কেমন বিকল্প ‘আপ’?
-
শুদ্ধসত্ত্ব গুপ্ত
- Mar 13, 2022 17:45 [IST]
- Last Update: Mar 13, 2022 17:45 [IST]
মসজিদ ভেঙে মন্দির হলে আমার দিদিমার রামলালা সেখানে খেলে
বেড়াবে না। তখন ২০১৪। বলেছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ২০২১’র কেজরিওয়াল অযোধ্যায় ‘রামলালা’ দেখে এসে আপ্লুত, সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন তাঁর
সরকার নতুন প্রকল্প চালু করছে যাতে সবাই অযোধ্যায় রামলালা দশর্নে আসতে পারেন।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল কি নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হবেন? রাজনৈতিক বিচারে তাঁর আম আদমি পার্টি কি আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি’র পালটা শক্তি হয়ে উঠবে? পাঞ্জাবের নির্বাচনে আপের
বিপুল জয় বিজেপি বিরোধী পরিসরের চেহারা এবং নেতৃত্বের দুই প্রশ্নকে সামনে এনে
ফেলেছে। অবশ্য কেবল আপের জয়েই এই প্রশ্ন ওঠেনি। উঠেছে কারণ এতদিন যে জমিতে
কংগ্রেসকে সেট মনে হচ্ছিল, সেখানে ভোটের তিন মাস আগে থেকে
বিচ্ছিরি অন্তর্দ্বন্দ্ব তারপর ভোটে গোহারা হার।
ভোটের তিন চার মাস আগে কংগ্রেসের দিল্লির নেতানেত্রীরা
বুঝতে পারলেন অমরিন্দর সিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা নেই! বিধায়করা দলে দলে অসন্তোষ
জানাতে শুরু করলেন। পালটা আনা হলো বকবকানির জন্য বিখ্যাত নভজ্যোত সিং সিধুকে, কদিন আগেও যিনি ছিলেন বিজেপি’র সাংসদ। অমরিন্দরকে
সরানো হলো, তাতেও সিধু থামলেন না। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হননি,
কেবল প্রদেশ সভাপতি। নতুন মুখ্যমন্ত্রী দলিত মুখ চরণজিৎ সিং
চান্নিকে লক্ষ্য করে নিয়মিত চোখা শব্দবান ছুঁড়ে গেলেন সিধু। পাঞ্জাবের জনতাকে
বোঝাতে চাইলেন মুঠো তাঁর শক্ত।
ভোট হলো, ফলাফলে দেখা গেল কংগ্রেসের আঙুল গলে
সরকার বেরিয়ে গিয়েছে। অথচ গত লোকসভা ভোটে ভরাডুবির মধ্যে পাঞ্জাবের ১৩ আসনের মধ্যে
৮টি ধরে রাখতে পেরেছিল কংগ্রেস। ৪০ শতাংশের ওপর ভোটও ছিল। কংগ্রেস সরকারে থাকলেও
অন্য রাজ্যে এমন ফলাফল দেখা যায়নি।
পাঞ্জাবে পাঁচ বছর আগে বিধানসভা ভোটে আপ বিরোধী শক্তির
মর্যাদা পেয়েছিল। কিন্তু, কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো অবস্থায়
ছিল না। সেবার যদিও বেশ কিছু নির্বাচনী সমীক্ষায় আপের সরকারের পক্ষে পূর্বাভাস
ছিল। দশ বছরের আকালি-বিজেপি জোট সরকারকে হারিয়ে আসীন হয়েছিল কংগ্রেস। কেন্দ্রের
কৃষি আইন এবং তার জেরে পাঞ্জাবে ভেঙে পড়া আন্দোলনের কারণে শিরোমণি আকালি দল বিজেপি’র জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসে। শিখ ধর্মাবলম্বী প্রধান পাঞ্জাবে বিজেপি বরাবরই
আকালির ‘ছোট শরিক’। সরাসরি সরকারে আসীন
থাকা বিজেপি’র সঙ্গে পাঞ্জাবে লড়তে হয়নি আপকে। তবে ২০২০’তে দিল্লির বিধানসভা ভোটে নিজেদের সরকারকে রক্ষা করতে হয়েছিল বিজেপি’র সঙ্গে লড়েই। তাও আবার উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মেরুকরণের প্রবল
আয়োজনের মুখে। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, প্রতিক্রিয়ায় তীব্র
আন্দোলন এবং বিজেপি-আরএসএস’র উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভাষ্যে
প্রতিবাদকে দেশদ্রোহ দেখানোর কৌশল মোকাবিলা করে।
পাঞ্জাবে বিজেপি’র বিপক্ষে অসন্তোষ তীব্র
করেছিল কৃষক আন্দোলন। পর্যবেক্ষকদের সব অংশই একমত যে কংগ্রেস এবং আকালি-বিজেপি’র বিকল্পের আকাঙ্ক্ষা ছিল। রাজ্য গঠনের পর থেকে কংগ্রেস নয় আকালি সরকার
চালিয়েছে। উদারনীতির পর্বে কৃষিতে সঙ্কট বেড়েছে, কর্মহীনতা,
ড্রাগের নেশা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্নীতিতে
ক্ষোভ ছিল। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্বের প্রভাব ছিল না। দিল্লির ‘আপ’ সরকারের প্রভাব ছিল কাছের রাজ্যে। ভোটে তা দেখা
গিয়েছে। আবার দিল্লির কাছে হলেও উত্তর প্রদেশে কিন্তু আপ দাগ কাটতে পারেনি।
