কালজয়ী শতবর্ষের সত্যজিৎ
-
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
- May 02, 2022 16:41 [IST]
- Last Update: May 02, 2022 16:41 [IST]
পরিচালক গৌতম ঘোষের সন্ধানে এসেছিল সত্যজিতের খেরোর খাতা। পাতা ভরা রং-চিত্রে ভরে আছে হাজারো কল্পিত ইমেজ। ছবির কম্পোজিশান থেকে তাঁর সৃষ্ট বিভিন্ন সিনেমায় চরিত্রগুলোর বর্ণিত প্রতিরূপ – পোশাক, সাজসজ্জা, সেট অলংকরণ থেকে কেশসজ্জা ও মেকআপ। গৌতমবাবু লিখেছেন, “ ‘পথের পাঁচালী’র খেরোর খাতা ছিল না। শুরু হয় 'অপরাজিত' থেকে 'আগন্তুক' পর্যন্ত। খাতাগুলো একেকটা ছোটখাট ওয়ার্ক স্টেশনের মতো। ফ্রেম-আঁকা শটের পর শট সাজানো চিত্রনাট্য তো আছেই। এছাড়া আরও কত কি! সেটের স্কেচ, প্রপ লিস্ট, পোশাক-পরিচ্ছদের ডিজাইন, ছবির লোগো, কোথাও আবার থিম মিউজিকের একটা ফ্রেজ। এছাড়া বিভিন্ন পর্বে অন্তরের অন্তরতম অনুভূতির লিখিত প্রকাশ। অতি স্বল্প পরিসরে । যেমন একটি নদীতটের লাইন-ড্রয়িঙের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সিলিউট একটা আকৃতি। তলায় লেখা‘|| এখন তোমাকে চাই ||’ আবার কোনও একটি খাতায় লেখা, ‘|| জানিনা ||’বা‘|| আমি জানি না || ‘জানার ও শেখার কি প্রবল হাহাকার করা আর্তি।’’
সত্যজিতের এই শিল্প মনন তৈরি হওয়াটাও যেন অনায়াসে অভ্যস্ত এক প্রায়োগিক চর্চা। মানুষের বেড়ে ওঠার নানান আধারে চর্চাপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়ায় এবং দৃশ্যমান মানব জীবন থেকে আহরিত ইমেজকে সঙ্গী করে বেড়ে ওঠা সত্যজিতের শিল্পমানসের পটভূমি তৈরি করেছিল, সন্দেহ নেই।
সাংস্কৃতিক চেতনার প্রবহমানতা
শৈশব থেকে কৈশোরকালে পৌঁছানোর অধ্যায়গুলো নিজেকে উন্মুক্ত পৃথিবীর সঙ্গে রঙে রেখায় গানে গল্পে জারিত করার সময়টুকুতে সত্যজিতের পরম সঙ্গী ছলেন সুপ্রভা দেবী। মানিকের প্রিয় মা। না দেখা জিনিসের প্রতি শিশুদের একটা অমোঘ টান থাকে। দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত ঠাকুরদাদার কাঠের বাক্সে না জানি কী লুকিয়েছিল অমূল্যরতন। ঝেড়ে ঝুড়ে বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এসেছিল ঠাকুরদাউপেন্দ্র কিশোরের ছেড়ে যাওয়া ছবি আঁকার অবশিষ্ট রঙের শিশি, শক্ত জমাট বাঁধা নানান বাহারি তুলি আর তেল রঙের কাজে ব্যবহারের জন্য লিনসিড তেলের পাত্র। উত্তরাধিকার হিসাবে এই অতি ক্ষুদ্র প্রাপ্তিগুলো কিছুটা বদলে দিয়েছিল মানিকের জীবনচরিত।
সাংস্কৃতিক প্রবহমানতা বোধহয় একেই বলে। বাটি – গড়পার রোডের নম্বর ১০০। বাদ্যযন্ত্রী ও সঙ্গীত সাধক ছিলেন উপেন্দ্র কিশোর। গড়পারের বাড়িটি আচ্ছন্ন থাকত উপেন্দ্রকিশোরের বেহালার সুর মূর্ছনায়। রং-তুলি থেকে সাহিত্যচর্চা আর সঙ্গীত, রায় পরিবারের সাথে মিলেমিশে একাকার ছিল।
