শিক্ষায় পিপিপি মডেলের নামে কী হতে চলেছে?
-
সুকুমার পাইন
- Feb 22, 2022 18:00 [IST]
- Last Update: Feb 22, 2022 17:56 [IST]
১৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলির শিক্ষা ব্যবস্থা সরাসরি বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চলেছে। শুধু নতুন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি তৈরি নয়, সরকারি শিক্ষাসংস্থানগুলির পঠন-পাঠন আর সেগুলির পরিচালনাতেও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা চলতি কথায় পিপিপি মডেলের কথা বলা হয়েছে। কীভাবে তা করা হবে, তা নিয়ে সরকারের অন্দরমহলে আলোচনা হয়েছে, তার রূপরেখা তৈরিও হয়েছে, যদিও প্রকাশ্যে কোনও নির্দেশিকা জারি হয়নি, মানে এখনও হয়নি।
খসড়া তৈরি হয়ে গেছে
এই পিপিপি মডেলের খসড়া নীতির নাম দেওয়া হয়েছে; ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পলিসিজ অ্যান্ড গাইডলাইনজ ফর সেটিং আপ স্কুলজ ইন পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ (পিপিপি) মোড, ২০২২’। চালু হোক বা না হোক, অনেক আগেই স্কুল শিক্ষা দপ্তর এই নীতির সাত পাতার খসড়া গাইডলাইন তৈরি করে পাঠিয়েছে শিক্ষা দপ্তরের বিভিন্ন বিভাগে; আবার পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর, কারিগরি শিক্ষা, নগরোন্নয়ন দপ্তর, কলকাতা কর্পোরেশন, সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের প্রধান সচিবদের কাছে এই খসড়া পাঠিয়ে তাদের মতামত চেয়ে পাঠিয়েছে। মতামত দেবার সময়সীমা ছিল ৩১ জানুয়ারি; কিন্তু তার আগেই রাজ্যের ওইসব দপ্তরের মতামত পৌঁছে গেছে শিক্ষা দপ্তরে।
পাবলিক-প্রাইভেট উদ্যোগ বা যে নামেই ডাকা হোক, আসলে বেসরকারিকরণই।
কীভাবে হস্তান্তর হবে?
সরকারি শিক্ষাঙ্গনের জমি, বিল্ডিং সহ অন্যান্য পরিকাঠামো তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা ‘মিলিয়ে দেবার’ কথা বলা হচ্ছে, কী পরিমাণে মেলানো? জমি, বাড়ি, পরিকাঠামো আর ‘অন্যান্য সুবিধাদি। প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘অন্যান্য সুবিধাদি’ কী কী?
এই হস্তান্তরের জন্য সময়ে সময়ে (মানে সম্ভবত যখন যে সংখ্যায় স্কুলবাড়ি পাওয়া যাবে)। সরকার পিপিপি মডেলে স্কুল তৈরির জন্য প্রস্তাব চেয়ে নোটিস (রিকোয়েস্ট ফর প্রোপোজাল) দেবে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা সেই অনুসারে প্রস্তাব দেবে। কারা হবে এই বিনিয়োগকারীরা? একক ব্যক্তি উদ্যোগপতি, কোনও কোম্পানি, সোসাইটি, ট্রাস্ট, ফার্ম, কনসর্টিয়াম— এককথায় যে কোনও বেসরকারি পুঁজিপতি এই ‘‘বিডে’’ অংশ নিতে পারবে। সরকারি স্কুলের জমি ও বাড়ি কাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে তা ঠিক হবে সংস্থার শিক্ষাজগতে কাজের গুণগত মান (মোট বিচারযোগ্য শর্তের ৮০ শতাংশ, মূলত প্রযুক্তিগত দক্ষতা) ও আর্থিক ক্ষমতা (মোট বিচারযোগ্য শর্তের ২০ শতাংশ) বিচার করে। সংস্থা নির্বাচন হবে ‘‘সার্বিক স্বচ্ছতা’’ বজায় রেখে।
দুঃখিত। টেট সহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার চেহারা দেখে এই ভরসা রাখা যাচ্ছে না।
হস্তান্তর হবার পরে কীভাবে ব্যবস্থাটা চলবে?
