঠেলে দিচ্ছে অনাহার আর কর্মহীনতার মহামারীর দিকে।এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা থাকতে পারে! যখন দেশের অর্থনীতি গোঁত্তা খেয়ে পড়ছে ২৪শতাংশ, তখনই পৃথিবীর ধনী তালিকায় ২৪ থেকে ৪-এ উঠে এসেছে মুকেশ আম্বানির নাম। এই দেউলিয়া পথ পরিহার না করলে দেশের আপামর মানুষের পরিত্রাণের কোনও উপায় নেই।
এখন তো সবই ‘ভগবানের হাত’! আসলে দেশ বিদেশের প্রধান পত্রপত্রিকায় প্রবল চর্চা মোদী সরকারের অপদার্থতা নিয়ে। ভারত নিয়ে যে কোনও প্রতিবেদনেই মোদী সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা আর বিশ্লেষণ। গত পঞ্চাশ দিন ধরে নতুন সংক্রমণ নিয়ে ভারত ১ নম্বর। প্রথম দিকে ‘তরুণ ভারতে’ মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম ছিল। কিন্তু এখন সে গুড়েও বালি! গত ১০ দিনে নতুন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হারেও ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রাজিলকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সংক্রমণ মোকাবিলায় মোদী সরকারের এই ব্যর্থতা ছাপিয়ে উঠছে বিধ্বস্ত অর্থনীতির ট্র্যাজেডি। আর সেজন্যই পরিসংখ্যানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ক’জন স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণ হারালেন, ক’জন পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ হারালো অর্থাভাবে,অনাহারে সরকারি পরিবহণের অভাবে, কতগুলো এমএসএমই, যার অনেকটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গেল, তার কোনোটারই হিসাব নেই সরকারের কাছে। আসলে এগুলোই তো সেই জীবন্ত দলিল যা মহামারীর আগে ভারতীয় অর্থনীতি অধোগতির বিবৃতি। ভারতের অর্থনীতির এই দুরবস্থা পৃথিবীর অন্য সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছে তার কারণ মহামারীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
ভারতের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর অনেকটাই অসংগঠিত ক্ষেত্র-নির্ভর। জিডিপি’র ৪৫% আসে এই ক্ষেত্র থেকেই। কর্মসংস্থানে এই অনুপাতটা আরও বেশি- ৬৫%। নোটবন্দি আর জিএসটি ভারতের অর্থনীতির বিশেষ করে, তার অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোমর ভেঙে দিয়েছে। নির্লজ্জ প্রধানমন্ত্রী একবারের জন্যেও নোটবন্দি নিয়ে তাঁর বাগাড়ম্বরের কথা উচ্চারণ করেননি। কালোটাকা, সন্ত্রাসবাদ, নকল নোট নির্মূল করার লক্ষ্য ৫০ দিন কেন গত চার বছরের ১৫০০ দিনেও অর্জিত হয়নি বরং অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনেকটাই কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে।
আর জিএসটি ! গত এক বছরে রাজ্যগুলোকে ফেরত দেওয়ার জন্যে ৩ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৬৫ হাজার কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। এখন সাংবিধানিক এবং আইনি দায়বদ্ধতা সম্পর্কে চোখ উলটে দিয়ে মোদী সরকার ঘোষণা করছে যে রাজ্য সরকারগুলিকে সেই প্রাপ্য টাকা দেওয়া যাবে না। রাজ্য সরকারগুলিকে পঙ্গু করবার নির্লজ্জ ইতিবৃত্তের কোনও সমান্তরাল ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আগে কখনো ঘটেনি।
এটাই ঐতিহাসিক কৃষি সংস্কারের আবহ। অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে আপাত আলোর রেখা ছিল কৃষিক্ষেত্রে ৩.২% বৃদ্ধি। কিন্তু এই সংখ্যাতত্ত্ব কৃষকদের করুণ অবস্থার কথা বিবৃত করে না। অনেক ঢক্কানিনাদে ঘোষণা হয়েছিল কৃষকদের আয় দ্বিগুণ হবে। কিন্তু বাস্তব রূঢ়। ভয়ের চোটে সরকার হিসাব না দিলেও অবস্থা কতোখানি ভয়াবহ তা স্পষ্ট হয়েছে কৃষকদের আত্মহত্যার হার দ্বিগুণ হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
ঐতিহাসিক সংস্কারের মর্মবস্তু কি?