ছাপার অক্ষরেই মানিক খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর অকালে ছেড়ে যাওয়া বাবা— সুকুমারকে। ভরা জোয়ার তখন বাংলার নবজাগরণে। ইউরোপীয় শিক্ষা, পাশ্চাত্য আধুনিকতা আর প্রাচ্য জ্ঞানের মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী সেই সময়। উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার। ফটো এনগ্রেভিং আর লিথো প্রিন্টিং তখন হালফিলের চল। স্বলিখিত পুস্তক স্বমুদ্রণ করাটাই তো পারিবারিক ব্যবসায়িক প্রথা ছিল। সেই রীতি মেনে সুকুমার তারই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
সুকুমার রায় তাঁর কল্পনায় তৈরি ‘ফুটোস্কোপ’ দিয়ে অনেকের মগজে আলোকপাত করতে চেয়েছিলেন তাঁর সীমাহীন কল্পলোকের জগৎকে, তাঁর রচিত আপাত অর্থহীন পদ্যগোষ্ঠী ‘আবোল তাবোল’-এর মতো জিবেরিশ-এর মধ্যে দিয়ে। রসে বশে কৌতুকে সে সময়ের বাংলা সাহিত্য ভরাটই ছিল। তবু সুকুমার ছিলেন অদ্বিতীয়।
মায়ের দিক– অতুল প্রসাদ সেনের পারিবারিক দিক, কালী নারায়ণ গুপ্তের পারিবারিক দিক। কালী নারায়ণ গুপ্তের দাদামশাই ছিলেন অতুল প্রসাদ। আর তাঁর পৌত্রী ছিলেন সত্যজিৎ-মাতা সুপ্রভা। ফলে গান, গায়কি যে তাঁর সহজাত হবে, এটা ভাবাই যায়।
সত্যজিৎ যখন জন্মালেন, সিনেমা নামক অত্যাশ্চর্য মাধ্যমটির বয়স তখন বছর পঁচিশের আশপাশ। ছোটখাট কিছু বাস্তব প্রেক্ষিতকে সেলুলয়েডে গ্রথিত করবার যে অনুশীলনকে ঘিরে বায়োস্কোপের সূত্রপাত হয়েছিল, মানুষের কাছে সামাজিক বা রাজনৈতিক বার্তাবাহক হিসাবে তখনও সেভাবে মেলে ধরতে পারেনি। প্রেসিডেন্সি কলেজে সত্যজিতের অর্থনীতি অধ্যয়ন তাঁর জীবনে এক অনভিপ্রেত পাঠমালা। মায়ের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে ১৯৪০-এ সত্যজিত গেলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। এ সময়টায় কলকাতা বিচ্ছেদে সাময়িক অভিমানী তিনি হয়েছিলেন— বড় পিছুটান ছিল তাঁর পার্ক স্ট্রিট আর কলেজ স্ট্রিটের বই মোড়ানো রাস্তাগুলো, হলিউড ছবি রিলিজের জন্য নির্দিষ্ট প্রেক্ষাগৃহগুলো, ফ্রী স্কুল স্ট্রিটের পাশ্চাত্য ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীতের দোকানের পাটগুলো। তবু যাচ্ছেন তিনি কলাভবনে, নতুন কিছু প্রাপ্তিকে আবাহন করতে।
সত্যজিতের শান্তিনিকেতন
চার ফুট বাই তিন ফুটের ক্যানভাসে ময়ূরপেখমের মতো রং ছড়িয়ে পড়ল বলিষ্ঠ হাতের ব্রাশ স্ট্রোক। রঙিন হলো ক্যানভ্যাস। ছবি প্রকাশিত হলো। প্রকৃতি, পৃথিবী, মানুষ আর তাদের দিন-প্রতিদিনের ক্লান্তিহীন কাজ-ধারা। সত্যজিৎ অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর প্রিয় আঁকার মাস্টার মশাই বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে। এক চোখ দৃষ্টিহীন, অন্য চোখ আক্রান্ত মায়োপিয়ায়– সম্মুখের রঙিন পৃথিবী আবছারূপে প্রতিভাত। তবু মনের অলিন্দে বেঁচে থাকা অবদমিত চিত্রপট মন ঠিকরে বেরোয় শিল্পীর