আত্মমর্যাদা রয়েছে শহরের, রয়েছেন প্রিয় মানুষটিও
-
অর্ক রাজপণ্ডিত
- Apr 08, 2021 10:57 [IST]
- Last Update: Apr 08, 2021 10:57 [IST]
শিলিগুড়ি, ৭ এপ্রিল- বাঘাযতীন কলোনির রতনলাল ব্রাক্ষণ মুক্তমঞ্চ থেকে সবে শুরু হয়েছে পদযাত্রা, দু’মিনিট হাঁটার পরেই থমকে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
মালা হাতে বাড়ি থেকে ছুটে এসেছেন গৃহবধূ তাঁর কন্যা সহ, ‘অশোকদা, শিলিগুড়িতে আবার আপনাকে চাই’, উচ্ছ্বাস মা মেয়ের গলায়। আবার ঠিক দু মিনিট হাঁটার পর পরের গলির মোড়ে হাতে গোলাপের তোড়া হাতে কলেজ পড়ুয়াদের জটলা, প্রার্থীকে দেখে ছুটে এসেছেন কমবয়সি ছেলেমেয়েরা। প্রার্থীর হাতে ফুল তুলে দিয়ে আব্দার ‘সেলফি’র জন্য, সেলফি পর্বের পরেই পরিচিত ভরসা, ‘অশোকদা, আবার আপানাকেই চাই শিলিগুড়িতে’।
শিলিগুড়ি শহর আর এই শহরের মানুষদের বহুদিনের চেনা ডাক ‘অশোকদা’ কার্যত সমার্থক। বুধবারের সকালে যখন আড়মোড়া ভাঙছে বাঘাযতীন কলোনির অলিগলি পাড়ার মোড়, বাড়ির জানলা থেকে আবাসনের ঝুলন্ত বারান্দায় অপেক্ষমাণ শিলিগুড়ির নাগরিকরা। বহুতলের আবাসন থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে হাত নাড়ছেন প্রৌঢ় ‘অশোকদা, আপনাকে চাই’, বাড়ির দরজায় বাজারের ব্যস্ততা ভুলে ব্যাগ হাতে তরুণের হ্যান্ডশেক ‘অশোকদা, আপনাকে চাই’।
গোটা বাঘাযতীন কলোনি জুড়ে বুধবারের সকালে একই ছবি। চেনা ছবি যা বছরভর দেখে এসেছে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি বিধানসভায় সংযুক্ত মোর্চার সিপিআই(এম) প্রার্থী অশোক ভট্টচার্যের পদযাত্রা মানে ‘প্রার্থী পরিচিতি’ নয়, সহযোদ্ধা সহনাগরিকদের ভিড়ে তাঁর হেঁটে যাওয়া প্রতিদিনের মতই, চেনা অভ্যাসে, চেনা সখ্যে।
তৃণমূল জমানায় ‘পরিবর্তনের ঝড়’ প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল এই শহরেই, শিলিগুড়িই প্রথম দেখিয়েছিল ‘পরিবর্তনের ঝড়’ থামিয়ে দুর্ধর্ষ প্রত্যাবর্তন। ২০১৫ সালে ফের শিলিগুড়ি কর্পোরেশন পরিচালনার দায়িত্বে বামপন্থীরা, কর্পোরেশনের মেয়র শিলিগুড়ির মানুষের প্রিয় ‘অশোকদা’। পর পর এই শহরেই ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল। মহকুমা পরিষদের নির্বাচনে বিপুল জয় বামপন্থীদের। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ফের পাঁচ বছরের জন্য শিলিগুড়ির বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন অশোক ভট্টাচার্য।
তৃণমূলের আগ্রাসী দখলদারির রাজনীতির বিরুদ্ধে যেমন প্রতিরোধে গর্জে উঠেছে এই শহর, যে শহরে বার বার ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূলের বিজয় রথ, আরও একবার তৃণমূল আর বিজেপি’কে পরাস্ত করতে প্রস্তুত শিলিগুড়ি।
মহানন্দা পাড় থেকে হিলকার্ট রোড, শিলিগুড়ি জংশন থেকে বিধান মার্কেট, প্রধান নগর থেকে দেশবন্ধু পাড়া, হাকিম পাড়া থেকে অরবিন্দ পল্লি, শিলিগুড়ি শহরে এখনও অটুট বামপন্থীদের বহু লড়াইয়ে নির্মিত গণভিত্তি। শিলিগুড়িতে এখনও অটুট উদ্বাস্তু কলোনি থেকে গরিব প্রান্তিক মানুষের বস্তিতে লালঝান্ডার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।
শিলিগুড়ি শহর দেখেছে, দেখেছেন সহনাগরিকরা। স্রেফ রাজনৈতিক কারণে শিলিগুড়ির প্রতি তৃণমূল সরকারের সীমাহীন বঞ্চনা, এও দেখেছে শিলিগুড়ির মানুষকে বঞ্চনার বিরুদ্ধে শিলিগুড়ির মেয়র পৌঁছেছেন কলকাতার মেট্রো চ্যানেলের ধরনায়। শিলিগুড়ির মানুষকে বঞ্চনার বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে বিধানসভায়। নবান্নে। শিলিগুড়ির বঞ্চনার বিরুদ্ধে শিলিগুড়ির মানুষের রাস্তায় নেমে সংগ্রামের কথা জেনেছে, হাজারো বাধা বিপত্তি উড়িয়ে শিলিগুড়িতে বিকল্প কর্মসূচির রূপায়ণের কথা জেনেছে ‘অল ইন্ডিয়া মেয়র কাউন্সিল’। হাজারো বাধা উপেক্ষা করেও শিলিগুড়ির জন্য সংহতি এসেছে ভিয়েতনামের হোচিমিন সিটি থেকে, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে, চীনের বেজিঙ থেকে।