সরকার মহামারীতে তালাবন্দির সুযোগ নিয়ে তিনটি অর্ডিন্যান্স পাশ করে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসংক্রান্ত আইন, কৃষি বাজার ও বিপণন সংক্রান্ত আইন এবং কৃষি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের আইন।বিরোধীদের আলোচনা করবার সুযোগ না দিয়ে, বিলের বিরোধিতা করবার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং বিরোধীশূন্য সদনে, লজ্জাশরম বাদ দিয়ে পাশ করিয়ে নিয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের সলিল সমাধিও বলা চলে। কি আছে এই তিনটে বিলে। পণ্য আইনের সংশোধনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে ডাল, ভোজ্যতেল, আলু, পিঁয়াজ বাদ। আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মজুত করার যে ঊর্ধ্বসীমা ছিল তা সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা হয়েছে। যে সমস্ত সংস্থা এই পণ্যগুলি রপ্তানি করবে তাদের উপরও কোনও রকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ আর থাকবে না। সাধারণভাবে প্রতিক্রিয়া হলো, আসলে এটা প্রকৃত অর্থেই মজুতদারি ও কালোবাজারি করবার জন্যে কর্পোরেট সংস্থাগুলির ছাড়পত্র। ‘স্বাধীনতা’, আসলে কর্পোরেটদেরই। অনেক গালভরা নাম দেওয়া হলেও কৃষিপণ্যের মূল্য সংক্রান্ত আইনের মূল নির্যাস চুক্তি চাষকে অবাধ এবং সর্বজনীন স্বীকৃতি দেওয়া। ভারতের প্রায় ৮০% কৃষকই ছোট এবং প্রান্তিক। গড় জোতের পরিমাণ ১ থেকে ২একরের মধ্যে। মোদী জোর গলায় চিল্লিয়ে যাচ্ছে এই চুক্তিতে চাষ করাটাই কৃষকের স্বাধীনতা এবং পণ্য বিক্রি করবার গ্যারান্টি। রসিকতা কতো নির্মম হতে পারে তা দেশের অন্য প্রান্তের মানুষের তুলনায় বাংলার মানুষ ভালো করেই জানেন। দীনবন্ধু মিত্রের অবিস্মরণীয় নাটক ‘নীল দর্পণ’ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের ব্যবস্থাপনায় কিভাবে নীলকর সাহেবদের নিষ্ঠুর শোষণের শিকার হতে বাধ্য করেছিল বাংলার কৃষককে, তার স্মৃতি জীবন্ত। চুক্তি চাষ অসম দরকষাকষিতে কৃষককে বাধ্য করে কম দামে ফসল বিক্রি করতে।এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বর্ধমানের আলু চাষিদের হয়েছে। চালু বাজার দরের তুলনায় কমদরে পেপসি কোম্পানির জন্যে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে তারা। এটাই কন্যাকুমারীর কৃষকের কাশ্মীরে তাদের ফসল বেচবার ‘স্বাধীনতা’ বলে জাহির করছে মোদী ! আসলে স্বাধীন কৃষিজীবী থেকে এগ্রি-বিজনেসের নাগপাশে কৃষি মজুরের পরিণত হওয়াটাই এই ‘স্বাধীনতা’র মর্মন্তুদ ইতিবৃত্ত। আর একই ধরনের বাগাড়ম্বরসম্পন্ন শীর্ষক সত্ত্বেও কৃষি বাজার ও বিপণন সংক্রান্ত আইনের নিশানা আসলে সরকারের এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেটিং কমিটি), পরিচালিত মান্ডিগুলি। এই মান্ডিগুলি কৃষি উৎপাদনকারীদের দাম আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। ষাটের দশকের শেষ দিকে শুরু হলেও এই মান্ডিগুলির উপস্থিতির ক্ষেত্রে ঘটেছে অসম বিস্তার। স্বামীনাথন কমিটি সুপারিশ করেছিল যে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কৃষকদের এই ধরনের বাজারের সুযোগ দিতে হবে।কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যাটা তার অনেক কম। বাস্তবে এই ধরনের বাজারগুলির নিবিড়তা পাঞ্জাব আর হরিয়ানা। এপিএমসি বাজারগুলি রাজ্য সরকারগুলির আইনি নিয়ন্ত্রণাধীন। সুতরাং এগুলির নির্মাণ, বিকাশ ও তার বিস্তারও আলাদা আলাদা রাজ্যের কৃষি পরিস্থিতি এবং রাজ্য সরকারগুলির সিদ্ধান্ত সাপেক্ষ। ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকার এপিএমসি আইনের সংস্কারের একটি খসড়া মডেল রাজ্য সরকারগুলির কাছে পাঠিয়ে দেয়। অধিকাংশ রাজ্যে এগুলি কার্যকর হয়নি। বিরোধী রাজ্য সরকারের কথা তো বাদ দিলেও বিজেপি পরিচালিত অধিকাংশ রাজ্য সরকারও এই সংস্কার কার্যকর করেনি। এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এপিএমসি বাজারগুলি পরিচালনার ক্ষেত্রে ত্রুটি দুর্বলতা রয়েছে। রয়েছে এগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনও। এখন আইনের পরিবর্তনে এগুলির মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করে দেওয়া হলো। এখন এপিএমসি বাজারের বাইরে বেসরকারি সংস্থা নিজস্ব বাজার চালাতে পারবে। এছাড়া বেসরকারি ই-কমার্সেরও ছাড়পত্র দেওয়া হলো। সবচেয়ে বড় কথা এপিএমসি বাজারগুলিকে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দেওয়া হলো। যে সমস্ত লাইসেন্স এবং ফি দিতে হয় বেসরকারি বাজারগুলিকে তা দিতে হবে না। এর ফলে প্রাথমিকভাবে কিছুটা বাড়তি সুযোগ দিয়ে বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাগুলি কৃষক উৎপাদনকারীদের এপিএমসি বাজারের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবার জমিও প্রস্তুত করে দেওয়া হলো। ফলে এপিএমসি বাজারগুলির যে কালক্রমে অবলুপ্তি ঘটবে, তা বলাই বাহুল্য। কৃষি স্পষ্টতই সংবিধানের রাজ্য তালিকাভুক্ত। কৃষিপণ্যের আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের অজুহাতকে খাড়া করে যে আইন পাশ হচ্ছে, তা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূলেই কুঠারাঘাত!