কল্পলোকের সিন্দুক থেকে – সত্যজিৎ তারিয়ে তারিয়ে তার নির্যাস নিলেন। নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকার তালিম পাওয়া যে কোনও শিল্পীমানসের সর্ববৃহৎ প্রাপ্তিগুলোর একটি– সন্দেহ নেই। সত্যজিৎ যখন কলাভবনে, তখনও রবি ঠাকুর বেঁচে। শেষবেলার জীবন। কিন্তু শান্তিনিকেতনে তাঁর উপস্থিতিটাই এত নৈসর্গিক, এত স্বপ্নমেদুর, যা একটা সত্তাকে সামগ্রিকতার রূপ দেয়। তপোবনের মতো আশ্রমিক শিক্ষাপাঠ সত্যজিতের কাছে জীবনকে নতুন ভাবে দেখার এক দুর্লভ দর্শন-সত্তার জন্ম
“সত্যজিতবাবুর ছবির প্রতিটা ফ্রেম-ই তো পেন্টিং।”
ওয়াসিম কাপুরের এই অকপট স্বীকারোক্তি অনেকেরই অন্তরতম মন-কথা। এই যে সত্যজিত রায়ের ছবির সঙ্গে পেন্টিংয়ের অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যাওয়া, কোনও চিত্রপটকে সেলুলেয়েডের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা – সত্যজিৎ রায়ের এই প্রাপ্তির অনাদি আকাশ বিরচিত হয়েছিল কলাভবনেই? সন্দেহ নেই, দেশীয় চিত্রকলার কাব্যগাথা এই কলাভবনেই যেমন পেয়েছিলেন আচার্য নন্দলালের কাছ থেকে, বিনোদবিহারীর কাছ থেকে শিখেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্পকলার বৈচিত্র আর টেকনিকের তারতম্য, রামকিঙ্করকে তিনি দেখেছিলেন ভাস্কর্য শিল্পে কীভাবে গতি, ছন্দ আর বলিষ্ঠতা আনা যায়।
অধ্যাপক অ্যারনসন আদতে ইহুদি, নাৎসি উৎপীড়নে জার্মান দেশ ছাড়া হয়ে শান্তিনিকতনের রবীন্দ্র আশ্রমে সেবক হলেন। মুগ্ধ সত্যজিত তাঁর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অনুরাগে আর চর্চায়। সান্ধ্য আসরে সঙ্গীতের মধ্যে মন ডোবাতেন সত্যজিত। রবীন্দ্রভবনে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবীর রক্ষিত পিয়ানোয় বেজে উঠতো বাখ, বীথোভেন, শপ্যাঁরসুর-তান।সে সুরগুলো বড় প্রিয় ছিল সত্যজিতের।
আবার কলকাতা – বিজ্ঞাপনী জগৎ ও প্রচ্ছদ অলঙ্করণ
সাদা কালো ছায়াছবির পর্দা জুড়ে কালো অস্টিন গাড়ি চেপে সত্যজিত মধ্য কলকাতা দেখছিলেন পরম আবেগময়তায়। সাক্ষাৎকারীকে বলেই ফেললেন– এই শহরেই তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। এই শহরই তাঁর সাংস্কৃতিক উৎস ও আধার। কলাভবনের পাঠশিক্ষার আসর অসমাপ্ত রেখে সেই শহরেই ফিরলেন তিনি চাকরির সন্ধানে। বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারেরঅফিস ছিল ফ্রী স্কুল স্ট্রিটে। জুনিয়ার ভিস্যুয়ালাইজার হিসাবে সত্যজিতের চাকরি হলো সেখানেই। চলতি বিজ্ঞাপনী প্রথা-বিমুখ সত্যজিতের কৃত নতুনতর চিন্তন তাঁকে বিজ্ঞাপনের জগতে শীঘ্রই প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় করে তুলেছিল। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টি এবং উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা তাঁকে এক্ষেত্রে স্বকীয়তা এনে দিয়েছিল। যে কোনও অলঙ্করণে ‘ডিটেলিং’ চোখে পড়ার মতো। বিশ্ব প্যালুড্রিনদিবসের জন্য তিনি এই সময়ে সংস্থাটির হয়ে যে ক’টি ছবি এঁকেছিলেন, সেগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক স্তরের পারিবারিক দৃশ্য ও তার খুঁটিনাটি।
