ফুঁসছে নদী, দুর্যোগে ধ্বস্ত উত্তর ভারত
-
সংবাদ সংস্থা
- Aug 20, 2019 12:17 [IST]
- Last Update: Aug 20, 2019 03:00 [IST]
নয়াদিল্লি, ১৯আগস্ট— অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে উত্তর ভারতে বন্যা পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠেছে। সোমবার দিল্লি, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। উদ্ধার অভিযানে সেনা নামানো হয়েছে পাঞ্জাব, হরিয়ানার মতো বেশ কয়েকটি রাজ্যে। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে একদিকে যেমন মৃত্যু বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে নিখোঁজের সংখ্যা। সোমবার বিকাল পাঁচটায় হাথিনী কুণ্ড বাঁধ থেকে ৮.১৪লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ার পরে যমুনা নদীর জল বিপদসীমা প্রায় স্পর্শ করে ফেলায় বন্যার ভ্রুকুটি খোদ দিল্লির নিচু অঞ্চলগুলিতে। এর মধ্যেই আচমকা বরফ পড়তে শুরু হওয়ায় হিমাচল প্রদেশের লাহুল-স্পিতি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে কমপক্ষে ৮৯৭জন পর্যটক আটকে রয়েছেন বলে খবর মিলেছে। রবিবার রাতে হঠাৎ ধস নামায় আপাতত স্থগিত হয়ে গিয়েছে কৈলাস-মানস সরোবর যাত্রাও। এদিকে, দক্ষিণ ভারতের কেরালায় আরও কয়েকটি দেহ উদ্ধার হওয়ায় সাম্প্রতিক বন্যা এবং ধসে সেরাজ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২১। মালাপ্পুরমের কাভালাপ্পারা এবং ওয়েনাডের পুথুমালায় ধসের তলায় চাপা পড়া মানুষের দেহ খুঁজতে বিশেষ প্রযুক্তির রাডার কাজে লাগানো হয়েছে। গত ৮আগস্ট কেরালার এই দুই পার্বত্য জেলায় মারাত্মক ধস নেমে দু’টি গ্রাম কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
অসময়ে বরফপাত শুরু হওয়ায় হিমাচল প্রদেশের লাহুল-স্পিতি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এখনো কমপক্ষে ৮৯৭জন পর্যটক আটকে রয়েছেন বলে সোমবার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। পর্যটকদের দ্রুত নিরাপদ জায়গায় তুলে আনার সমস্ত ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর। সরকারি সূত্রের খবর, বরফপাতের কারণে লাহুল-স্পিতিতে মোট ১১৫০জন পর্যটক আটকে পড়েছিলেন। এর মধ্যে ২৫৩জনকে ইতিমধ্যেই উদ্ধার করা গিয়েছে। সোমবার নতুন করে আরও ৩জনের দেহ মেলায় পাহাড়ি রাজ্য হিমাচল প্রদেশে শনিবার থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির জেরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হলো ২৫। নিহতদের মধ্যে নেপালের ২নাগরিকও রয়েছেন। জানা গিয়েছে, সিমলায় ৯জন, সোলানে ৫জন এবং কুলু, সিরমৌর, ছাম্বায় ২জন করে, উনা ও লাহুল-স্পিতি জেলায় আরও ১জন করে মারা গিয়েছেন। জখম হয়েছেন আরও অন্তত ৯জন। সিমলার আরটিও অফিসের কাছে ধস নেমে প্রাণ গিয়েছে ৩জনের। বিপদ আরও বাড়িয়ে বৃষ্টি চলবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। এর মধ্যেই বিপাশা এবং শতদ্রু নদীর প্রবল জলস্ফীতির কারণে পান্ডো এবং নাথপা ঝাকরি বাঁধের গেটগুলি খুলে দেওয়া হয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মানুষকে নদী, শাখানদী বা নদীবাঁধের কাছে যেতে মানুষকে বারণ করেছে প্রশাসন। রেললাইনে ধসের একাধিক ঘটনার জেরে সোমবার সিমলা-কালকা রুটে ট্রেন চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। পরপর বিপজ্জনক ধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছে রাজ্যের বহু সড়ক। এখনো অসংখ্য মানুষ নানা জায়গায় আটকে রয়েছেন বলে খবর। তাঁদের উদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে প্রশাসন। বৃষ্টির জন্য কাঙড়া জেলায় পানীয় জল সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। একটানা বৃষ্টির কারণেই সিমলা এবং কুলুর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ রাখা হয়েছিল এদিন।
একটানা ভারী বৃষ্টিতে উত্তরাখণ্ডে এপর্যন্ত ১৩জনের প্রাণহানির খবর এসেছে। সন্ধান মিলছে না আরও ২২জনের। উত্তরকাশী জেলার মোরি ব্লকে আচমকা মেঘভাঙা বৃষ্টির তোড়ে আরাকট, মাকুরি এবং তিকোচির মতো অনেকগুলি গ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেরাদুন জেলায় এক মহিলার গাড়ি নদীতে পড়ে গেলে জলের স্রোতে ভেসে যান তিনি। সরকারি সূত্রের খবর, হরিদ্বারে গঙ্গা বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। সোমবার দুপুরে ঋষিকেশে গঙ্গার জলের স্তর ছিল বিপদসীমার সামান্য নিচে। এর মধ্যেই কৈলাস-মানস সরোবর রুটে ধস নামায় ৫৬জন পর্যটকের ১৭তম দলটিকে লামারি থেকে ধারছুলা বেস ক্যাম্পে ফিরিয়ে এনেছে প্রশাসন। এদিন পিথোরাগড়ের জেলা শাসক ভিকে জোগদান্দে এখবর দিয়ে জানান, প্রবল বৃষ্টিতে রবিবার রাতে ওই রুটে ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাস্তা পরিষ্কার করতে অন্তত দু’-তিনদিন সময় লাগবে। তিনি আরও জানান, দিল্লি থেকে পর্যটকদের ১৮তম দলটিরও শিগগির এসে পড়ার কথা। তাঁদের যাত্রাসূচি পিছিয়ে দেওয়ার বার্তা পাঠানো হয়েছে।
