তুমি জিন্দা হয়ে উঠেছ মইদুল
-
ঈশান লাল
- Mar 04, 2021 13:00 [IST]
- Last Update: Mar 04, 2021 12:50 [IST]
আমি তোমার জন্য কোনও গদ্য লিখিনি, পনেরো তারিখের পর।
কী করে লিখব !
আমি তোমাকে নিয়ে, তোমার শাহাদাত নিয়ে কোনও গদ্য লেখার জন্য নিজেকে যোগ্য মনে করিনি।
আমি এগারো তারিখ সকাল সাড়ে সাতটা অবধি দিব্যি ঘুমিয়েছিলাম। তোমার মতো কাকভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়িনি সন্তানের প্রিয়মুখ ঘুমন্ত পিছনে ফেলে রেখে।
স্লোগানে স্লোগানে চিরে যায়নি আমার গলা। সারাদিন শান্ত সুভদ্র গলায় আমি সেদিন সারা আলো বেলায় আঁধার বেলায় ঘর গেরস্থালির, আপিস কাছারির ব্যবসা বিপণির দরকারি অ-দরকারি নানা টুকরো কথাই বলেছিলাম।
আমি রাষ্ট্র ও ক্ষমতাতন্ত্রের পেতে রাখা চক্রব্যূহের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াইনি...ব্লিচিং দেওয়া জলকামানের তোড় কি করে সারা শরীরে দাহ হেনে দেয়; কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ছিঁড়ে ফেলতে চায় চোখের রক্তজালিকাগুলি; উদ্যত লাঠি ভারী বুটের মুখে কি করে সহসা ভকভক করে ওঠে আমাদের কলজে পাকস্থলী ঘেঁচে দেওয়ার জিঘাংসা, সেকথা ভুলেছি হয়তো বেশ কিছুদিন; হেলমেট পরা রাষ্ট্রপোষ্য সান্ত্রী কোনও মুহূর্তে সহসা জহ্লাদ হয়ে উঠতে চায়, তার উঁচিয়ে তোলা লাঠির মাথায় হঠাৎ হিল হিল করে ওঠে মৃত্যু, তুমি আর তোমার হাজার তিরিশেক বন্ধু দেখেছিলে সেদিন। আমি দেখিনি।
কোন অধিকারে লিখব তোমার জন্যে, তোমার পাকপবিত্র শহীদ শরীরের জন্য গদ্য !
তবু লিখতে ইচ্ছে করছিল, বিশ্বাস করো, তবু লিখতে ইচ্ছে করছিল, কেউ কেউ যখন হাহুতাশ করছিল— চাকরি চাইতে এসে একজন জলজ্যান্ত ছেলে লাঠির বাড়ি খেয়ে মরে গেল!
বলতে ইচ্ছে করছিল, গলা ফেড়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, ভুল হচ্ছে, কোথাও ভাবতে ভুল হচ্ছে !বাংলার বামপন্থী ছাত্র-যুবরা নিজের জন্যে চাকরি চেয়ে গলা ফাটায় না, পথে নামে না। তাদের দাবি বাংলার সমগ্র যৌবনের জন্যে। তাদের রক্ত ঝরানো বাংলার প্রসারিত শান্তির জন্যে। তাদের মরণ বাংলার আবহমান জীবনের জন্যে।
কোতুলপুরের মইদুল কলকাতায় এসেছিল, সহযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছিল, মারের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল নিজের জন্যে চাইতে নয়, বাংলার সমগ্র যৌবনের জন্যে অধিকার আদায় করে নিতে।
তুমি যেদিন শহীদ হলে, সেদিন জেনেছিলাম তোমার একটা ভারী সুন্দর ডাকনাম আছে—ফরিদ।
