আছে মন্দা, আছে হিন্দুত্ব, দেশে শুধু নেই কাজ কাজের আকালে ঘরে ফিরছেন পরিযায়ী মুখগুলি
-
নিজস্ব প্রতিনিধি
- Dec 02, 2019 11:21 [IST]
- Last Update: Dec 02, 2019 11:21 [IST]
কলকাতা, ১ ডিসেম্বর— কাজ নেই গ্রামে। তাই কাজের খোঁজে যাওয়া ভিনরাজ্যে। সেখান থেকেও উধাও কাজ। কাজের সন্ধানে আবার ফেরা গ্রামে। পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে কাজ।
কাজের আকালে পড়ছে গোটা দেশ। তাই ভিনরাজ্যে গিয়ে কাজ জোটাতে পারছেন না বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক।
কাজ না থাকা বাংলার গ্রাম অনেক দিন ধরেই ভিনরাজ্যে গিয়ে খুঁজে নিত কাজ। আট মাস, দশ মাস বিদেশ বিভুঁইয়ে কাটিয়ে আবার ফিরে আসা হতো গ্রামে। এখন ভিনরাজ্যও ফিরিয়ে দিচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের।
দেড়-দু’মাস ধরে কাজের এই বন্ধ্যা পরিবেশের মুখে পড়তে শুরু করেছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। হাজার কিমি পথ পার করেও জোটানো যাচ্ছে না কাজ। নিখোঁজ কাজের তল্লাশিতে আবার ফিরতে হচ্ছে গ্রামে। সেখানেও নেই কাজ।
বড় অসহায় অবস্থায় পড়েছেন গরিব মানুষ।
‘খুব বেকায়দায় পড়েছি।’ বলছিলেন নুরুল মিয়া। কুশমণ্ডির পরিযায়ী শ্রমিক। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডি থানার মালিগাও গ্রামে বাড়ি। পোস্ট অফিস উত্তরপাড়া। গ্রামে কাজ নেই। মাস দেড়েক আগে কাজের জন্য রওনা দিয়েছিলেন নাসিক।
৫হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। বাড়িতে চাল-ডাল, বাজার-হাট করে নিজের জন্য দেড় হাজার টাকা নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে ট্রেনে উঠে পৌঁছেছিলেন হাওড়া স্টেশন। ওখান থেকে টিকিট কেটে মুম্বাইগামী ট্রেনে উঠে নাসিক স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমে ৭০কিমি পথ পার করে সাঁইবাবার আশ্রম। ‘ওখানেই কাজ করতাম। বিল্ডিংয়ের কাজ। মশলা-টশলা মাখা, জোগালির কাজ। মিস্ত্রির সঙ্গে থেকে কাজ করতাম।’ বলছিলেন কুশমণ্ডির পরিযায়ী শ্রমিক।
এবারও গ্রামে কাজ না থাকায় দেড় হাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন নুরুল মিয়া। কিন্তু কাজ মেলেনি। ‘৮-১০দিন ছিলাম। কিন্তু কাজ ঠিকমতো পেলাম না। ফিরে এসেছি গ্রামে।’ জানাচ্ছেন তিনি।
পরিযায়ী হয়েও কাজ মিলছে না। হাজার কিমি পথ পাড়ি দিয়েও কাজের আকালে ফিরতে হচ্ছে গ্রামে।
এই অভিজ্ঞতা উত্তরবঙ্গের বহু গ্রামের। গ্রাম ছেড়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েও মিলছে না কাজ। বন্ধ্যা অর্থনীতির কোপে পড়ে শ্রমিকের তকমা হারাচ্ছেন পরিযায়ীরাও।
কেন কাজ নেই?