স্কুল পরিচালনার গোটা দায়িত্বই আগামীদিনে তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি সংস্থার হাতে। পরিচালনা করবেন কারা? একটি পরিচালন কমিটি বা গভর্নিং বোর্ড তৈরি হবে, সেখানে অবশ্য ‘‘উপযুক্ত সংখ্যায়’’ সরকারি প্রতিনিধি থাকবেন। স্পষ্ট বলা হয়নি সেখানে তাঁরা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকবেন কিনা। তবে পরের বক্তব্যগুলিতে তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। হেডমাস্টারের পদ (শিক্ষামূলক এবং প্রশাসনিক) পালটে ডিরেক্টর বা প্রিন্সিপাল পদ (মূলত প্রশাসনিক) পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে— এর প্রয়োজন কী তা স্পষ্ট নয়। নিয়ন্ত্রণ লাগামছাড়া তুলে দেবার কথা আরও আছে।
পড়াশোনা কী হবে?
বেসরকারি সংস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে পঠন-পাঠনের মাধ্যম ও স্বীকৃতিদাতা বোর্ড নির্বাচনের, এবং ছাত্রসংখ্যা নির্ধারণের।
স্কুলে বাংলা না ইংরেজি কোন মাধ্যমে পাঠদান হবে তা ঠিক করবে ওই বেসরকারি সংস্থাই। এমনকি কোন বোর্ডের অধীনে পাঠদান চলবে কোন সিলেবাসে পড়াশোনা হবে সেটাও ঠিক করার পূর্ণ দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে বিনিয়োগকারীদের ওপরই।
ছাত্রদের মাইনে চালু হচ্ছে। বেসরকারি হাতে যাওয়া স্কুলের পড়ুয়াদের মাসমাইনে ঠিক করবে বিনিয়োগকারী সংস্থাই। তাদের হাতেই সেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে। ফল? শিক্ষা আর অবৈতনিক, মৌলিক অধিকার থাকছে না। অর্থের বিনিময়ে স্কুলে শিক্ষাদান শুরু হবে; দরিদ্র মেধাবি পড়ুয়া সুযোগ পাবে না, অর্থবান পরিবারের পড়ুয়ারা স্কুলে পড়বে।
শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী কীভাবে নিযুক্ত হবেন, কী শর্তে আর কী পারিতোষিকে তাঁরা কাজ করবেন? কারা হবেন এই পিপিপি মডেলের স্কুলের শিক্ষক?
শিক্ষক/শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পদ্ধতির স্বাধীনতা থাকবে বেসরকারি সংস্থার। নির্বাচন পদ্ধতি, চাকরির নিয়মাবলি, সুবিধাদি, বেতনক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অবসরকালীন সুবিধাদি নির্ধারণে বেসরকারি সংস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে; এ বিষয়ে কোনও সাধারণ নিয়ম তাদের মেনে চলার দরকার নেই । স্কুলে কত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ হবে তার সংখ্যাও ঠিক করার দায়িত্ব ওই বিনিয়োগকারীদেরই।
এর অর্থ সুদূরপ্রসারী।
প্রথমত, এতাবৎকাল সেই বামফ্রন্টের আমল থেকেই এরাজ্যে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী এমনকি প্রধান শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব স্কুল সার্ভিস কমিশনের। বাম আমলে দুর্নীতি ছিল না, এ আমলে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, তবু সরকারি নিয়ম মেনে সরকারি সুযোগসুবিধা সহ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিযুক্ত হবার সুযোগ রয়েছে। এবারে সরকার সেই ব্যবস্থাটাকেই গুটিয়ে ফেলতে চাইছে, ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব থেকেও হাত তুলে নিতে চাইছে সরকার। স্কুল চালাতে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য নিয়োগের দায়িত্ব পালন করবে বেসরকারি সংস্থাই।
দ্বিতীয়ত, এরপর যৎসামান্য পারিশ্রমিকে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের বাধ্য করা হবে শিক্ষাদানে, আনুষঙ্গিক দায়িত্ব পালনে। ইতিমধ্যে বেসরকারি স্কুলগুলিতে যা ঘটছে, তার অনুসরণেই না শিক্ষক না শিক্ষাকর্মী কোনও নিয়োগেই নির্ধারিত কোনও ন্যূনতম যোগ্যতা বিচার করা হবে না। তেমনই, তাঁদের কারোরই থাকবে না কোনও ফিক্সড ডিউটি, যাকে যখন যে ক্লাসে যা পড়াতে বলা হবে তাই করতে হবে, শিক্ষাদান বাদেও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে তাঁরা বাধ্য থাকবেন; কোনও নির্ধারিত ডিউটি আওয়ার থাকবে না। থাকবে না পে স্কেল, থাকবে না বেসিক ডিএ এইচআরএআদি সুবিধা, থাকবে না পেনশন বা সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো সামাজিক সুরক্ষা। আর? যোগ্যতার বিচার হবে মুখ বুজে স্কুলের তথা বসের ডিউটি পালন, শারীরিক সক্ষমতা, সহকর্মীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, আপনার রাজনৈতিক অবস্থান এগুলোর নিরিখে। না হলে চাকরিটাই থাকবে না।
গৌরী সেনের কথা
স্কুল চালাবার টাকা কে দেবে বা কোথা থেকে আসবে? এটা বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন; কারণ পুরো পিপিপি মডেলটাই ভিত্তি করে রয়েছে মুনাফার ওপরে। কী বলছে খসড়া নীতি?