হঠাৎ মনে পড়ল, পাঞ্জাবের সেই পরম শ্রদ্ধেয় সুফি সাধকের কথা—শেখ ফরিদ আদ-দিন গাঞ্জ-ই শাকর। শতদ্রুর দক্ষিণ তীরে তাঁর মাজার। প্রয়াত হয়েছিলেন ১২৬৫ সালে, পাঞ্জাবের মানুষের কাছে তিনি বাবা ফরিদ।
শাসকের কাছে কোনোদিন নিজের জন্যে তিনি কিছু চাননি হাত পেতে। কঠোর ত্যাগমণ্ডিত জীবন যাপনেই তাঁর যাবতীয় খ্যাতি। তাঁর জীবৎকালে, তাঁর প্রয়াণের পর
দিল্লির সুলতানি শাসক থেকে মুঘল সম্রাটরা তাঁর মাজারে এসে নতজানু হয়ে বসতেন শাসক পদের যোগ্য হয়ে ওঠবার জন্যে। ইবন বতুতার লেখা থেকে জানা যায় বাবা ফরিদের মাজারের মহাকথা ছড়িয়ে পড়েছিল নাকি সেই আলেকজান্দ্রিয়া অবধি। শাসক লেখক পর্যটক সেই মাজারে এসে নতজানু হয়ে বসতেন তার কাজের যোগ্য হয়ে ওঠবার জন্যে।
আমি তোমার জন্যে কোনও গদ্য লিখিনি ফরিদ। ব্রিগেডের মাঠে, মানুষের ময়দানে গিয়ে দাঁড়ালাম মাঝ ফাল্গুনের দুপুরে, মনে হলো এই বার, এখনই তোমার জন্যে গদ্য লেখা যায়, তোমার জন্যে গদ্য লেখার যোগ্য হয়ে উঠলাম এবার।
মনে পড়ে গেল, ১৪৭৬ সালে জার্মানির প্রথম কৃষক বিদ্রোহের নেতা বাঁশিওয়ালা হান্স দেশের খেটে খাওয়া মানুষকে ডেকে নিয়েছিলেন নিকলাসাউসেনের তীর্থক্ষেত্রে ম্যাডোনার পায়ের কাছে। আগে তীর্থে সমবেত হও, তারপর লড়াইয়ের শপথ, শপথের পর জানকবুল লড়াই। এ ইতিহাস শুনিয়েছিলেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস।
ব্রিগেড সেই তীর্থক্ষেত্র, মানবতীর্থ।
খবরওয়ালাদের কথার মারকাটারি, ক্ষমতার রাজনীতির খেলুড়েদের হিসাব-নিকেশের মারপ্যাঁচ—ধুর, এরা কখনো আমাদের ব্রিগেড দেখেছে নাকি! লাল টুকটুকে শাড়িতে এসেছেন মা, বাবার হাত ধরে রাঙা জামা পরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে কচি ছেলেটি, যেন উড়তে চাওয়া তিতির। দাড়িতে মেহেন্দি করা বাবা, বালুচরি হিজাব পরা মায়ের হাত-ধরা ছেলেটার আর হাতে লাল টুকটুকে নিশান দুলছে রোদে। প্রৌঢ়ের পাশে বসে মঞ্চের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছেন প্রৌঢ়া।
ব্রিগেড বারংবারের বাঙালি তীর্থ। তীর্থভূমির বাড়া। শপথতীর্থ।
আমি কি গদ্য লিখব ফরিদ, তাকিয়ে দেখি সারা ব্রিগেড তোমার জন্যে গদ্য লিখছে জানমন এক করে। দুপুর বারোটা নাগাদ জীবনদীপ ভবনের সামনের ফুটপাতে পাত পড়ছে সারসার। ভাতের গন্ধ মিশে যাচ্ছে লাল শালুর মাড়ের আঘ্রাণের সঙ্গে। বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ পলিপ্যাকের মধ্যে রাখা মুড়িতে জল ঢেলে সিদ্ধ আলু মাখছেন গাঁ-ঘর থেকে আসা মায়ের মতো নারী। ব্রিগেডে আসা প্রতিটি ক্ষুধার অন্নদানা অক্ষর, প্রতিটি অন্নের ওয়াদা অক্ষর, প্রতি মস্তিষ্ক ও হৃদয় অক্ষর, উত্তোলিত প্রতিটি বাহু ও শিরদাঁড়া অক্ষর ও যতিচিহ্ন। সকল অক্ষর মিলে লিখছে শহীদের জন্য গদ্য, শপথের জন্য গদ্য।
