এফ আর ডি আই বিল বাতিলে
ব্যাপকতর জনগণকে শামিল
করতে হবে ব্যাঙ্ককর্মীদের
নিজস্ব প্রতিনিধি
কলকাতা, ১২ই জানুয়ারি— দেশজোড়া জনরোষের কারণেই সংসদে এফ আর ডি আই বিল পেশ করা নিয়ে পিছু হটেছে সরকার। আন্দোলনের জেরেই ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে সময়। বাজেট অধিবেশনের পর বর্ষাকালীন অধিবেশনে পেশ হতে পারে দানবীয় এফ আর ডি আই বিল। মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাপকতর জনগণকে শামিল করে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের উত্তাল আন্দোলন রুখতে পারে এই কালা আইনকে। শুক্রবার মহাজাতি সদনে ‘পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক শ্রমিক ইউনিয়নের’ নবপর্যায়ের ২৩তম সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে একথা বলেন সি আই টি ইউ-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন।
কোনও রাজনৈতিক দলের সমাবেশ নয়। কেবলমাত্র একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মচারী ইউনিয়নের সম্মেলনের সমাবেশ। তিল ধারণের জায়গা ছিল না মহাজাতি সদনে। প্রেক্ষাগৃহের দোতলা, তিনতলাও ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। ‘পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক শ্রমিক ইউনিয়ন’-র শুধু সম্মেলন প্রতিনিধিরাই নন, রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন ইউনিয়নের সাধারণ সদস্যরাও।
ভিড়ে ঠাসা সমাবেশে তপন সেন বলেন, ব্যাঙ্ক কর্মচারী সহ সামগ্রিক শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতিবাদ আন্দোলনের জেরেই উদারীকরণ পরবর্তী সময়ে নয়া উদারনীতির আগ্রাসী অভিযানকে খানিক শ্লথ করা গেলেও অভিমুখের পরিবর্তন করা যায়নি। অর্থনীতির অভিমুখ পরিবর্তন করতে গেলে প্রতিবাদ আন্দোলনকে প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত করা জরুরি। ট্রেড ইউনিয়ন মানে শুধু কমিটি নয় বা গুটিকয়েক কর্মকর্তা নয়। আজকের সময়ের কঠিন চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে হলে ইউনিয়নের গোটা শরীরজুড়ে একসাথে লড়তে হবে। নেতারা ট্রেড ইউনিয়নের মস্তিষ্ক, কিন্তু সাধারণ সদস্য সবাইকে নিয়েই গোটা ইউনিয়ন। নয়া উদারনীতির সামগ্রিক বিপদ রুখতে হলে প্রয়োজন ব্যাঙ্কের প্রতিটি শাখার শেষ কর্মচারীটিকে পর্যন্ত লড়াই আন্দোলনে শামিল করা, সামগ্রিক লড়াই আন্দোলনে যুক্ত করা।
এদিনের সমাবেশে তপন সেন বলেন, নতুন প্রজন্মের ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন আজকের ব্যাঙ্ক শিল্পের সংকট বা ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ কোনটাই বিমূর্ত ঘটনা নয়। আন্দোলনের ফসল হিসাবেই ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, কয়লা জাতীয়করণ, খনি জাতীয়করণ হয়েছিল। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। আটের দশকের মধ্যভাগ থেকেই ভারত তার স্বয়ম্ভর অর্থনীতি থেকে সরে আসতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে ঘোষণা করে বলা হয় দেশ উদারীকরণ, বেসরকারিকরণের, বিশ্বায়নের পথে হাঁটবে। শাসকশ্রেণির পক্ষ থেকে এমন যুক্তিও হাজির করা হয়েছিল সারা বিশ্বের অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত হবে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু পুরোটাই হয়েছে একতরফা। দেশের অর্থনীতি উন্মুক্ত করা হয়েছে বিদেশি বহুজাতিকদের জন্য। দেশের উৎপাদন কমিয়ে বিদেশি দ্রব্যের লাগামছাড়া আমদানি দেশের অর্থনীতির কাঠামোকে ধ্বংস করেছে। সেই সময় অনেক প্রগতিশীল পণ্ডিতরাও উদারনীতির মধ্যে বিকাশের রাস্তা খুঁজেছেন। এখন তাঁরাও বুঝছেন উদারনীতির সংকট। দুনিয়াব্যাপী লগ্নিপুঁজিই সংকটে, সংকট ক্রমশ দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিতে চলেছে। আজ দেশের ব্যাঙ্কিং শিল্পও আক্রান্ত। কর্পোরেটদের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ এগারো লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একই সঙ্গে বলবার চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে বাঁচানোর জন্য সরকারকে জাতীয় কোষাগার থেকে টাকা ঢালার দরকার নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মূলধন পুনর্গঠনের নামে ব্যাঙ্কের ইক্যুইটি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে বেসরকারিকরণের রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে। জনগণকে বোঝাবার চেষ্টা চলছে ব্যাঙ্কে সঞ্চয় করে লাভ নেই, ক্রমাগত কমানো হয়েছে ব্যাঙ্কের বিভিন্ন সেভিংস প্রকল্পের সুদ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ইতিমধ্যেই বলা শুরু হয়েছে ঋণখেলাপিদের বকেয়া পর্বত প্রমাণ ঋণমকুব করে দেওয়া হোক। সরকারের আনা ‘ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোড’-এর মাধ্যমে অনাদায়ী কর্পোরেট সংস্থাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে সংস্থাগুলির সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ আদায়ের সুযোগ রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এসার, ভূষণ স্টিল সহ দশটি সংস্থার তালিকা তৈরি করলেও তাদের ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না, উলটে বলার চেষ্টা চলছে প্রদত্ত ঋণের ‘হেয়ার কাট’ করো। কর্পোরেট সংস্থাগুলি যা ঋণ নিয়েছে, কিছুটা মকুব করে ফেরত নাও। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা বেমালুম গায়েব করার জন্য সরকার এফ আর ডি আই বিল আনতে চলেছে। ব্যাঙ্ক শিল্পে এই আঘাত নেমে আসার আড়ালে রয়েছে সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদের সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। উৎপাদনে মুনাফা কমার ফলে সংকট থেকে উদ্ধার পেতে পুঁজিবাদ সরাসরি সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে লুট করতে চাইছে। ব্যাঙ্ক শিল্পের সংকট দুনিয়াব্যাপী আর্থিক সংকটের সামগ্রিকতারই অংশ এই উপলব্ধি নিয়ে যেতে হবে প্রতিটি ব্যাঙ্ক কর্মচারীর মধ্যে। আগামীর জোরদার লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই সরকারকে শুধু পিছু হটানো নয়, অর্থনীতির অভিমুখ পরিবর্তন করা সম্ভব। বেফি-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বিশ্বাস বলেন ব্যাঙ্কের নতুন প্রজন্মকে লড়াই আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে সংগঠনকে সজীব রাখতে। উদারনীতির আড়াই দশকে ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা পঞ্চাশটিরও বেশি ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য। আগামীতেও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে রুখতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ধ্বংস করার চক্রান্ত। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি অশোক দাস প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি অমিতাভ দে।
পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক শ্রমিক ইউনিয়নের ২৩তম সম্মেলন এদিন দুপুরে শুরু হয় সংগঠনের রক্ত পতাকা উত্তোলন ও শহীদবেদীতে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে। সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি অমিতাভ দে। রবিবার পর্যন্ত সম্মেলন চলবে।