পিপিপি মডেলে স্কুল পরিচালনার আর্থিক সকল দায়— জমি, বাড়ি, পরিকাঠামো এবং ‘ছাড়’— সবটাই রাজ্য সরকারের। শুধু রিকারেন্ট আর নন রিকারেন্ট ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ আর সম্প্রসারণের দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার।
কোটি কোটি টাকা মূল্যের জমি, স্কুলের বাড়ি সরকার বেসরকারি সংস্থাকে দেবে বিনামূল্যে। ‘ছাড়’ দেবে— কী ছাড় তা স্পষ্ট করে বলা নেই। কেন? যারা ওই পরিকাঠামো ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটবে তাদের কিসের ছাড়?
রিকারেন্ট খরচ মানে মাইনে, রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ, রেজিস্ট্রেশন আর পরীক্ষার ফিজ, নন রিকারেন্ট খরচ হলো সম্প্রসারণ, পরিকাঠামোর উন্নয়ন এইসব— এসবই তো আসবে ছাত্রদের মাইনে থেকে, মাছেরই তেলে মাছ ভাজা হবে। কার দায়িত্ব?
আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন— যা কিছু সরকার বেসরকারি হাতে দিতে চলেছে সেইসব জমি/বাড়ির মালিকানা কার? তথাকথিত সরকার পোষিত স্কুলগুলি যা আগে এবং এখনও আসলে অনুদানপ্রাপ্ত স্কুল (নামটাই শুধু পালটেছে), তা এ রাজ্যে এককালে তৈরি হয়েছিল কিছু অর্থবান ব্যক্তির বদান্যতায় বা স্থানীয় শিক্ষাপ্রেমী মানুষদের যৌথ উদ্যোগে; সেই সব স্কুলের জমি বাড়ির মালিকানা দলিল করে পরিচালন সমিতিকে দেওয়া হতো। কী আইনি প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের সে মালিকানা সরকারে ন্যস্ত হয়েছে? কীভাবে সরকার তা নিজের সিদ্ধান্তে বেসরকারি হাতে দিতে চলেছে?
অজুহাত সরকার কী দিচ্ছে?
গাওনা শুরু হয়েছিল স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়া বা স্কুল ছাত্রশূন্য হয়ে যাওয়া নিয়েই। ইতিমধ্যেই ৭৯টি জুনিয়র হাই ও হাইস্কুল ছাত্রশূন্য হয়ে যাওয়ায় সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষিকাদের অন্য বিদ্যালয়ে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। এখন ঐ সব স্কুলের বাড়ি আর জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে, তার সদ্ব্যবহার করা দরকার।
যদি স্কুলের অব্যবহৃত পরিকাঠামো ব্যবহারের কথাই ওঠে তাহলে তা সরকারি উদ্যোগে কেন নয়? টাকার অভাব? সরকার সৌন্দর্যায়ন, দুর্গাপুজো, ভাসান আর ক্লাব খয়রাতিতে অঢেল টাকা দিতে পারে, এখানে কেন নয়? শিক্ষার উন্নতিকল্পে যা যা ব্যবস্থা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা সরকারি ব্যবস্থায় কেন সম্ভব নয়?