এক ঝাঁক নবীন হাঁটছে রোদের দিকে মুখ করে। পিঠে লেখা তোমার নাম মইদুল। কাঁধের নিশানে চে-র মুখপট। এত নবীন মুখ একসঙ্গে কখনো দেখেনি ব্রিগেড। এত অগণন চে-র মুখ কখনো দেখেনি ব্রিগেড।
জোটের অঙ্ক ভোটের অঙ্ক সামনের দু-মাস আমরা লড়াইয়ের ময়দানেই কষে নেব, কূট তর্কের তুফানে নয়। আপাতত একটি অঙ্কমাত্র উচ্চারণ করে নেওয়া যাক—একজন চে যেমন মানুষের মুক্তির জন্যে হাজার বছরের লড়াই নিশ্চিত করে যান, এবারের ব্রিগেডে চে-র মুখনিশান কাঁধে নেওয়া, চে-র মুখপট বুকে নেওয়া লাখো তারুণ্য আগামী অন্তত আধখানা শতকের জন্য এ রাজ্যে এ দেশে বামপন্থীদের জন্যে লড়াইয়ের সেনানী নিশ্চিত করে গেল। জিন্দা করে দিয়ে গেল এই প্রত্যয়, লড়াই জারি ছিল, জারি থাকবে আরও জোরদার হয়ে।
ফ্যাসিস্তদের হাতে ৮৭২ দিন অবরুদ্ধ ছিল লেনিনগ্রাদ। শ্লিসেলবার্গ পার করে দিনরাত লড়াইয়ে থাকা এক নবীন লালফৌজি চিঠি লিখছিলেন তাঁর প্রিয়তমাকে: আমরা এখন ওরেশেক দ্বীপদুর্গের জন্যে গোলাবারুদ সরবরাহ করছি। ২০০ মিটার দূরে লাদোগা হ্রদের পাড় থেকে প্রবল জার্মান শেলিং সত্ত্বেও আমাদের সেনানীদের একটা ছোট দল দুর্গ ওরেশেক রক্ষা করে চলেছে সেই সেপ্টেম্বর থেকে। ওরেশেকের কথা তোমার মনে আছে তানিয়া! ওখানে লেনিনের দাদা আলেক্সান্দারের ফাঁসি হয়েছিল ১৮৮৭ সালে।
আসলে এই নবীন লালফৌজি, যাঁর নামও ছিল আলেক্সান্দার, সে তার প্রেয়সীকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাশিয়ায় নতুন নতুন বীরের জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন।
আমাদের রাজ্য এই মুহূর্তে অবরুদ্ধ অসহ্য কুশাসন আর ফ্যাসিস্ত লোভের আগ্রাসনে। লুটেরা মাতাল পরজীবী আর ধর্মবেসাতির দুই দল ঘর বদলাবদলি করে খেলে যাচ্ছে যেন অলীক কুনাট্য। এদের রুখে দিতে দুই সীমান্তেই মরণপণ লড়াই।
যে আপনি ওই দুটোকেই সমান ঘেন্না করেন; যে আপনি এই দলবদলু ঘরবদলুদের দেখে মুচকি হাসছেন বমনের ইচ্ছায়; যে আপনি শিউরে উঠে ভাবছিলেন পথের উপর একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে লাঠিপেটা করে মেরেই ফেলল, এরা কী মানুষ! যে আপনি দেখছেন পোড় খাওয়া লড়াকুদের পাশে নির্ভীক এগিয়ে আসছে নবীন প্রাণ—সেই আপনি সকল দোলাচল দূর করে আগামী দু-মাস আমাদের সঙ্গে থাকুন।
শপথের ময়দান পার হয়ে সামনে সাহসের দিনকাল।