বাবার ছবিতে ফুটে ওঠা সঙ্কট আজও প্রাসঙ্গিক
-
সন্দীপ রায়
- May 02, 2022 16:41 [IST]
- Last Update: May 02, 2022 16:41 [IST]
স্বৈরাচার, জাতপাত, কুসংস্কার, যুদ্ধবিরতি— একেক সময়, একেকভাবে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি উঠে এসেছে। আজও যা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ওঁর ছবিগুলো এমনই, আজ দেখলে মনে হবে, ঠিক যেন আগের দিনই বানানো। একটি ছবিও যাতে পুরানো না হয়ে যায়, সেদিকে বাবা লক্ষ্য রাখতেন। সেই বিশ্বাস থেকেই একটি ছবির গঠন নিয়ে ভাবতেন। বাবা চাইতেন, বহু বহু বছর পর দেখলেও যেন মনে হয়, এ ছবি তো নতুন। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিখুঁতভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। একটি ছবিতে এমন একাধিক স্তর বাবা তৈরি করতেন, যা বিভিন্ন বয়সে বিভিন্নভাবে অর্থবহ হয়ে ওঠে। ছোটবেলায় যে ছবি মজার মনে হবে, পরিণত বয়সে তা-ই গভীর অর্থ বয়ে আনবে। ছবির ‘রিপিট ভ্যালু’তে বিশ্বাস রাখতেন উনি।
এত বছর আগে বাবা নিজের ছবির মধ্যে দিয়ে যে ভিন্ন বার্তা দিয়ে গিয়েছেন, তা ওঁর বিশেষ ক্ষমতার প্রতিফলন বলেই আমি মনে করি। ভাবলেই বিস্মিত হই, বাবা সেইসময় সিনেমার মধ্যে দিয়ে যে কথা বলতে চেয়েছেন, আজ তা মিলে যাচ্ছে। ঠিক কী চিন্তাভাবনা থেকে এমন সব কালজয়ী সিনেমা তিনি বানিয়েছেন, তা বলা মুশকিল। কিন্তু আমার ভীষণভাবেই মনে হয়, উনি সামনের দিকটা দেখতে পারতেন।
আরেকটা মজার ব্যাপার আমার মনে হয়, বাবা ছবিতে কোনও ‘ফ্যাশন ট্রেন্ড’ মানেননি। ছবির কলাকুশলীদের যে পোশাক পরাতেন, তা কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রতীক হয়ে থাকেনি। একটি ছবির সমস্ত দিকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। যখন কোনও একটি ছবি করতেন, তখন তার মধ্যেই পুরোপুরি ঢুকে যেতেন। অন্য কিছু নিয়ে ভাবতেন না। আবার ছবির শ্যুটিং শেষ হওয়ার পরই থেকেই দেখেছি মন-প্রাণ দিয়ে অন্য কাজে লেগে পড়েছেন।
বাবা যে ঠিক কত কাজ করে গিয়েছেন, তা উনি মারা যাওয়ার পর বুঝতে পারি। কত বিষয়ে কাজ করেছেন, কত কাউকে চিঠি লিখেছেন— সেসব একে একে খুঁজে পাই। আর আশ্চর্য হই। কীভাবে ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’ করে বাবা এত কাজ করেছেন। সত্যজিৎ রায় অবশ্যই একজন মহান স্রষ্টা। এখনও ওঁকে নিয়ে দেশে-বিদেশে চর্চা হয়। বিভিন্ন গবেষণা পত্র লেখা হচ্ছে। বিদেশে ওঁর ছবি দেখানো হচ্ছে। আমরা এখানে রায় সোসাইটি তৈরি করেছি। যার প্রধান কারণ, ওঁর ছবিগুলোর সংরক্ষণ। বহু ছবিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিল। আবার তা পুরানো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বছর দেড়-দুয়েকের মধ্যে একটি ‘ফিল্ম অ্যান্ড স্টাডি সেন্টার’ তৈরির পরিকল্পনাও চলছে। সেখানে ওঁর ছবি দেখা যাবে, সেমিনার হবে, ওঁর লেখা বই এবং ওঁকে নিয়ে লেখা বই থাকবে লাইব্রেরিতে। ওয়ার্ক স্টেশন থাকবে। প্রদর্শনী তো হবেই।
অনেকেই জানতে চান, বাবার সৃষ্টির সংরক্ষণের কাজ করতে গিয়ে কোনও অপ্রকাশিত লেখা পেয়েছি কি না। বাবা যেহেতু ফরমায়েশি লেখাই লিখতেন, তাই সেরকম অপ্রকাশিত কোনও লেখা নেই। তবে খেরোর খাতা, খসড়া এসব পেয়েছিল। ফেলুদা-শঙ্কুর গল্প যেখানে লিখতেন, সেই নোটবুকও রয়েছে। উনি মানুষের মনে বেশিরকমভাবে আছেন ঠিকই, কিন্তু ওঁর সৃষ্টিকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখাই মূল কর্তব্য এখন।