ওঁরা বলছেন, ‘আগে এমন ছিল না। কাজের জন্য বাইরে গেছি। আবার বাড়ি ফিরে এসেছি। আবার গেছি। কিন্তু এবার কোম্পানিগুলো ঠিকাদারদের টাকা দিচ্ছে না। তাই ঠিকাদাররাও লেবার পেমেন্ট করতে পারছে না। তাই কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
৫হাজার টাকার ঋণ এখনও শোধ করতে পারেননি নুরুল মিয়া। বাড়িতে তাঁর বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী সন্তান মিলিয়ে ছয় জন। বড় ছেলে দু’ মাস পরেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী। এখন তাঁর কাছে সংসার চালানোই দুষ্কর। সন্তানের শিক্ষা নিয়ে ভাববার সময় নেই।
উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার প্রায় সব জেলা থেকেই কাজের জন্য ভিনরাজ্যে পাড়ি দেয় গ্রাম-শহরের মানুষ। দক্ষিণবঙ্গের জেলা থেকেও পরিযায়ী শ্রমিকের স্রোত বহমান।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। গ্রামের কাজ না পাওয়া যুবক বাইরে গিয়েও শূন্য হাতে গ্রামে ফিরছেন।
মন্দার প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। জিডিপি বাড়ার হার তলানিতে নেমে যাওয়ার ফল ভুগছেন প্রান্তিক মানুষ। উত্তরবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে টের পাওয়া গেছে, বড় অংশই ভিনরাজ্যে এসে নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। বছরের পর বছর ধরে আবাসন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজের খোঁজ পেয়ে সংসার পালন করেছেন বড় অংশের পরিযায়ী শ্রমিক।
কীভাবে কাজ পাবেন পরিযায়ী শ্রমিকরা?
কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্যই জানাচ্ছে, নির্মাণ ক্ষেত্রে গত আর্থিক বছরের বৃদ্ধির হার ৮.৫শতাংশ থেকে কমে ৩.৩শতাংশে ঠেকেছে। কাজ হারানো মানুষের পক্ষে অর্থনীতির এই বেহাল তথ্য অধরা। কিন্তু নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বুঝছেন, ‘বড় বেকায়দায় পড়েছেন।’
এক, দু’জন নয়। গত দেড় দু’মাসে যাঁরাই কাজের জন্য ভিনরাজ্যে গেছেন। কাজ পেয়ে থিতু হতে পারেননি একজনও। সবাই ফিরছেন গ্রামে।
কুশমণ্ডির করঞ্জীপুকুর থেকে মাস খানেক আগে কাজের জন্য দিল্লি গিয়েছিলেন জবাদুর রহমান। অভিজ্ঞতার কোনও হেরফের হয়নি। কাজ না পেয়ে ফিরে এসেছেন গ্রামে। আবার কবে যাবেন? শুনে তাঁর সটান জবাব, ‘এখন আর কী করতে যাবো?’
এই অভিজ্ঞতার একটু রকম ফের আছে মেহেদি হাসানের। তাঁর কাজ ছিল। কিন্তু তাঁকে কাজ ফেলে রেখে, শুধু বাড়ি ফেরার টাকা নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
মেহেদি হাসান টানা ছয় বছর ধরে শ্রীনগর শহরতলিতে যাতায়াত করতেন। কাজ করতেন প্লাইউড কারখানায়। মাসে ১৫হাজার টাকা বেতন ছিল তাঁর। ‘ওই যে হরতাল শুরু হলো, দু’মাস চুপচাপ বসে থাকার পর মালিক আমাদের ভাড়ার টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিল। তারপর থেকে গ্রামেই আছি।’ বলছিলেন মেহেদি হাসান।
মন্দার অর্থনীতি দেশকে ডোবাচ্ছে। তার প্রভাবে কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিক। কাজ আছে। মোদী সরকারের হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি কাজ কাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। কাজের আকালে ঘরমুখো বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা।
গ্রামে এখন ধান কাটার কাজ আছে। ২৫০টাকা মজুরির এই কাজের আয়ু মেরেকেটে আর ১৫দিন।
তারপর?
উত্তর জানা নেই পরিযায়ী শ্রমিকদের।