সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে সীমান্তের উঠোনে
-
চন্দন দাস
- Feb 24, 2021 10:00 [IST]
- Last Update: Feb 24, 2021 10:00 [IST]
ঠাকুরনগর ,২৩ ফেব্রুয়ারি— ‘‘দেখুন, আমি খুবই অনাগ্রহী এখন মতুয়া বোর্ড নিয়ে।’’
কেন? স্বাভাবিক প্রশ্ন।
মমতা ব্যানার্জির বানানো মতুয়া ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বললেন, ‘‘এত শ্লথ গতি হলে আর কী কাজ হবে? কী হয়েছে আমি জানি না। আমি ডিসইন্টারেস্টেড।’’
ওই ১০ কোটি টাকা কি দেওয়া হয়েছে মতুয়াদের জন্য? প্রশ্ন করা হলো। মুখ্যমন্ত্রী টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
কল্যাণীর তৃণমূলী বিধায়ক, মতুয়া ওয়েলফেয়ার বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান বললেন, ‘‘আমি জানি না। ভোটের আগে আর কিছু হবে বলে মনে হয় না।’’
মতুয়াদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার অপমৃত্যু তাহলে ঘটেছে।
কিন্তু সামাজিক ভেদাভেদের অঙ্ক কি শেষ হয়েছে? তফসিলি জাতির মানুষদের নমশূদ্র, মতুয়া নামে ভাগ করার জন্য মমতা ব্যানার্জির যে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, তার কী হলো?
কিছুটা জবাব মিলবে গাইঘাটার তৃণমূলী বিধায়ক পুলিনবিহারী রায়ের কথায়। মঙ্গলবার বললেন, ‘‘মতুয়াদের আর সেই জোর নেই, বুঝলেন?’’
তাই? কিন্তু কেন? জবাবে বললেন, ‘‘তৃণমূল আর বিজেপি’র মধ্যে মতুয়াদের নিয়ে কাড়াকাড়ি হচ্ছে। আমরা বলছি, আমাদের দলে বেশি মতুয়া। বিজেপি বলছে, ওদের সঙ্গে বেশি মতুয়া। কিন্তু মতুয়া ভোট তিন ভাগ হয়ে যাবে।’’
তিন ভাগ? ভাগ তো দুটো— আপনার দল আর শান্তনু ঠাকুরের বিজেপি। এর মধ্যে তিন নম্বরটি কে?
গাইঘাটা, যেখানে মতুয়া মহাসঙ্ঘের সদর দপ্তর, সেখানকার তৃণমূলী বিধায়ক বললেন, ‘‘না। বাম-কংগ্রেস কিছু পাবে। ওদের পক্ষেও মতুয়াদের একাংশের ভোট যাবে।’’
কেন? এবার পুলিনবিহারী রায় বললেন, ‘‘শুনুন, ওভাবে ভোট হবে না। মতুয়া, নমশূদ্র, তৃণমূল সব এক।’’
মানে? বৃদ্ধ বিধায়ক বললেন, ‘‘তৃণমূলের সবাই কি একদিকে ভোট দেয়? গতবারের লোকসভা নির্বাচনে আমার দলের একাংশের ভোট বিজেপি পেয়েছে। না হলে বিজেপি জিতল কী করে? মতুয়াদেরও সব ভোট কোনও একটি দল এবার পাবে না। তিন ভাগ হবে।’’
তা-ই যদি হয়, তাহলে নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কায় থাকা মতুয়াদের জন্য এত উন্নয়নের ঘোষণা কেন করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি? গাইঘাটার তৃণমূলী বিধায়ক বললেন, ‘‘দেখুন আমি নিজে নমশূদ্র। এবারে আমাদের নির্বাচনের ইস্যু উন্নয়ন। দিদি তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আমাদের জেলা কমিটির সভাতেও তা-ই ঠিক হয়েছে।’’
খুব ভালো। গত দশ বছরে কী কী উন্নয়ন হয়েছে গাইঘাটায়?