‘স্বাধীনতা’ কার: কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
মোদীর চোখে এখন স্বাধীনতার ঘোর! নোটবন্দির সময় নগদ টাকার বদলে ডিজিটাল অর্থনীতির ‘স্বাধীনতা’ দিতে গিয়ে ল্যাজেগোবরে হয়েছে! কর দেওয়া নেওয়ার ‘স্বাধীনতা’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জিএসটি ঘটিয়ে দিয়েছে মারাত্মক বিপর্যয়। আর রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রের থেকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রকে ‘স্বাধীনতা’ দিতে গিয়ে ঘোষণা হয়েছে ১৯৪৭এর ১৫ আগস্ট নয়, ২০২০র ৫ আগস্টই সাচ্চা স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণ। আসলে মূল প্রশ্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে; নয়া উদারবাদী শ্রেণি আগ্রাসনে। দেশে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন কোন পথে হবে ? দেশের অধিকাংশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কি এই পুনরুজ্জীবন সম্ভব? জনস্বার্থ না মুনাফা, কোনটায় অগ্রাধিকার ?
গত ছ’বছরের অভিজ্ঞতায় নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়, আপাত অবিশ্বাস্য পদক্ষেপগুলির পিছনেও একটি সুনির্দিষ্ট নীতিগত অভিমুখ কাজ করে চলেছে। দেশে বিশাল অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ধ্বংস করেই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর সংগঠিত কর্পোরেটদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ করাই থেকেছে মোদী সরকারের নীতিগত পরিপ্রেক্ষিত। বাণিজ্য, শিল্প, স্বাস্থ্য আর একেবারে সাম্প্রতিক শিক্ষার পরে নবতম উদ্যোগ কৃষিক্ষেত্রকে ঘিরে। এটাই ঐতিহাসিক কৃষি সংস্কারের মর্মবস্তু। মোদীর স্বাধীনতার রণধ্বনি আসলে কৃষকদের নয়—কর্পোরেট সংস্থাগুলির অবাধ লুণ্ঠনের স্বাধীনতা। এই তিনটে আইন বৃহদাংশের অসংগঠিত কৃষিজীবী নির্ভর কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেট শোষণ— মুনাফাকে স্বাধীনতা দেবার ‘ঐতিহাসিক উদ্যোগ’! মোদী বলছে, কৃষিক্ষেত্রকে দালালমুক্ত করা হলো। এই যখন পরিপ্রেক্ষিত, কৃষক বনাম কর্পোরেটের সংঘাতে, সরকারই যখন কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় প্রধান দালাল, তখন অন্য দালালের প্রয়োজন কি! কিন্তু মুশকিল অন্য জায়গায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বড় এগ্রিবিজনেস সরকারের বিপুল ভর্তুকির দাক্ষিণ্যে পরিচালিত হয়; তার সঙ্গে ভারতের একশো তিরিশ কোটি জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলনাই করা যায় না। দ্বিতীয়ত, জিডিপিতে মাত্র ১৫% অবদান সত্ত্বেও এখনও জনসংখ্যার ৫৫% কৃষিনির্ভর কর্মসংস্থান, টিকে থাকা। তিনটি বিলের মধ্যে কৃষি অর্থনীতির সামগ্রিক অধিগ্রহণ, এই টিকে থাকার পূর্বশর্তটিকেই ছত্রখান করে দেবে। মোদী সরকারের পূর্বানুমান এতে বেসরকারি বিনিয়োগ হবে। এটা অসম্ভব। আদানিগোষ্ঠী, যাদের ইতিমধ্যেই কৃষিপণ্যের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে বা আম্বানি গোষ্ঠী যাদের সংগঠিত ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রবল উপস্থিতি তাদের লাভ নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু কোটি কোটি কৃষকের জন্যে এই সংস্কার আদতে সর্বনাশের ঠিকানা!
