জান বাঁচাতে লড়াই কবুল
-
সুদীপ্ত বসু
- Nov 30, 2019 09:15 [IST]
- Last Update: Nov 30, 2019 09:15 [IST]
চিত্তরঞ্জন, ২৮ নভেম্বর- সেদিনও
শীতের হালকা আমেজ ছিল। সেদিনও নভেম্বর ছিল।
দেশদ্রোহিতাকে পাহারা দিচ্ছিলেন
দেশপ্রেমের মুখোশ পড়া ‘স্যার বীরেন’! টানা ছয় মাস ধর্মঘট শেষে অভুক্ত, ক্ষুধাক্লিষ্ট রানিগঞ্জের বার্নসের একদল শ্রমিকদের কলকাতা
অভিযান।
স্বাধীনতার কয়েক বছরের মাথায় নিজের
কারখানা,
নিজের স্ত্রী, সন্তানের ভাতের নিশ্চয়তার দাবিতে কয়েকশো শ্রমিকের পদযাত্রা-রানিগঞ্জ সহ গোটা
শিল্পাঞ্চলে আজও সেই শ্রমিকদের বীরত্বের কাহিনি ছড়িয়ে আছে, পরতে পরতে।
সেদিন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির
মুখপত্রে তারই উপাখ্যান, ‘ হাতের কাজ বন্ধ,তাই এবার পায়ের কাজ শুরু হবে শ্রমিকদের। যে যুগে জলে, স্থলে আকাশে মানুষের গতিবেগের অন্ত নেই, সেই যুগে এরা পথ হাঁটবে পথের মানুষকে দুঃখের কথা
জানাতে..’’।
হাতের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তাই পায়ের কাজ শুরু। লঙ মার্চ!
মাঝের ব্যবধান ৬৫ বছর। সেদিন
রানিগঞ্জ থেকে কলকাতা, এবার চিত্তরঞ্জন
থেকে কলকাতা। রাত পোহালেই এই নভেম্বরের লঙ মার্চ।
কথা বলতেই আবেগে চোখে জল, বলে উঠলেন, ‘ যেদিন জেনেছি
সেদিনই ইউনিয়নকে জানিয়েছি আমি স্থায়ী পদযাত্রী হবো। হাঁটব, আর ১১ মাস কাজ আছে, কুছ পরোয়া নেহি’। সিএলডব্লিউ চত্বরেই ইউনিয়ন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন
প্রবীর সাহা, ‘জানেন আমার স্ত্রী আমার চেয়েও
উত্তেজিত। বাড়িতে ব্যাগ গোছাচ্ছে, টুকিটাকি যে জিনিস
লাগে বারো দিনের জন্য। আমার সহকর্মীরা আমার জন্য পিঠে নেওয়ার বড় ব্যাগ দিয়েছে, হাঁটার আগেই কত শুভেচ্ছা পাচ্ছি’। সিএলডব্লিউ’র
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মী। নিজেই বললেন, ওই নয়ের দশকে ইস্কো বাঁচাও’র জন্য কলকাতা থেকে ইস্কো- পদযাত্রায় হেঁটেছিলেন।
চন্দ্রশেখর মুখার্জি থেকে বামাপদ মুখার্জি- শ্রমিক আন্দোলনের গর্বিত অধ্যায়ের
কাহিনি বুনেছিলেন সেই ইস্কো বাঁচাও যাত্রার। বামপন্থীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের পরিণতিতে, সেই ইস্কো আধুনিকীকরণের পথে হেঁটে আজও চলছে।
‘সেবার পুরোটা নয়, মাঝখান থেকে হেঁটেছিলাম। এবার পুরো হাঁটব, কলকাতা যাব। মানুষজনকে বলতে পারব আমার চিত্তরঞ্জন রেল
ইঞ্জিন কারখানা বাঁচানোর জন্য আমি বারো দিন হেঁটেছি’, বলছেন প্রবীর সাহা।
শিল্প জনপদের ধুলো উড়ানো রাস্তায়
নেমে আসবেন একদল শ্রমিক, কর্মচারী- শুধু
নিজের কারখানা, খোয়া যাওয়া কাজের খোঁজে নয়, দেশের সম্পদ, রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা রক্ষার দাবিতে। এ কি আর যেমন তেমন লড়াই! প্রতি ইঞ্চিতে
শ্রমিকের ঘাম, দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেমের দুর্দান্ত মিশেলের অনিবার্য প্রত্যাঘাতের মহড়া!