উত্তর প্রদেশে গঙ্গা, যমুনা, ঘাগরা সহ আরও বেশ কয়েকটি নদী ফুঁসছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় জল কমিশন। বাদাউন, গড়মুক্তেশ্বর, নারাউরা এবং ফারুখাবাদে গঙ্গার জল বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। একইভাবে পালিয়াকালান অঞ্চলে সারদা নদী এবং এলগিনব্রিজে ঘাগরা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করে বইছে। প্রতিবেশী রাজ্যগুলির বন্যার জলে এরাজ্যের বেশ কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কোটা জলাধার থেকে এদিন অতিরিক্ত জল বের করে দেওয়ায় এটাওয়ার প্লাবিত একটি গ্রামে অংশু নামে ষোল বছর বয়সি এক কিশোর ভেসে গিয়েছে বলে খবর মিলেছে। বন্যার কারণে এটাওয়ার অন্তত ১২টি গ্রাম জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা শাসক জিতেন্দ্র বাহাদুর সিং।
গত বাহাত্তর ঘণ্টা অঝোর বৃষ্টির জেরে বেহাল পাঞ্জাবের রূপনগর, পাঠানকোট, গুরদাসপুর, জলন্ধর জেলায় উদ্ধারের কাজে সেনা ও বিমান বাহিনী নেমেছে। সেনা নামানো হয়েছে হরিয়ানাতেও। বৃষ্টির জল ভাকরা বাঁধের ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে। পাঞ্জাবের আওল গ্রামে এদিন একটি বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়লে পরিবারের ৩সদস্যই প্রাণ হারান। বিপাশা নদীর জলে গুরদাসপুর জেলার একটি গ্রাম প্লাবিত হলে সেখানে আটকে পড়া ৪মহিলা সহ ১১জনকে উদ্ধার করা হয়। চণ্ডীগড় থেকে সড়কপথে বন্যাক্লিষ্ট রূপনগর জেলায় গিয়ে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং এদিন এক জরুরি বৈঠকে বন্যাপরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। ক্ষয়ক্ষতিকে ‘নজিরবিহীন’ আখ্যা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ১০০কোটি টাকার জরুরি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
টানা বৃষ্টি এবং হরিয়ানার হাথিনী কুণ্ড বাঁধ থেকে ৮.১৪লক্ষ কিউসেক জল ছাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে যমুনা নদীর জল বিপদসীমার কাছাকাছি চলে আসায় দিল্লি শহরে বন্যার সতর্কতা জারি করেছে রাজ্য সরকার। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল সোমবার এখবর দিয়ে জানান, শহরের নিচু এলাকার বাসিন্দাদের দ্রুত সরকারি আশ্রয় শিবিরে সরে যেতে বলা হয়েছে। নিরাপদ জায়গায় তৈরি ২হাজার সরকারি তাঁবুতে ইতিমধ্যেই ১০হাজার মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় যমুনার জল ২০৩.৩৭মিটার উচ্চতায় বইছিল। কিন্তু হাথিনী কুণ্ড বাঁধের বাড়তি জলে এই স্তর সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ২০৫.৩৬মিটার অতিক্রম করেছে। এজন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে যমুনার ওপরে ওল্ড আয়রন ব্রিজের রেল ও যান চলাচল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন।
জম্মুতে খরস্রোতা তাওয়াই নদীতে আটকে পড়া ৪জন মৎস্যজীবীকে এদিন সাফল্যের সঙ্গে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন ভারতীয় বায়ুসেনার জওয়ানরা। জানা গিয়েছে, আচমকা ভারী বৃষ্টিতে তাওয়াই অশান্ত হয়ে উঠলে নদীর বুকেই মৎস্যজীবীদের জীবনহানির আশঙ্কা তৈরি হয়। ঘটনায় দ্রুত হস্তক্ষেপ করে হেলিকপ্টারের সাহায্যে কার্যত দুঃসাহসিকভাবে জওয়ানরা দু’দফায় তুলে আনেন তাঁদের। এদিকে, ধসের কারণে টানা তিনঘণ্টা বন্ধ থাকার পরে উধমপুর জেলায় জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়ক এদিন ফের খুলে দেওয়া হয়েছে। খারি পাসি অঞ্চলে ধস নামায় সকালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই সড়কপথ।
সহনক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় সোমবার ওডিশার হীরাকুঁদ বাঁধের সাতটি গেট খুলে অতিরিক্ত জল বের করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এদিন বৈতরণী নদীর জল বিপদসীমা অতিক্রম করায় কেওনঝড় এবং জাজপুর জেলা প্রশাসনকে সতর্ক করে দিয়েছে ওডিশা সরকার। তবে রাজস্থানে গত কয়েকদিনের বন্যায় ৪৯জনের মৃত্যু হলেও সোমবার আর নতুন করে পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। বরং বেশির ভাগ জায়গা থেকে বন্যার জল জল নামতে শুরু করেছে বলে সরকারি সূত্রের খবর।