সিগনেট প্রেসের হয়ে বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ ও থিমেটিক অলঙ্করণ ও বাংলা হরফের নানান ক্যালিগ্র্যাফিক পরিবেশন বইগুলোকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছিল। এক্ষেত্রে স্মরণীয় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘পরমপুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ’, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’, জিম করবেটের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ আর সর্বোপরি ‘আম আঁটির ভেঁপু’ (‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ)। তিনি ক্যালিগ্রাফির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। নির্মাল্য সেনগুপ্ত ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ পত্রিকার জন্য সত্যজিতের প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ছাড়াও পারিবারিক ঐতিহ্য বহনকারী ‘সন্দেশ’ পত্রিকা (যা তিনি ১৯৬০ সালে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন) এবং তাঁর নিজস্ব লিখিত ‘ফেলু দা’, ‘প্রফেসর শঙ্কু’,বা আরো কত গল্প-কাহিনি-উপন্যাসে তিনি তাঁর বাংলা হরফশিল্পের বৈচিত্রময় ভাণ্ডার গ্রন্থিত করে গেছেন– তার তুলনা মেলা ভার।
সত্যজিতের লেখনী
শরদিন্দু-উত্তর বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির ভাটার টানে কিশোর মনের চাহিদা মেটানোর কথা মাথায় রেখে সত্যজিতের হাত ধরে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর প্রদোষ মিত্র তথা ‘ফেলু দা’-র উত্থান কাহিনি সবারই প্রায় জানা। সত্যজিতের লেখনী ছিল অত্যন্ত সাবলীল আর ঝরঝরে। সিনেমার ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য রচনার সময়ে তিনি যেমন যত্ন নিয়ে নাটকীয় মোড়গুলোকে পরতে পরতে মেলে ধরে একটা ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে যেতেন, তেমনি তাঁর সৃষ্ট সব রকমের কাহিনি বা গল্পগুলোতে সেই নাটক এবং টেনশানের দ্বৈততা অনুসরণ করে। তাই লেখাগুলো সুখপাঠ্য এবং শিশু-কিশোর থেকে বয়স্ক পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন। সায়েন্স ফিকশনের ধারার প্রতি তার আজীবন মুগ্ধতা প্রফেসর শঙ্কুকে জন্ম দিয়েছে, একজন চমকপ্রদ মধ্যবয়সি বিজ্ঞানী যার উদ্ভাবনের আশ্চর্য পরিসর রয়েছে।
সত্যজিতের সিনেমা