হ্যাঁ, প্রত্যাঘাতেরই মহড়া। সুন্দর ছবির মত সাজানো চিত্তরঞ্জন রেল
ইঞ্জিন কারখানার চত্বর। শুক্রবার সকালে সেই চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভের শ্রমিক আবাসন
হিলি কলোনির মুখেই দেখা মিলেছে সান্ত্বনা ব্যানার্জির সঙ্গে। তখন সিএলডব্লিউ চত্বর
জুড়ে সিআইটিইউ’সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পতাকায় সাজানো হচ্ছে চত্বর। রাত
পোহালে এখান থেকেই শুরু হবে লঙ মার্চ।
তার আগে মুখোমুখি সান্ত্বনা
ব্যানার্জি। ‘শুধু রাজভবন কেন, না হলে দিল্লি
যাবো,
পার্লামেন্ট আটকে দেবো’, চমকে ওঠার রসদ মিলতেই তাঁর দিকে এগিয়ে যাওয়া। না, তিনি সিএলডব্লিউ’র কর্মচারী নন। তাঁর স্বামী কালীদাস
ব্যানার্জি এখানে চাকরি করেন। ‘আমি করি না তো কি হয়েছে, আমার স্বামী করে, হঠাৎ করে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কি হবে, মোদী তো রান্নাঘরেও হামলা চালাচ্ছে। এবার দেখবে আমরা যারা রান্নাঘরে থাকি
তাঁদের জোর কত’। এরপরেই সটান জানালেন, আমিও তো হাঁটবো লঙ মার্চে। যতটা পারবো ততটা এগবো, জামা কাপড় নিয়েই যাবো। ছাড়বো না।
হাঁটবেন শুধু শ্রমিক কর্মচারী নয়, হাঁটবেন তাঁদের পরিবারও। শ্রমিক আন্দোলনের চিরায়ত ব্যাকরণের
অনিবার্য প্রতিফলন, আঘাত আসলে
ঐক্যবদ্ধ হয়েই প্রত্যাঘাত।
বছর দশেক আগে বিয়ে করে এখানে এসেছেন
রেশমী কুমার। তাঁর স্বামী বিজয় কুমার চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভের কর্মচারী। কাজ
হারানোর শঙ্কা তাঁরও মাথায়, দেশের সবচেয়ে
আধুনিক রেল ইঞ্জিন তৈরির কারখানাকে কর্পোরেটকরণের নামে শুকিয়ে মারার খেলা তিনিও
যেন ধরতে পেরেছেন। ‘ আমরাও বুঝি, কর্পোরেটকরণ
মানে তো আসলে বেসরকারিকরণ। কজ হারালে কী হবে? চিত্তরঞ্জন থেকে গিয়ে কোথায় থাকবো? বিজেপি তো কত কথা বলেছিল, কী হলো? আমিও তাই হাঁটবো’।
শুধু হাঁটা নয়, তাঁদের ঘর খুলে দিয়েছেন শুক্রবার রাতের মধ্যে যে স্থায়ী
পদযাত্রীরা এখানে আসবেন তাঁদের জন্য, রাতে তাঁরাই রান্না করবেন। ভোরবেলা উঠে ফের পদযাত্রীদের জন্য সকালের টিফিনও
তৈরি করে দেবেন তাঁরা। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে হাঁটবেন শ্রমিক পরিবারের মহিলারাও, যতটা পারবেন, যতটা সাধ্যে কুলোবে। হিলি কলোনিরই বাসিন্দা গৃহবধূ রঞ্জনা গোস্বামী বলে উঠলেন, ‘ ইউনিয়ন থেকে তো আমাদের মহল্লায় বলেও গেছে লুচি, তরকারি আর মিষ্টি দিতে। ভোর থেকে এই মহল্লায় লুচি ভাজা শুরু
হবে,
মনে হয় যেন উৎসব লেগেছে’।
লঙ মার্চ তো শ্রমিক মহল্লায় উৎসবের
রেশই টেনে আনবে, এতে আর আশ্চর্য কোথায়?