২০০৬ সালে বিহারে এপিএমসি বাজারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দেওয়া হয়। এবছরের হিসাব বিহারের চাষি দেশের মধ্যে সবচেয়ে কমদামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে, সেই স্বাধীনতারই বিয়োগান্ত পরিণতি এটা। ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের ফড়নবিশ সরকার এখন যে আইনি পরিবর্তন হলো, সেই পথেই এপিএমসি আইন সংশোধন করে। কিন্তু এরফলে বেসরকারি বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেনি। এ বছরের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও কেন্দ্রের বর্তমান আইনগুলির অভিমুখ অনুসারে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু কৃষকদের দুরবস্থার কোনও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে? আর এমএসপি’র প্রশ্ন। ন্যূনতম সহায়ক দাম। স্বামীনাথন কমিটি বলেছিল এমএসপি হবে উৎপাদন খরচের উপর আরও পঞ্চাশ শতাংশ। নির্লজ্জের মতো মোদী বলছে এই সুপারিশকে বাক্সবন্দি করে রেখেছিল আগের সরকার। কিন্তু বাস্তব, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিমকোর্টের কাছে হলফনামা দিয়ে তারাই বলেছিল, এই সুপারিশ কার্যকরী করা অসম্ভব। আর বাস্তব এটাই দুতিন দিন আগে যে এমএসপি ঘোষিত হলো, সেখানে একাধিক পণ্যের ক্ষেত্রে সদ্য ঘোষিত এমএসপি স্বামীনাথন ফর্মুলার থেকে ২০-২৫% কম। আসলে এমএসপি ঘোষণা মানেই কৃষকদের ওই ঘোষিত দাম পাওয়া নয়। কৃষকরা ফসলের দাম কি পাবে, সেটা নির্ভর করে সরকারি সংস্থা এমএসপিকে গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রহ করছে কিনা। এই তিনটি আইন মিলিয়ে যেহেতু রেশন ব্যবস্থা এবং কৃষি-কৃষক মান্ডি সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে গেল, সুতরাং এমএসপি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল না হলেও কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে, এটা বলাই বাহুল্য। মূল প্রশ্ন ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এবং হস্তক্ষেপ। এখানেও বিকল্প কেরালার অভিজ্ঞতা। এপিএমসি অ্যাক্ট না থাকলেও সরকার রাজ্যজুড়ে বাজার ও বাজারের পরিকাঠামো গড়ে তুলছে। আর শক্তিশালী রেশন ব্যবস্থা আর বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে খাদ্যসরবারহ যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সরকার ফসল কিনছে। আর তাই কেরালার কৃষক ধানের দাম পেয়েছে কুইন্টাল প্রতি ২৭০০ টাকা। আর বিহারের কৃষক ৮০০-১১০০ টাকা। মোদীর প্রচারে পর তাই দেশের কৃষকের হাতে পেনসিল ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকবে না, আদানি-আম্বানির সীমাহীন সম্পত্তি বৃদ্ধির সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হবে।
জোট বাঁধো - তৈরি হও
মোদী আর তার পোষিত গদি মিডিয়া বা বিজেপি’র আইটি সেল হিসাবটাই ধরতে পারছে না। বিক্ষোভটা পাঞ্জাব বা হরিয়ানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; সঙ্কটের আবর্তে ক্ষত বিক্ষত ভারতের কৃষক। কর্পোরেট স্বার্থে দালালির জন্যে যে স্বাধীনতা আদানি-আম্বানিরা পাবে এর মধ্যে কৃষকের মুক্তির কোনও গল্প নেই। যে দ্রুততায় সংসদীয় ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আইন পাশ করা হলো, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হবেই। গ্রামে গঞ্জে রাজপথে দুশোরও বেশি কৃষক সংগঠনের গড়ে উঠেছে সংগ্রামের ব্যাপকতম মঞ্চ সারা ভারত কৃষক সমন্বয় সমিতি। নবপর্যায়ে এই ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত হতে চলেছে ২৫সেপ্টেম্বর। পথেই হবে এ পথ চেনা। গ্রামে গ্রামে আওয়াজ উঠুক জোট বাঁধো- তৈরি হও।