“শান্ত অথচ গভীর পর্যবেক্ষণ, বোধগম্যতা আর মানব জাতির প্রতি ভালোবাসা, যা তাঁর (সত্যজিতের) সব চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য, আমাকে মুগ্ধ করেছে।…আমি মনে করি, তিনি চলচ্চিত্র জগতের এক কিংবদন্তী। রায়ের সিনেমা না দেখা মানে উপস্থিত পৃথিবীতে সূর্য বা চাঁদ না দেখা। ‘পথের পাঁচালী’ দেখার পর আমার উত্তেজনা কখনোই ভুলতে পারি না। এটি এমন একটা সিনেমা যা বহতা নদীর নির্মলতা ও আভিজাত্যের সাথে প্রবহমান। মানুষ জন্মায়, তাদের জীবনকে নিয়ে বাঁচে আর তারপর মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। ন্যূনতম প্রচেষ্টা ছাড়া আর আকস্মিক ধাক্কা ছাড়াই রায় তাঁর ছবি এঁকেছেন কিন্তু দর্শকদের কাছে এর প্রভাব গভীর আবেগকে নাড়া দিয়েছে। কীভাবে তিনি এটি অর্জন করেন? তাঁর সিনেম্যাটোগ্রাফিক কৌশলে অপ্রাসঙ্গিক বা অসংলগ্নতা কিছুই নেই। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের গোপনীয়তা” - খুব সংক্ষেপে সত্যজিতের সিনেমার ব্যাপ্তি আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেগুলোর মান্যতার নিগূঢ় রহস্য উন্মোচিত করে দিয়েছেন আর এক স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া।
ব্রিটিশ সমালোচক ডেরেক ম্যালকমের মতে, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটকের মতো সত্যজিত স্বয়ংসম্পূর্ণ র্যাডিকাল পরিচালক নন। কিন্তু সেলুলয়েডের রিলগুলোতে সত্যজিৎ গ্রথিত করে গেছেন এক অনবদ্য কাহিনিনামা। বিষয়বস্তুর নির্বাচনে, সমগ্র সিনেমাটিতে বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনায় আর নিখুঁত চিত্রনাট্যের রসায়নে তাঁর ছবিগুলো সিনেমাপ্রেমীদের কাছে হয়ে উঠেছে অমৃতসমান। গভীর জীবনবোধের অন্তর্নিহিত অনুভূতিগুলো তিনি খুব সহজভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সব শিল্পপ্রয়োগের সুচারু সমাহার যদি সিনেমাটির নান্দনিক প্রকাশ ব্যাখ্যা করে, সে ক্ষেত্রে সত্যজিত সব দিক থেকেই স্বকীয়তা ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখেন। সেট গঠন ও শিল্প সজ্জায় যেমন জলসাঘর, নায়ক, গুপি গয়েন বাঘা বায়েন, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি থেকে ঘরে বাইরে, পোশাক পরিচ্ছদেও তাই, সিনেম্যাটিক কম্পোজিশান, ফ্রেম নির্বাচন থেকে ক্যামেরা মুভমেন্ট, সিনেম্যাটিক আবহ সঙ্গীত– সব কিছুই সত্যজিত-মোড়া। কাঞ্চনজঙ্ঘার টাইটেল কার্ডে জলরঙে আঁকা দার্জিলিং এ বাঙালি ভ্রমণের ইতিকথা নস্টালজিয়া নয়ে আসে। সমকালীন বাংলার রাজনৈতিক সমাজচিত্র এঁকে গেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী, জন অরণ্য বা সীমাবদ্ধতে। এভাবেই সত্যজিত রায় নিজেকে, নিজের প্রায়োগিক কৌশলে বারবার ভেঙেছেন, নিজেকে বারবার সৃষ্টি করার লক্ষ্যে।
কান, ভেনিস, বার্লিনের উৎসবগুলোর সিনেমার লাল কার্পেটে শেষে তিনি সারা জীবনের সেরা স্বীকৃতি অস্কার পেয়েছেন। শতবর্ষেও কালজয়ী থেকে গেলেন আমাদের প্রিয় সত্যজিৎ রায়।