কামাথিপুরার রূপকথা
-
শান্তনু চক্রবর্তী
- Mar 13, 2022 17:28 [IST]
- Last Update: Mar 13, 2022 17:28 [IST]
শান্তনু চক্রবর্তী
ছবিটা যেদিন দেখতে যাচ্ছিলাম, ঘটনাচক্রে সেটা ছিল আন্তর্জাতিক নারীদিবস। এমন নয় যে, ‘গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি’ দেখার জন্য খুব সচেতনভাবে
দিনটা বেছে নেওয়া। ছবির প্রচারে গাঙ্গুবাইয়ের নির্মাতারা মেয়েদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি
নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা বলেননি। হিন্দ, আইনক্স-এ সেদিন আমার
সহ দর্শকরাও যে দিনটার তাৎপর্যের সঙ্গে ছবিটাকে খুব মিলিয়ে দেখতে চাইছিলেন,
এমনটাও মনে হয়নি। ছবির একেবারে শেষের দিকে মুম্বাইয়ের অনেককালের
বদনাম ‘গলি’ বা ‘লালবাতি’
এলাকা ‘কামাথিপুরার রানী’ গাঙ্গুবাই রীতিমত ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ নিয়ে দিল্লি গিয়ে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে
দেখা করে, তাঁর কাছে যৌনকর্মীদের তরফে দাবি জানিয়ে আসছেন—
‘গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের মর্যাদা চাই!’
ঠিক হয়তো এই বয়ান বা স্লোগানে নয়— তবে কলকাতায়
‘দুর্বার’ আন্দোলন গড়ে ওঠার কয়েক দশক
আগেই মুম্বাইয়ের এক সামান্য যৌনকর্মী নিজেদের অধিকারের কথাটা সর্বোচ্চ রাষ্ট্র
ক্ষমতার মুখের ওপর বলে আসতে পেরেছিলেন।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই গাঙ্গুবাইদের পেশাকে
আইন মাফিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেননি। কিন্তু তাঁর কোটের বাটন হোল থেকে তাঁর
একান্ত স্টাইল-স্টেটমেন্ট লাল গোলাপটি খুলে আন্দোলনের নেত্রীর হাতে তুলে
দিয়েছিলেন। আর কামাথিপুরার আশ্রয়টুকু তাদের রুজি-রুটি-মাথার ওপর ছাদটুকু যাতে থাকে, সেটা দেখবার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ছবির একেবারে শেষ দৃশ্যে আমরা গাঙ্গুবাইকে
দেখছি খোলা ট্রাকে, বিজয়ীনির মতো কামাথিপুরার গলি-মহল্লায়
বিজয় সফর করছেন! তিনি সমাজের ঠিকাদারদের ষড়যন্ত্র, উচ্ছেদ
ঠেকিয়ে দিয়েছেন। তাই কামাথিপুরার প্রত্যেকটা মেয়ের, প্রত্যেকটা
কোঠাবাড়ির, প্রত্যেকটা ছাদ-বারান্দা থেকে মহল্লাবাসী
প্রত্যেকটা মেয়ের অন্তরের ভালবাসা-কৃতজ্ঞতা অজস্র কাগজের কুচি হয়ে ঝরে পড়েছে!
কারোর কারোর যদি এই দৃশ্যটা দেখে ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকান ফুটবল স্টেডিয়ামের মতো লাগে তো লাগুক গে! ষাটের
দশকে মুম্বাইয়ের কোনও মলিন-স্যাঁতসেঁতে নিষিদ্ধপল্লির অতি সাধারণ দেহপসারিণী
কন্যারা এমন দেখনদার, চমক লাগানো স্পেকটাকুলার’র আয়োজন করতে পারে কিনা, এসব ভেবে লাভ নেই।
সঞ্জয়লীলা বনশালী গত ১৫০ মিনিট ধরে একটু একটু করে গাঙ্গুবাইয়ের যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজটা নির্মাণ করছিলেন, এই
দৃশ্যটা তার ক্লাইম্যাক্স! গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ির জীবনচিত্র এইখানেই তো
তথ্য-ইতিহাস সন তারিখের এটা ওটা খুঁটিনাটি পেরিয়ে সিনেমাঘরের পর্দা ছাপিয়ে,