আসলে বেসরকারিকরণের ভিত্তি অনেক আগেই তিলে তিলে তৈরি করা হয়েছে। নিয়মমাফিক শিক্ষক নিয়োগ দীর্ঘদিন বন্ধ, বদলে এখন সিভিক টিচার নিয়োগের পরিকল্পনা হচ্ছে। সব শিক্ষাবর্ষে স্কুলের পোশাক দেওয়া হয়নি, মিড ডে মিলের খরচ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্কুলের ক্যাপিটাল গ্রান্ট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষানীতিতে ক্লাস ওয়ান আর টু স্কুল থেকে বাদ দিচ্ছে। এমন কি পাড়ায় শিক্ষালয়ের মতো সরকারি কর্মসূচি দেখভালের জন্য লিভার ফাউন্ডেশনের মতো এনজিও’কে ডেকে আনা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে বামফ্রন্ট আমলে শিক্ষার বিস্তার আর মানোন্নয়নে যা যা জনমুখী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেগুলিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। সার্বিক এনরোলমেন্টের স্বার্থে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা, পড়ুয়াদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, পোশাক আর মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্থা করা— এসবই সম্ভব যদি সরকার শিক্ষার সার্বিক ব্যয় আর পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। মুনাফাভিত্তিক বেসরকারি ব্যবস্থায় এর কোনোটিই সম্ভব নয়। বামফ্রন্ট আমলে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশন তৈরি হয়েছিল, তাঁদের বেতনের দায়ভার সরকার নিয়েছিল, তাঁদের অবসরকালীন আর অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পিপিপি মডেল বাস্তবায়িত হলে তার সবকটি’ই লোপ পাবে।
বহু আলোচিত একটি প্রশ্ন
বেসরকারিকরণের ফলে সত্যিই কি স্কুল শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব?
সরকার শিক্ষার ভার নেয় সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে। মুনাফা সরকারের উদ্দেশ্য নয়। ফলে সরকার সকল নাগরিককে সমানভাবে শিক্ষার সুযোগ দেয়। ২০০২সালে আমাদের সংবিধানের ৮৬তম সংশোধনের মাধ্যমে ২১-এ নং বিধিতে দেশের ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সের সকল শিশু-কিশোরকে তাদের মৌলিক অধিকার হিসাবে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেবার কথা বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতেই ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন বলবৎ হয়।
শিক্ষা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ হলে ব্যক্তিমালিকানার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটাই লক্ষ্য থাকে— মুনাফা। বিনামূল্যে সকল শিশুকে শিক্ষা দেবার বদলে সেখানে অর্থের বিনিময়ে স্বচ্ছল পরিবারের শিশুদেরই একমাত্র শিক্ষা দেওয়া হয়; সংখ্যাগরিষ্ঠ মূলত স্বল্পবিত্ত মানুষ অর্থের অভাবে শিক্ষার আওতা থেকে বাদ পড়ে যান। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলিতে যেখানে ছাত্রসংখ্যা কম, উপযুক্ত মুনাফা অর্জনে যথেষ্ট নয়, সেখানে স্কুলগুলি বন্ধই করে দেওয়া হবে।
এইসব ঘটনা স্পষ্টতই সংবিধানের ২১-এ ধারা বা শিক্ষার অধিকার আইনের পরিপন্থী।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়
কথা হলো, এই উদ্যোগ কি আকস্মিক কোনও বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ? না কি এর পিছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি হিসাবে কলকাঠি, কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা সংস্থার স্বার্থপূরণের ছক?