সেরাজ্যে সরকারে বিজেপি।
দেশজুড়ে প্রতিবাদ, দিল্লির শাহিনবাগে অনড়
অবস্থান, ক্যাম্পাস থেকে রাজপথে হাজারো সাহসী মিছিলও জনমতকে
প্রভাবিত করেছিল। ভোটের সময় শাহিনবাগ নিয়ে চুপ ছিলেন কেজরিওয়াল। ভোটের পরই দিল্লির
জঘন্য সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সময়েও নির্বাক দর্শক হয়ে ছিল রাজনৈতিক দল আম আদমি
পার্টি। দিল্লি পুলিশ কেজরিওয়ালের হাতে নেই, কেন্দ্রের
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে। কিন্তু পুলিশের তদন্তের নামে সংখ্যালঘুদের বেছে বেছে
ধরপাকড়, বিজেপি নেতাদের উত্তেজক ভাষণের ভিডিও ঘুরে বেড়ানো
সত্ত্বেও তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও না ডাকার মতো পুলিশের বেপরোয়া ভূমিকার
প্রতিবাদে টুঁ শব্দ করেনি ‘আপ’। ভোটের
পর খড়্গপুর আইআইটি’র প্রাক্তনী, কেন্দ্রীয়
রাজস্ব বিভাগের প্রাক্তন আধিকারিক কেজরিওয়ালকে দেখা গিয়েছিল মন্দিরে পুজো দেওয়ার
ছবি প্রচার করতে।
রামমন্দির কেবল নয়, জম্মু ও কাশ্মীরের থেকে
৩৭০ ধারা বাতিলে সমর্থন জানিয়েছিলেন কেজরিওয়াল। আবার বেসরকারিকরণের বিরোধিতায় মুখ
খুলতে দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। অথচ দিল্লিতে ‘আপ’ বিদ্যুতের অতিরিক্ত দাম নিয়ে প্রচার করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিভাবে
বেসরকারি বিদ্যুৎ সংস্থা জনতার ঘাড় ভেঙে বাড়তি মাসুল আদায় করছে গবেষণা করে তা নিয়ে
তৈরি করেছিল প্রচারপত্র। জাতীয় স্তরের কোনও শ্রমিক-কর্মচারী ধর্মঘটের পক্ষে ‘আপ’-কে বিন্দুমাত্র সক্রিয়তা দেখাতে হয়নি।
কিন্তু ভোটে তো জিতেছে!
দিল্লির পর পাঞ্জাবেও ‘আপ’ ধরাশায়ী করেছে কংগ্রেসকে, বিজেপি’কে নয়। আঞ্চলিক দল হলেও এবার একের বেশি রাজ্যে একাই চালাচ্ছে সরকার। জাতীয়
স্তরে বিকল্প হওয়ার আকাঙ্ক্ষা সরাসরি প্রকাশ করছেন ‘আপ’
নেতারাই। আপ’কে যেমন উড়িয়ে দেওয়া যায় না,
তেমন এই দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোটের নিরিখে লোকসভার বিচারও করা যাবে
না। মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থানের
মতো রাজ্যে গত লোকসভা ভোটের সময় সরকারে ছিল কংগ্রেস। কিন্তু পাকিস্তানের বালাকোটে
মোদীর বিমান ঘরে ঢুকে মেরে আসার দাবি জানানোর পর লোকসভা আসনের বিচারে এই
রাজ্যগুলিতেও কংগ্রেস কার্যত বিলীন হয়ে গিয়েছে। দেখা গেল আপের কবজায় থাকা
দিল্লিতেও সাতটি আসনের মধ্যে প্রতিটিতেই জয়ী বিজেপি। দিল্লিতেই লোকসভা ভোটে আবার
আপের থেকে বেশি জনসমর্থন ছিল কংগ্রেসের পক্ষে।
বিজেপি বিরোধী পরিসরে
কংগ্রেসের গুরুত্ব নিশ্চয় নির্ণায়ক নয়। কংগ্রেস নেতারাই সেকথা মেনে নিচ্ছেন।
কংগ্রেসের বাইরে আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা জাতীয় স্তরে আরও গুরুত্ব পেতেই পারে।
কিন্তু লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে জাতীয় স্তরে জনপ্রিয় করার মতোই
ভাষ্য হাজির করবে বিজেপি-আরএসএস। ধর্মীয় মেরুকরণ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, কর্পোরেট-হিন্দুত্ব যোগ, সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের
মিশেল দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য ভোটের আগে সীমান্তে উত্তেজনাও নতুন কথা নয়। ‘হিন্দুরা বিপন্ন, হিন্দুদের মর্যাদা বিপন্ন। অস্ত্র
তুলে নাও’- বাতাসের সেসব ডাকও শোনা যাবে। সঙ্গে রয়েছে
কর্পোরেটের মদতে পুষ্ট বিপুল অর্থবল, প্রায় একতরফা
সংবাদমাধ্যম, সোশাল মিডিয়ায় আধিপত্য। সেই শক্তির মোকাবিলায়
অভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক স্লোগান এবং ভাষ্য থাকা জরুরি।
প্রাক নির্বাচনী আসন সমঝোতা নাকি নির্বাচনোত্তর সমঝোতায় সরকার গঠন, কেবল সেই চর্চা লড়াইয়ের রাস্তা দেবে না। জাত, ধর্মের
বিভাজনের সঙ্গে লড়তে হলে ভাত আর কাজের স্লোগান জনপ্রিয় করা ছাড়া উপায় নেই। ‘আপ’ কোন ভূমিকা নেবে স্পষ্ট নয় এখনও।