বিধায়ক বললেন, ‘‘রাস্তাঘাট হয়েছে অনেক।’’ রাস্তাঘাট তো আগেও ছিল। হয়তো পরে আর কিছু হয়েছে। সরকারের কাজই তো রাস্তা বানানো। এ আর এমন কী উন্নয়ন? বলার মতো কিছু? বিধায়ক হোঁচট খেলেন। কয়েক মুহূর্ত থমকালেন। তারপর বললেন, ‘‘কলেজ হয়েছে। পিআর ঠাকুর কলেজ।’’ কিন্তু সেই কলেজে তো শুধু অনার্স। তারপর আবার বিজ্ঞান বিভাগই নেই। ল্যাবরেটরিতে নোংরা জমে আছে। নতুন একটি স্কুলও গত দশ বছরে গাইঘাটায় হয়নি। বিধায়ক বললেন, ‘‘তা ঠিক। কলেজে বিজ্ঞান চালু হয়নি। আর আমরা মতুয়া বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার কথা বলেছিলাম। তার কাজ হয়নি। তবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’’
‘উদ্যোগ’ খুব জটিল শব্দ। ‘উদ্যোগ’ মানে কাজের ভাবনা? না কি কাজের ঘোষণা? না কি ইট ফেলা বাউন্ডারির?
বিধায়ক বলতে পারলেন না।
তবে গাইঘাটার মনের কথা কিছুটা বললেন রাজ্যের মুখ্যসচিবের সহ আবাসিক।
অনুপ বিশ্বাস। কাঁচা পাকা চুল। উচ্চতা বেশি নয়। চোখে চশমা। কথা বলেন থেমে থেমে, স্পষ্ট। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বাঁক নিয়ে বনগাঁমুখী ট্রেনের লাইন যেখানে এক মনোরম ছবি এঁকে রেখে চলে যাচ্ছে সীমান্তের দিকে, ঠাকুরনগরের গাঁতি গ্রামের সেখানেই একটি রেলগেট। ধানের শরীরে যেভাবে রোদ ঝলক দিচ্ছিল, নিজের যৌবনের সামান্য স্মৃতির কথা বলার সময়ে অনুপ বিশ্বাসের চশমার পিছনে মণিদুটোও কিছুটা তেমনই জ্বলে উঠল। বললেন, ‘‘আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি এখন চিফ সেক্রেটারি, আমাদের সিনিয়র ছিলেন। ওনার সঙ্গে এক হস্টেলে থাকতাম। হিন্দু হস্টেল। আমি গোয়েঙ্কাতে বিকম পড়ছি যখন, উনি এমএ করছিলেন।’’
অনুপ বিশ্বাস গৃহশিক্ষকতা করেন। ২২ জন ছাত্র-ছাত্রীকে পড়ান। সেভেন, এইট, নাইন, টেন। অল্প জমি আছে। সে জমির ধান বিক্রি করেন না। তবে ধানের দামের খোঁজ রাখেন। রেলগেটের পাশে একটি ছোট, সাজানো মণিহারি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘ধানের দাম খুব কম। আর কাজের সমস্যা আছে। এখানে অনেকেই তো বাইরে কাজ করে। মুম্বাই, কেরালা। দুবাই, জার্মানিতেও অনেকে যায়। কাজ নেই তো।’’
তাহলে নাগরিকত্বর প্রশ্ন? বনগাঁ লোকালের নিত্যযাত্রীদের মাথায় গেঁথে থাকা টাইম টেবিলের মতো আমার মাথায় আরএসএস’র দেখানো ভারতীয়ত্বর খোঁজ। চিফ সেক্রেটারির সহ আবাসিক বললেন, ‘‘নাগরিকত্ব শুধু মতুয়াদের বিষয় নয়। আমার বাবা ১৯৪০-এ এখানে চাকরির সূত্রে চলে আসেন। গোপালগঞ্জ থেকে। তারপর আর ফেরেননি। এখানকার অনেকে সাতচল্লিশের পরে এসেছেন। অনেকে একান্নতে বা তারপর এসেছেন। অনেকে একাত্তরে বা তারপরও এসেছেন। তার মধ্যে মতুয়া, নমশূদ্র কিংবা আদৌ তফসিলি নন, এমন অনেকে আছেন। কী করে ঠিক হবে, কে নাগরিক আর কে নন। তবে অনেকেই চিন্তায় আছেন, এনআরসি হলে কী হবে?’’