মূল উদ্দেশ্য হিসাবে স্পষ্টতই বলে দেওয়া হয়েছে, বেসরকারি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আর রাজ্যে এই উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনাও নয়, সারা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সার্বিক বেসরকারিকরণের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।
রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে, স্কুল-কলেজে নতুন নিয়োগ বন্ধ। সরকারি দপ্তরগুলি, কর্পোরেশন, পঞ্চায়েত, এমনকি পুলিশের কাজেও অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চলছে; বহু কাজ যেমন সাফাই, ক্যান্টিন বা নিরাপত্তার মতো কাজগুলি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে করানো হচ্ছে। পরিবহণ সংস্থার বাসগুলি লিজে দেওয়া হচ্ছে।
বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বা প্রোমোটারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বিজি প্রেসের জমি, সিটিসি, সিএসটিসি, আলিপুর আর সেন্ট্রাল জেল, ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের জমি। বেসরকারি দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার জমি, টিকিট কাউন্টার এমন কি রুট পর্যন্ত। মেট্রো ডেয়ারি নামমাত্র মূল্যে দেওয়া হয়েছে মায়াঙ্ক জালানের সংস্থাকে।
এই ধারা অনুসরণ করে শিক্ষাক্ষেত্রেও রাজ্য সরকারের বেসরকারিকরণের ঝোঁক ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে। মেডিক্যাল কলেজের কথাই ধরা যাক। বাম আমলে পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজ রাজ্যে ছিল মোট ১৪টি, তার মধ্যে ১৩টি সরকারি ১টি বেসরকারি কলেজ। তৃণমূল আমলে নতুন করে মোট ১২টি মেডিক্যাল কলেজ হয়েছে ঠিকই, তার মধ্যে ৭টি সরকারি আর ৫টি বেসরকারি। রাজ্যে এই মুহূর্তে ৩৭টি সরকারি আর ১২টি বেসরকারি ইউনিভার্সিটি সহ মোট ৪৯টি ইউনিভার্সিটি। তার মধ্যে বাম আমল পর্যন্ত ২২টি সরকারি আর একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটি ছিল। তৃণমূল আমলে তৈরি হয়েছে ১৫টি সরকারি ইউনিভার্সিটি আর, ১১টি বেসরকারি ইউনিভার্সিটি!
আশ্চর্য নয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল দলের ইশ্তেহারে স্পষ্ট বলা হয়েছিল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। যোগ্যতাসম্পন্ন প্রাইভেট সেক্টরকে সুযোগ দেওয়া হবে। প্রাইভেট সেক্টরগুলিকে নতুন কলেজ খোলার জন্য উৎসাহিত করা হবে। ক্ষমতায় এসে তৃণমূল সেই প্রস্তাবকেই বাস্তবে কার্যকর করছে।
হাতে হাতে ধরি ধরি
২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা ২০১৮ দলিলে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধাপে ধাপে বেসরকারি হাতে তুলে দেবার যে পরিকল্পনা উপস্থাপনা করেছে, রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগ কিন্তু তার থেকে আলাদা নয়।
এতদিন যা হয়ে এসেছে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে সংবিধানের যৌথ তালিকায় নিজের নিজের ন্যস্ত দায়িত্ব অনুসারে উদ্যোগ নিয়ে স্কুলের জমি-বাড়ি তৈরি করেছে, পরিকাঠামো তৈরি করেছে, সিলেবাস তৈরি করেছে, পড়ুয়াদের স্কুলে আনার উদ্যোগ নিয়েছে, তাদের পঠন-পাঠন, বই, পোশাক, মিড ডে মিল ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে, পড়াশোনার মধ্য দিয়ে পড়ুয়াদের বুদ্ধিবৃত্তি আর কারিগরি দক্ষতা বিকাশের চেষ্টা করেছে, এবং এর জন্য দরকারি অর্থের সংস্থান করেছে। পাশাপাশি স্কুলে শিক্ষক শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করেছে, তাঁদের বেতন আর অবসরকালীন সুবিধার ব্যবস্থা করেছে, আর স্কুলগুলির পরিচালনার জন্য পরিচালন সমিতিও গঠন করেছে। এখন কিন্তু নতুন শিক্ষানীতিতে কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষায় সেই সব দায়িত্ব ধাপে ধাপে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চাইছে। সেই লক্ষ্যেই বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরিকাঠামোর উন্নয়ন আর নতুন স্কুল স্থাপনের ক্ষেত্রেও বটে, দলিলে বারংবার ‘মানবদরদি’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তথা ব্যক্তি উদ্যোগের প্রসঙ্গ এসেছে। স্কুলের ঘরবাড়ির মালিকানা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, মিড ডে মিল ইত্যাদির দায়িত্ব ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তরের কথা বলা হচ্ছে। এক কথায়, কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষায় সরকারি দায়িত্বভাগ কমিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রকে আরও বেশি করে বেসরকারি বাণিজ্যিক উদ্যোগের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে চাইছে, যেখানে সেবামূলক উদ্যোগের চেয়ে মুনাফাভিত্তিক বাণিজ্যের গুরুত্ব বেশি। এর ফলে শিক্ষা ক্রমশ ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হবে। গরিব মানুষ, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের শিক্ষার সুযোগ আরও কমবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে এবং সামাজিক ব্যবধান আরও বিপুল হবে।
শিকড়ের সন্ধানে
এই ঘটনার মূল কোথায়?
