সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে
-
অর্ধেন্দু সেন
- Jul 04, 2020 12:01 [IST]
- Last Update: Jul 04, 2020 12:01 [IST]
স্যর পেশেন্ট এনেছি। একটা বেড পাওয়া
যাবে?
কি হয়েছে?
স্যর করোনা।
আর কি?
স্যর?
আর কি হয়েছে?
না স্যর। আর কিছু হয়নি।
এখানে হবে না ভাই। অন্য কোথাও
দেখুন।
স্যর ঠিক বুঝলাম না।
না বোঝার তো কিছু নেই ভাই। আপনার
পেশেন্ট মরলে কারণ কি দেখাবো?
সত্যিই। প্রস্তরযুগের পরে এতো
স্বচ্ছ প্রশাসন কেউ কোথাও দেখেনি।
ভালোই চলছিল অডিট কমিটি। দু’টো
কারণে উঠে গেল। এক— কিছু লোককে চিরকাল বোকা বানানো যায়। সবাইকে কিছুকাল। কিন্তু
সবাইকে চিরকাল বোকা বানানো যায় না। দুই— কাজটা ছিল কঠিন। করোনা রোগীর নাড়ি ধরে বসে
থাকা আর শেষ মুহূর্তে 'হেপাটাইটিস' বলে চিৎকার করে ওঠা। সোজা কাজ? তাও প্রবীণ চিকিৎসকেরা নিষ্ঠার সঙ্গেই করছিলেন কাজটা।
কিন্তু যখন শুনলেন যে রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী
দেবী কমিটির নাম শোনেননি তখন 'একটু ঘুরে আসি' বলে সেই যে কেউ শ্যামবাজার কেউ ধনেখালি— আর তাঁদের দেখা
পাওয়া যায়নি। বাংলার ইতিহাসে এক লজ্জাজনক অধ্যায়ের অবসান হয়েছে।
একথা বলা যাবে না যে মহামারীর
প্রকোপ লঘু করে দেখাবার প্রচেষ্টা পৃথিবীতে এই প্রথম। রবিনসন ক্রুসো উপন্যাসের
লেখক ড্যানিয়েল ডিফো লন্ডন শহরের ১৬৬৪ সালের প্লেগের ইতিহাস লিখেছিলেন। তখনও দেখা
যায় মৃত্যুর কারণ দেখাতে মনগড়া নানারকম অসুখের নাম দেওয়া হচ্ছে। কোমরবিডিটির
ইতিহাস এতটাই প্রাচীন। তবে একথা ঠিক যে আজকের বাংলায় কোমরবিডিটি যে সম্মান যে
প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা আগে জোটেনি। তবে এই সম্মান হাসপাতাল পর্যন্ত। শ্মশানে অন্য
ছবি।
বোড়ালে দেখা গেল মৃতদেহ সৎকারের সময়
চূড়ান্ত অবহেলা। হুক লাগিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতদেহ। সাধারণ মানুষ মর্মাহত।
রাজ্যপালও তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করলেন ঘটনায়। প্রশাসন বলল করোনায় যারা মৃত তাদের
যথাযথ সম্মান দেখিয়ে পদ্ধতি মেনে সৎকার হচ্ছে। কিন্তু নামগোত্রহীন দাবিদারহীন
অর্ধগলিত শবের বেলায়? যে মরেছে স্রেফ না
খেতে পেয়ে? যার চোদ্দ পুরুষে কারও করোনা হয়নি? কেউ বলবে না তাদের গান স্যালিউট দিতে কিন্তু একটা ন্যূনতম
সৌজন্য তো থাকবে! আশার কথা এই যে ব্যাপারটা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।
