কিছুই না ভুলে ভোট দিতে ফিরছেন শাহ্ জামালরা
-
অনির্বাণ দে
- Apr 07, 2021 13:33 [IST]
- Last Update: Apr 07, 2021 03:00 [IST]
বহরমপুর
৬ এপ্রিল— জীবন-যন্ত্রণা ভুলছেন না আমজাদ হোসেন।
‘‘স্ত্রী কান থেকে সোনার দুল খুলে বন্ধক দিয়েছিল। সেই টাকা অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছিল। তারপর বাসের টিকিট কেটে বাড়ি ফিরেছিলাম। চোখে জল নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। সহজ নাকি?’’
বছর চল্লিশের গলায় তখন জমাট বাঁধছে অসহায়তা আর ক্ষোভ।
মুখ্যমন্ত্রী বলেই খালাস, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরিয়েছেন। আমজাদ ফিরেছেন ছয় হাজার টাকা বাসভাড়া দিয়ে। জেদ ধরেছিলেন ফিরবেন না, সরকার ফেরালে ফেরাক, নাহলে যা হোক হবে। কিন্তু মানেনি পরিবার।
স্ত্রীর গয়না বন্ধক দিয়ে জুটেছে বাস ভাড়ার ছয় হাজার টাকা। গ্রামে কর্মহীন কয়েক মাস কাটিয়ে কাজের খোঁজে রাঁচি যাওয়ায়, ফের মাথায় চেপেছে বন্ধক।
‘‘এখনও মাথায় ঋণের বোঝা। আর ভুলে যাব! সহজ নাকি?’’ ফের বললেন মধুরকুলের আমজাদ হোসেন।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কথাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিচ্ছে ডোমকলের এই পরিযায়ী শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা।
কাজ চলছিল অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপতিতে। হঠাৎই ফোন শোনেন, লকডাউন। লকডাউন কী বুঝে উঠতে অবশ্য রাত পেরোতে হয়নি। ৫০০ টাকা বস্তা চাল, এক লাফে বেড়ে হয়েছিল ৮০০ টাকা।
বাজারে বের হলে তাড়া করছিল অন্ধ্র প্রদেশের পুলিশ। চলছিল মারও।
অগত্যা ফোন মেম্বার, প্রধান, শাসকদলের নেতাদের। নিজের কেন্দ্রের সাংসদ, রাজ্যের শাসকদলের জেলা সভাপতি আবু তাহের খানকেও ফোন করেছিলেন আমজাদ হোসেন। সাংসদ বলেছেন, দেখছি। তারপর আর ধরেননি ফোন।
তবে বিপদে আছেন খবর পেয়ে ফোন গিয়েছিল ডোমকলের সিপিআই(এম) অফিস থেকে। এরপর ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই ফোন আসতে শুরু করে তিরুপতির সিপিআই(এম) দপ্তর থেকে।
অর্ধেক তেলুগু আর অর্ধেক হিন্দি মেশানো বুলি বোঝার উপায় ছিল না মুর্শিদাবাদের শ্রমিকদের। স্থানীয় বাসিন্দা রঘুর সাহায্যে অবশ্য পরিষ্কার হয় যোগাযোগ। এরপর দশদিন খাইয়েছে ওখানকার সিপিআই(এম) কর্মীরাই। একবারও খোঁজ নেয়নি রাজ্যের সরকার।
বাস চলাচল শুরু হতেই বাড়ি ফিরেছেন স্ত্রীর কানের বন্ধক দিয়ে। ছয় হাজার টাকা বাসভাড়া দিতে চোখের জল গড়িয়েছে। কিন্তু ঘরে ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না। কয়েকমাস কর্মহীন থাকার পর তাই আবার পাড়ি জমিয়েছেন রাঁচি। তবে ভোটের হাওয়া উঠতেই বাড়িও ফিরেছেন ভোট দিতে।
বেঁচে আছি কিনা মরে গিয়েছি যারা খোঁজ নেয়নি, তাদের একটাও ভোট নয়। পরিষ্কার বলছেন শ্রমিকরাই।
মনে করিয়ে দিচ্ছেন কারা খাবার জুগিয়েছে এমনকি ভিনরাজ্যেও, বাড়ি ফেরার পর কারা চাল, ডাল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বন্ধু হয়ে।
ভোটের মরশুমে হাজার কথার মধ্যেও সেইদিনগুলো ভুলবেন না একই গ্রুপে থাকা আনিসুর রহমান, রুপচাঁদ সেখ, হাসান আলিরা।
তাই একে একে ঘরে ফিরছেন সবাই।
ডোমকলের বাগডাঙায় পাড়ার মাচায় বসে যে কথা শোনাচ্ছেন আমজাদ। সেই একই সুর চেন্নাইয়ে কাজে থাকা শ্রমিকদের গলাতেও।
মঙ্গলবার ভোট চলছে তামিলনাডুতেও। আর তাই ভোট নিয়ে কথা হচ্ছে চেন্নাই লাগোয়া নির্মীয়মাণ বহুতলের ‘সাইট’এও। ভোট বলেই এদিন কাজ বন্ধ। মোবাইলেই দেখেছেন রাজ্যে ভোটের খবরও। এর মাঝ থেকেই ভগবানগোলার হনুমন্তনগরের সেলিম শেখ জানাচ্ছেন, ভোট দেওয়ার জন্য বাড়ি ফিরবেন তাঁরাও।
প্রশ্ন রাখতেই জবাব, ‘‘যা কষ্ট করে বাড়ি গিয়েছি সেটা কোনোদিন ভুলবো না।’’ বলছেন, ‘‘শুনেছি তো সরকার শ্রমিকদের টাকা দিয়েছে, কই আমরা তো পাইনি।’’
বলছেন, ‘‘কোথায় ছিল সরকার? ঘরে সর্ষে ছিল, ডাল ছিল, হাফ দামে বিক্রি করে বাড়ি ফিরেছিলাম। ন’হাজার টাকা খরচ করার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে?’’
ঘরে ফেরার বন্দোবস্ত করতে বাড়ির লোকেরা ধরনা দিয়েছে হনুমন্তনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার, প্রধানদের কাছে। ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের জেরক্স জমা নিয়ে দায় সেরেছেন তাঁরা।
‘‘দেশে কাজ থাকলে, বাড়িতে বয়স্ক বাবা, মা ফেলে এতদূর আসি?’’ প্রশ্ন সেলিম, শাহ জামালদের।
চাইছেন ভোটে সবাই কথা বলুক, কাজ নিয়ে। বাইরে থাকা শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে। তাই টিকিট কেটেছেন ২৪ তারিখ রাজ্যে ফেরার।
শুধু কাজের সঙ্কট নয়। এই কয় বছরে শ্রমিকদের অসহায়তার সাথেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পঞ্চায়েতে লুট। বলছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের সংগঠক, ইসলামপুরের মোস্তাফিজুর রহমান। নির্বাচনের মুখে বাড়ি ফিরেছেন সোমবারই। বলছেন, “আমরা তো সবই দেখেছি। শ্রমিকদের যখন কাজ নেই, ইনকাম করেছে প্রধান মেম্বাররা। বাড়ির তৈরির টাকা নিয়ে বসে আছেন ওঁরা। যাঁরা লকডাউনে সর্বঃস্বান্ত হয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকেও তোলাবাজি হয়েছে। সব দেখেই গ্রামে ফেরার জন্য যোগাযোগ শুরু করেছেন শ্রমিকরা।’’
সব মাথায় রেখেই ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভিনরাজ্যে কাজে যাওয়া মুর্শিদাবাদের শ্রমিকরা।