আসলে শিক্ষা হয়ে উঠেছে একটা প্রচণ্ড লাভজনক ব্যবসায়! আর তাই এই সকল ঘটনা বিচার করতে হবে ভারতে শিক্ষা ব্যবসায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। এই মুহূর্তে ভারতে শিক্ষা ব্যবসায়ের সম্ভাব্য মোট বিনিয়োগ ১০,১১০ কোটি ডলার বা (১ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে ১ ডলার = ৭৪.৯৪ টাকা ধরে) ৭,৫৭,৬৪৩ কোটি টাকা। ই-লার্নিং ব্যবসায়ে ইতিমধ্যেই ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়— ১৯৬ কোটি ডলার বা ১৪,৬৮৮ কোটি টাকা। এই বিপুল মুনাফার বাজারের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেবার জন্য দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী সংস্থার চাপ রয়েছে সরকারের ওপরে। রেল, বিমান, তেল ও অন্যান্য খনি, ব্যাঙ্ক বিমা সহ ভারতীয় অর্থনীতির প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিষেবাভিত্তিক অন্যান্য ক্ষেত্র বেসরকারি উদ্যোগের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার কর্মসূচির সূত্র ধরেই শিক্ষাক্ষেত্রেও বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থার অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে চলেছে।
শিক্ষার এই বেসরকারিকরণও কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য বেসরকারিকরণ কার্যক্রম থেকে আলাদা নয়, সার্বিক বেসরকারিকরণ পরিকল্পনারই অংশ।
ক্রোনি ক্যাপিটালিজম
আসলে কেন্দ্রীয় সরকারটাই হলো সরকার তুলে দেবার সরকার। অসৎ শিল্পপতিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা এ সরকারের উপদেষ্টারা হলেন ওইসব কর্পোরেট হাউসের সেবায় নিযুক্ত অবশ্যই স্বার্থপূরণের বিনিময়ে। আর তাঁরা যে সব নীতি গ্রহণ করেন সরকারি কোম্পানি বিক্রি করা, সহজে ব্যাঙ্কের লোন পাইয়ে দেওয়া, কর মকুব করা আর যা যা সুবিধা দেন, ব্যাঙ্কের টাকা লুটে নিরুপদ্রবে পালিয়ে যেতে দেওয়া, তাতে আসলে রাষ্ট্রের কিনা, জনগণের সম্পত্তি কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এই সব কর্পোরেট লুটে নিতে পারে। এই হলো আজকের লুটেরা ধনতন্ত্র (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম)। কর্পোরেট হাউসগুলির পরিকল্পিত নির্দেশনাতেই কেন্দ্রে বিজেপি আর রাজ্যে তৃণমূলের মতো দলকে সরকারে আনার ব্যবস্থা করা হয়। আর এই সব দল ক্ষমতায় এসে ওইসব কর্পোরেট কোম্পানিগুলিরই স্বার্থসিদ্ধি করে।
জোটবদ্ধ আন্দোলনই পথ
তাহলে খাঁড়াটা কাদের গলায় পড়ছে? শিক্ষকদের? শিক্ষাকর্মীদের? ছাত্রদের নয়? তাদের বাবা-মায়েদের নয়? আর সাধারণ মানুষ, তাঁরাই কি বাদ পড়লেন? তাহলে লড়তে হবে, না লড়তে পারলে বাঁচার সুযোগই থাকবে না। কে লড়বেন শিক্ষকেরা শিক্ষাকর্মীরা তাঁদের মাইনে পেনশনের জন্যে? ছাত্ররা স্কুল বাঁচাবার জন্যে? অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্যে? আর এঁদের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল যেসব অসংগঠিত শ্রমজীবীরা রয়েছেন— রাজমিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি দোকানি বাজারি ডেলিভারি বয় টোটো চালক, রিকশা চালক— তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে না? তাহলে লড়াইটা আমাদের সকলের, একলা কোনও শিক্ষক বা কোনও ছাত্রের নয়। সম্মিলিত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্ত, এই নীতি, এই ব্যবস্থাটা পালটানো যদি না যায়, তাহলে সমূহ সর্বনাশ।