বিস্ময়ের উপাদান তখনও অধরা ছিল।
সামনে এলেন অনিতা বাউড়ি, ‘ আমি তো কাজেও ছুটি
নিয়েছি,
হাঁটবো ওখানে, ঐ যে লঙ মার্চ না কি বলে সেখানে’।
অনিতা বাউড়ি সিএলডব্লিউ’র শ্রমিক, কর্মচারী নন। থাকেন পাশের বস্তি এলাকায়। তাহলে কেন বলছেন? অনিতা বাউড়ির কথায়,‘ এই সিএলডব্লিউ’র কোয়ার্টারে আমি পরিচারিকার কাজ করি,কাল কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে আমাদের, যাদের বাড়ি কাজ করি তাঁদের কাজ না থাকলে আমরা কোথায় যাব? সব দোকানপাট চলে তো এটার ওপর ভরসা করেই।’
লড়াইয়ের শৃঙ্খল বুনে চলেছে শ্রমিক
মহল্লা।
কেবলমাত্র একটি ইউনিট থেকেই ২০১৮-১৯
আর্থিক বর্ষে ৪০২টি লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরি হয়েছে। গিনেস বুকে আজ পর্যন্ত তা
রেকর্ড। কৃতিত্বের দাবিদার সিএলডব্লিউ। যে বছর রেকর্ড পরিমাণ লোকোমোটিভ ইঞ্জিন
তৈরি হলো তার পরের বছরই সেই সংস্থার জন্য বরাদ্দ হলো কার্যত এক ‘মৃত্যু পরোয়ানা’!
‘কর্পোরেটকরণ’— গালভরা বিশেষণের আড়ালে আসলে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভকে বেসরকারি
মালিকের হাতে ছেড়ে দেওয়ার তোড়জোড়। তাই প্রতি মুহূর্তে উৎপাদন বরাত কমিয়ে তা পাঠিয়ে
দেওয়া হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্রে ডিএলডব্লিউ ইউনিটে। ১৭ হাজার শ্রমিক, কর্মচারী থেকে সংখ্যা নামিয়ে আনা হয়েছে ১১ হাজারে।
সিএলডব্লিউ’র লেবার ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাজীব গুপ্তের কথায়, ‘আমাদের তাই বোঝাতে হচ্ছে না নতুন করে এই বিপদ। পাশের
হিন্দুস্থান কেবলস শ্মশানে পরিণত হয়েছে, গোটা এলাকা অন্ধকারে, এলাকাটাই বদলে
গেছে। তাই দুদিন আগেও মোদীর স্লোগান দেওয়া যুব শ্রমিক হরজিৎ সিং, কুন্দন সিং নিজেরাই এসে লঙ মার্চের সমর্থনে জোর করেই বাইক
মিছিল করেছে’।
দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল সহ পশ্চিম
বর্ধমান জেলায় শিল্পে সঙ্কট। পাঁচটি রাজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা, বারোটি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, ২০টির বেশি মাঝারি, ছোট ইস্পাত
কারখানা,
২৬টি ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প সহ গোটা জেলায় ১৭০টির বেশি
কারখানা বন্ধ। একাধিক কয়লা খাদান বন্ধ, বন্ধ হওয়ার মুখে নোটিসের মুখেও একাধিক। তিরিশ হাজারের বেশি শ্রমিক ইতিমধ্যে
কাজ হারিয়েছেন। তৃণমূল আমলে শুধুমাত্র দুর্গাপুরেই ট্রেড ইউনিয়ন করার অপরাধে ৪
হাজার ঠিকা শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। গুরুতর সঙ্কটের মুখে সর্বস্ব বাজি রেখে লড়ছে
অ্যালয় স্টিল প্লান্ট থেকে ডিপিএল- প্রত্যক্ষ মুখোমুখি প্রতিরোধে।
সকাল থেকেই সেই প্রস্তুতি ঘুরে
দেখার মাঝেই সিআইটিইউ নেতা বংশগোপাল চৌধুরি ও গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি বলছিলেন, ‘লঙ মার্চ শুধু শ্রমিক একতাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে তা
নয়,
সাধারণ মানুষও পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, গণ সংগ্রহে সাহায্য করছেন। গোটা জেলা জুড়ে ২০০-র বেশি ছোট
পদযাত্রা,
আড়াইশোর বেশি সভা করেছি আমরা, এমন অনেক সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় ঢুকতে পারতাম না, লঙ মার্চের আবেদন সেই রাস্তাও খুলে দিয়েছে’।
রাতেই আসতে শুরু করেছেন স্থায়ী
পদযাত্রীরা। একশোর বেশি স্থায়ী পদযাত্রী থাকবেন। এছাড়াও হাঁটবেন কয়েক হাজার শ্রমিক
কর্মচারী। রাত জাগছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। শনিবার সকাল সাড়ে নটায় লঙ মার্চ উদ্বোধন
করবেন প্রবীণ শ্রমিক নেতা শ্যামল চক্রবর্তী। থাকবেন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সহ গণ
সংগঠনের নেতৃত্ব, থাকবেন
আইএনটিইউসি’র নেতৃত্ব।