রাজ্য সরকারের প্রকাশ্যে বিরোধিতা, শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের টাকা দিতে প্রকাশ্যে অস্বীকার তবুও শিলিগুড়ির মানুষের স্বার্থে বেপরোয়া একরোখা মেয়র, একগুঁয়ে বিধায়ক। ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা শিলিগুড়ি রাজ্য সরকারের বঞ্চনার মুখোমুখি লড়াই করেছে, ২০১৮ সালের পর থেকে লড়াইয়ের ফলে যখন শিলিগুড়ি কর্পোরেশন কিছুটা পেয়েছে ন্যায্য অর্থ, গরিবের বাড়ি থেকে বস্তি উন্নয়নে ফের সামনের সারিতে শিলিগুড়ি। বঞ্চনার দিনকালে শিলিগুড়ি কর্পোরেশন চুপ করে ছিল না, রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে উন্নয়নের কাজ অব্যাহত থেকেছে শিলিগুড়িতে।
শিলিগুড়ির মানুষ জানেন নিজেদের অভিজ্ঞতায়, আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি শহরের যা কিছু আধুনিক পরিকাঠামো তা সবই বামফ্রন্ট সরকারের সময়, শিলিগুড়ি কর্পোরেশনে বামপন্থী বোর্ডের সময়। শিলিগুড়ি শহরের বিভিন্ন স্থানে ৫০টির বেশি সেতু সবই বামফ্রন্ট সরকারের সময়। ইস্টার্ন বাইপাস, ফুলবাড়ি-ঘোষপুকুর বাইপাস, তৃতীয় মহানন্দ সেতু সবই বামফ্রন্ট সরকারের সময় যাঁর প্রধান নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন পৌর নগরোন্নয়ন মন্ত্রী, শিলিগুড়ির বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য।
বিগত পাঁচ বছরেও শিলিগুড়ির উন্নয়ন মানে শুধুই বলরামনাথ শিশু উদ্যান নয়, সূর্য সেন উদ্যান নয়, মহানন্দার সৌন্দর্যায়ন নয় একই সঙ্গে শিলিগুড়ির গরিব প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে শহরের মহিলাদের ক্ষমতায়ন। প্রতি মাসে প্রায় ২৬হাজার গরিব পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা ভাতা যোগায় শিলিগুড়ি কর্পোরেশন, দশ কেজি করে বিনামূল্যে চাল সরবরাহ করে শিলিগুড়ি কর্পোরেশন।
ক্রীড়া থেকে সংস্কৃতি সব সামাজিক সব ক্ষেত্রেই শিলিগুড়ি কয়েক কদম ফের এগিয়েছে গত পাঁচ বছরে, শিলিগুড়ি তাই ফের নির্বাচনের সময় একরোখা, একগুঁয়ে। শিলিগুড়ির প্রিয় মানুষ ‘অশোকদা’কে হেনস্তা হতে হয়েছে কর্পোরেশনে তৃণমূলের হাতে, হিলকার্ট রোডে হিল্লোল তুলে গর্জে উঠেছে শিলিগুড়ি।
তৃণমূল যেমন জোর করে কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে অর্থের লোভ দেখিয়ে শিলিগুড়িকে দখল করতে চেয়েছিল, একই কায়দা এখন বিজেপি’র। যেকোন ভাবে শিলিগুড়িকে দখল করার, বিজেপি তৃণমূলের দুই দলবদলু প্রার্থীর বিরুদ্ধে তাই লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে টানটান শিলিগুড়ির মানুষ। ‘এবারো আবার শিলিগুড়ির মানুষ জবাব দেবেন, আবার বুঝিয়ে দেবেন জোর করে ভয় দেখিয়ে লোভ দেখিয়ে শিলিগুড়ির আত্মমর্যাদাকে পরাস্ত করা যায় না, যেভাবে তৃণমূলকে হারিয়েছেন শিলিগুড়ির গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ, সেভাবেই বিজেপিকে হারাবেন ফের অশোক ভট্টাচার্যকে জয়ী করে’, বলেছেন সিপিআই(এম) দার্জিলিঙ জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার।
১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯১ এই শহরের পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন অশোক ভট্টাচার্য। ১৯৯১ থেকে ২০১১ টানা কুড়ি বছর এই শহরের বিধায়ক, রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন অশোক ভট্টাচার্য। ‘পরিবর্তনের ঝড়’কে থামিয়ে ফের মেয়র, ফের বিধায়ক। বছরের পর বছর কেন ভরসা রাখেন শিলিগুড়ির মানুষ অশোক ভট্টচার্যের প্রতি? ‘অশোকদার একটাই গুণ, ট্রিপল ইএ, ইজি অ্যাকেসেসেবল, ইজি অ্যাপ্রোচেবল, ইজি অ্যাভেলেবেল, সহজে পাওয়া যায়, সহজে কথা বলা যায়, সহজে আবদার করা যায়, এই কারণেই ফের শিলিগুড়িতে চাই অশোকদাকে’, বলছেন শিলিগুড়ির অলিগলি আনাচে কানাচে প্রতিদিনের পদযাত্রায় ভিড় জমানো এই শহরের সহনাগরিকরা।