পুরোদস্তুর বলিউড রূপকথা হয়ে ওঠে। আর সেই রূপকথার ডানা হয়ে ওঠেন
গাঙ্গুবাইয়ের ভূমিকায় আলিয়া ভাট।
হ্যাঁ, বনশালীর চিত্রনাট্যের একটা তথ্যভূমি
অবশ্যই আছে। সেটা হলো এস হাসান জায়েদি ও জেন বোর্হেসের ‘মাফিয়া
কুইনস অব মুম্বাই’ বইটার একটি অধ্যায় ‘দ্য
ম্যাট্রিয়ার্ক অব কামাথিপুরা।’ এখানটায় একটা স্ববিরোধিতা
আছে। গাঙ্গুবাইয়ের কাহিনি যদি এ বইয়ের পাতা থেকেই উঠে আসে তাহলে ধরে দিতে হয়,
এখানে যে মোট ১৩ জন মাফিয়া রানির কথা বলা হয়েছে, তিনিও তাদের একজন। আবার বইয়ের যে অধ্যায়ে তাঁর কথা তার শিরোনামটা দেখুন।
কামাথিপুরার ম্যাট্রিয়ার্ক! মানে কী? নিষিদ্ধপল্লি কোনোকালেই
কোনও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ নয়। বরং চিরকালই পুরুষের জন্য, পুরুষের
পক্ষে, পুরুষের দ্বারা পরিচালিত একটা ব্যবস্থা! মেয়েরা
সেখানে স্রেফ পণ্য— বা তার থেকেও করুণ— পণ্যের উপকরণ। এদের ভেতর একজন কাউকে বাড়িওয়ালি মাসি বানিয়ে আসলে
পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যই বহাল রাখা হয়। জায়েদি ও বোর্হেসের টেক্সট-এর ভিত্তিতে ছবির
যে চিত্রনাট্য তৈরি হয়, সেখানে কাথিয়াওয়াড়ের বেশ সম্ভ্রান্ত
বাড়ির এক সরল নিষ্পাপ ছটফটে কিশোরী গঙ্গা
হরজীবনদাস, প্রেমিকের ছলনায় ভুলে কামাথিপুরা মুম্বাইয়ে লীলা
মাসির (অভিনয়ে সীমা পাওয়া) কোঠায় বিক্রি হয়ে যায়। সেখানে শুরু প্রতিরোধ, তারপর মেনে নেওয়া, তারপর কামকলার নানা হরকত মানা
দক্ষ-পেশাদার যৌনকর্মী হয়ে ওঠা— এবং শেষ অবধি গোটা তল্লাটের
ভোটে জিতে কামাথিপুরার গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট বা ‘বড়া
ঘরওয়ালি’ নির্বাচিত হওয়া— গাঙ্গুবাইদের
কেরিয়ার গ্রাফটা মোটামুটি এরকমই। এখানে মাফিয়া রানি হওয়ার সুযোগ খুব একটা ছিল না। অন্তত ছবিতে আমরা
গাঙ্গুর সঙ্গে মাফিয়াগিরির যেটুকু যোগ দেখছি সেটা ৫০-৬০’র
দশকে মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন করিম লালার (ছবিতে রহিম লালা) সঙ্গে ভাই
পাতানোর সূত্রে। লালার সৌজন্যেই গাঙ্গু নিষিদ্ধপল্লির বেআইনি মদের ঠেক চালানোর
বরাত হাসিল করে। তবে সে কারবারটা আমরা পর্দায় দেখি না। শুধু গাঙ্গুর সংলাপ আর
মাঝেমধ্যে পুলিশের হানায় টের পাই। আসলে বনশালী তাঁর ছবিতে ১৯৫০-৬০’র দশকের যে মুম্বাই বা বোম্বাইয়ের চেহারাটা তুলে ধরেছেন সেখানে ভাইগিরি
থেকে নারীমাংসের ব্যবসা, কোথাও একটা সততা, উসুল, নৈতিকতার জায়গা ছিল। করিম বা রহিমলালা তো
রীতিমতো ধার্মিক, হৃদয়বান, ন্যায়পরায়ণ
মানুষ। নিজের গ্যাং-এর লোক দোষ করলেও তিনি
বিচার করে সাজা দেন। যে গ্যাংস্টার বিকৃত কামে আলিয়াকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল, নিজের হাতে ঠেঙিয়ে তার বিষ ঝেড়ে দেন।
‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই’-এ হাজি মাস্তানের পর এ ছবিতে করিম লালার ক্যামিও চরিত্রে অজয় দেবগণ আবার
প্রমাণ করলেন নীতিবাগিশ আদর্শবাদী ডনের চরিত্রে তাঁর কোনও বিকল্প নেই। কামাথিপুরার
বদনাম গলিও অমিত ঘোষাল-সুব্রত চক্রবর্তীর প্রোডাকশন ডিজাইন ও সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের অনুভবী ক্যামেরায় একটা পেলব