আশঙ্কা আছে। তার ধাক্কা পড়বে বুঝেই বিজেপি ব্যাকফুটে। অমিত শাহর ঘোষণা— ‘‘সিএএ হবে করোনার টিকা দেওয়ার কাজ হয়ে যাওয়ার পর।’’ সবার মুখেই এক কথা— বিজেপি ব্যাকফুটে। কিন্তু আশঙ্কা যায়নি।
হাওড়ার হোমিওপ্যাথিক কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র প্রণয় রায় বললেন, ‘‘কে নাগরিক, আর কে নয়, কীভাবে ঠিক হবে? শান্তনু ঠাকুরের বিলি করা কার্ড থাকলেই হয়ে যাব নাগরিক? আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এমন ছিল না। তৃণমূলের মতুয়া সঙ্ঘ। বিজেপি’র মতুয়া সঙ্ঘ। এটা ঠিক হয়নি। অথচ দেখুন আমফানের ক্ষতিপূরণের ভাগ, পঞ্চায়েতের কাটমানি তৃণমূল-বিজেপি ভাগ করেই খেয়েছে। গোপন নয়। সবাই জানে। আমাদের সবারই প্রশ্ন, এসবের কী হবে? আমাদের কাজের কী হবে? সেটাই তো আসল।’’
সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভেঙে গিয়েছে, এই কথা বললে বাড়াবাড়ি হবে। আশঙ্কা, প্রশ্ন, দোলাচলে তা আছে। তবে ক্রমশ সেই ফাটল বুজিয়ে মাথা তুলছে কাজের প্রশ্ন।
সিপিআই(এম) নেতা, গাইঘাটায় জন্মাবধি নিঃশ্বাস নেওয়া সত্য কপাট বললেন, ‘‘মিছিলে, সভায় মতুয়ারা তাঁদের বাদ্যযন্ত্র নিয়েই আসতেন। তাঁরা ছিলেন আমাদের মাঝে। এখনও আছেন। ইদানীং বাড়ছেন। শুধু তাঁরা কেন, সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষও আসছেন আমাদের সঙ্গে।’’
গাঁতির তেমনই এক মিছিল বলল— ঠিকই। ব্রিগেড এবার অন্যরকম। অনেক অংশ এবার সেখানে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
প্রমাণ? বিজেপি’র সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের সই করা ‘মতুয়া কার্ড’ দেখাচ্ছিলেন এক প্রৌঢ়া মহিলা। তাঁর ‘মতুয়া পরিচিতিপত্র’। নুয়ে পড়া শুকনো পাতায় ঢাকা চাল সেখানে। আশপাশে গাছ। পাতা সব এলিয়ে দিয়েছে ছায়া নিকানো উঠোনে। ধানের শিষ ছুঁয়ে আসা বাতাস হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল মাথায়, কপালে।
‘দুপুরের ভাত খেয়ে যাও বাবা’— বলছিলেন আমার বাংলাদেশের মা। তাঁর মেয়ে মাম্পি তখন মাঠের কথায় মশগুল— ‘‘কাকু, ব্রিগেডে কী ধামসা নিয়ে যাব?’’
জবাব দিলেন সিপিআই(এম) কর্মী—‘‘আরে হ্যাঁ রে হ্যাঁ। বাস থাকবে। ধামসা, মাদল সব নিয়ে যাবি।’’ যদি তাঁর মৃত্যু না হতো, এই ২৩ ফেব্রুয়ারি, জয়দেব বসু কি থাকতেন সীমান্তের সন্নিকটে এই গ্রামের ব্রিগেড-সম্ভাবনায়? তিনি কি লিখতেন ফের—‘‘উত্তরের নীল তারা দেখে-দেখে তাদের হদিশ যারা খুঁজে নিত, তারা এসে গেছে। প্রিয় বালথাজার, এবার বসন্ত আসছে সম্ভাবনাময় ভারতবর্ষে, এবার বসন্ত আসছে প্রতিশ্রুতি ভারতবর্ষময়।’’