কোমল, ভিস্যুয়াল মায়া তৈরি করে। সেখানে নিষিদ্ধপল্লির
নিষ্ঠুরতাও নরম-সহনীয় হয়ে ওঠে। মহল্লায় এক রাতে যখন আচমকা বিদ্যুতের আলো চলে যায়
আর লীলা মাসির হুকুমে সব শরীরিণী নারীরা একটা করে মোমবাতি জ্বালিয়ে মুখের কাছে ধরে,
তখন ওয়াইড অ্যাঙ্গল লেন্সে সে যেন এক অলৌকিক আলোর কোরিওগ্রাফি—
যেন ফিদা হুসেইনের কোনও ক্যানভাস।
তাই সময়-ইতিহাস-বাস্তবের অত খুঁটিনাটি ছাড়াই বনশালী, গঙ্গা হরজীবনদাসের গাঙ্গুবাই কোঠোওয়ালি থেকে গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি হয়ে
ওঠার গল্প বলেছেন আবেগ-নাটকের চূড়ো ছুঁয়ে ছুঁয়ে। গাঙ্গু ১৭ থেকে ২৭-এ পৌঁছেছেন।
যে দেবানন্দের নায়িকা হবেন বলে তিনি রমনিকলালের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিলেন, তিনি এখনও তাঁর ‘হট ফেভারিট।’ গাঙ্গুর
বয়স বাড়ে। কামাথিপুরার একমাত্র সিনেমাঘরের হোর্ডিংগুলো পালটে পালটে যায়। ‘চৌধুবী
কা চাঁদ’ থেকে ‘জাহাজি লুটেরা’ তারপর ‘মুঘল-এ
আজম!’ মুম্বাইয়ের রাস্তায় বিদেশি গাড়ির সংখ্যা বাড়ে,
ট্রাফিক জ্যামও, গাঙ্গুও পুরানো গাড়ি ছেড়ে
মস্ত নতুন বেন্টাল গাড়িতে চড়েন। নারীর ক্ষমতায়ন? এখানেই
বনশালী আর আলিয়া ভাটের জুটি তাঁদের তুরুপের তাসটা দুর্দান্ত খেলেছেন। চুল থেকে
নখের ডগা অবধি একটা পুরুষতান্ত্রিক বন্দোবস্তে গাঙ্গুবাইকে দিয়ে ‘ম্যাট্রিয়ার্ক’-এর আসলটা উপভোগ করিয়েছেন। শরীরে বা
মেকআপে অতটা না হলেও পুরুষের দুনিয়ায় একলা নারীর এই ব্যক্তিত্ব, কর্তৃত্ব গলার আওয়াজে সংলাপ বলার ধরনে দারুণ নিয়ে এসেছেন আলিয়া। বিশেষ করে
প্রেমিক আফসানের (অভিনয়ে চমৎকার শান্তনু মাহেশ্বরী) সঙ্গে সম্পর্কে ‘বাড় ঘরওয়ালি’ পদের আধিপত্য আজ যুবতী হৃদয়ের বাসনার
দ্বন্দ্বটা তিনি চমৎকার সামলেছেন। এই
মাতৃ ইমেজের খাতিরেই তিনি শেষ অবধি নিজের প্রেমিকের সঙ্গে এক যৌনকর্মীর কিশোরী
মেয়ের বিয়ে দেন। এই ত্যাগের সঙ্গে ভারসাম্য দেখেই ছবিতে আলিয়াকে কস্টিউম ডিজাইন ও
রং ফুকোতে ফুকোতে পুরদস্তুর সাদা করা হয়েছে। এই
ডিজাইনার্স সাদা শাড়ি, ব্র্যান্ডেড কোনও চশমার সাজে
আজাদ ময়দানে মুম্বাইয়ের নারী আন্দোলনের মাথাদের জমায়েতে তিনি তাঁর বৃক্ততার
স্টাইলেও সবাইকে চমকে দেন! সেই ভাষণেরও মোদ্দা কথা কিন্তু একটাই! কামাথিপুরা আসলে
এই সমাজের সেফটি ভালভ! ওই মহল্লা আছে বলেই পুরুষের যাবতীয় নিষিদ্ধ কামনা-বিকার
মুক্ত হয়ে শহরের ‘উর্দির
ঘরকি লড়কি’দের নিরাপদ রেখেছেন! আলিয়ার ডায়লগ ডেলিভারির
ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল, একটা প্রকাণ্ড নারীবাদী ঠাট্টার মতো
করেই যেন তিনি কথাগুলো সমাজের দিকে ফিরিয়ে
দিচ্ছেন! এটাই ছবিটার জোরের জায়গা। একই সঙ্গে হয়তো বিপদেরও। হয়তো দিনটার তাৎপর্যেই
ছবি দেখতে দেখতে কথাগুলো মনে হলো!
ছবি: গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি
পরিচালানা: সঞ্জয়লীলা বনশালী
অভিনয়ে: আলিয়া ভাট, শান্তনু মাহেশ্বরী,
সীমা পাওয়া, বিজয় রাজে, ইন্দিরা
তেওয়ারি, জিম সর্ভ ও অজয় দেবগন।