সর্বোচ্চ স্তর বলেছেন এক্ষুনি ফাইল পুট আপ করো।
করোনা আমাদের পরিচয় করে দিল পরিযায়ী
শ্রমিকের সঙ্গে। ভারতবর্ষে কোটি কোটি মানুষ কাজের জন্য ঘরছাড়া? কেউ জানতাম আমরা? আমরা জেলায় কাজ করার সময় যাঁরা নিজের গ্রামে খেতমজুর ছিলেন বড়জোর নাবাল খাটতে
বর্ধমান যেতেন তাঁরাই কি বেরিয়ে পড়েছেন রাজ্য ছেড়ে? লকডাউনে তাঁদের বেশিরভাগের উপার্জন শূন্য হয়ে গেল। যাঁরা পারলেন কোনোরকমে থেকে
গেলেন কাজের জায়গায়। যাঁরা পারলেন না চাইলেন বাড়ি ফিরতে। কিন্তু রাস্তা বন্ধ।
আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার জানালেন এরা ফিরতে চাইছিলেন ফেক নিউজের প্রভাবে। আদালত যদি
সত্যি এদের সাহায্য করতে চান তাহলে ফেক নিউজ বন্ধ করুন। তাই করা হলো। এদিকে কোনও
কোনও রাজ্য থেকে বাস পাঠিয়ে কোচিং সেন্টার থেকে পড়ুয়াদের ফিরিয়ে আনা হলো। আমাদের
বাচ্চা আর ড্যাশের বাচ্চা তো এক নয়। সব ছাপিয়ে শুধু সেই মেয়েটার কথা মনে আসে যে
তার আহত বাবাকে সাইকেলে বসিয়ে ১২০০ কিলোমিটার পথে বেরিয়ে পড়েছিল ঘরে ফিরবে বলে।
একটা 'নিচু' জাতের মেয়ের এতো
সাহস?
যারা সকাল সন্ধে হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের স্বপ্ন দেখাতেন
তারাও কি কাটমানি নিয়ে ব্যস্ত?
আমাদের রাজ্যে ৮০ লক্ষ চাকরি হয়েছে।
কৃষকের আয় তিনগুণ হয়েছে। (কেন্দ্র বলেছিল তারও ডবল করবে। আমরা রাজি হইনি।) তাই
আমাদের রাজ্যে এ সমস্যা ছিলই না প্রায়। তাও কিছু শ্রমিক রাজ্যের বাইরে ছিলেন।
কেন্দ্রের টালবাহানায় তাঁদের ফেরাতে অনেক দেরি হয়ে গেল। রাজ্য সরকার উৎকণ্ঠায়।
অডিট কমিটি নেই। সংক্রমণ ঠেকাবে কে? এমন সময়ে একের পর এক ট্রেন। পাবলিক নাম দিল করোনা এক্সপ্রেস। যাই হোক রাজ্য
সরকার সামলাচ্ছেন সবকিছু। ডেকোরেটাররা সহযোগিতা করছে সানন্দে। দুঃখ এই যে
সংক্রমণের সংখ্যা ১৭০০০। লকডাউনের বিধি কেউ মানছে না। জুলাই মাস ধরেও চালাতে হবে
লকডাউন।
আমফান এসে রাজ্যের নজর ঘুরিয়ে দিল
করোনা থেকে। এমন ঝড় তিনশো বছরে একবার আসে। বিরোধীদের বলা হলো এটা ক্ষুদ্র রাজনীতির
সময় নয়। শাসক দলকে বলা হলো খুচরো রাজনীতির সময় নয়। হোলসেল রাজনীতি করতে হবে। হাজার
হাজার কোটি টাকার ব্যাপার। ঝড়ে যাঁদের বাড়ি ভেঙে গেছে তাদের লিস্টি হলো। দেখা গেল
পঞ্চায়েত সদস্যদের কোনও আত্মীয় বাদ নেই। পাকা বাড়ির মালিক তিনিও আছেন। বাদ পড়েছেন
সত্যি যাঁরা গরিব। অল পার্টি মিটিং-এ অভিযোগ শুনে মুখ্যমন্ত্রী বললেন এই কথা? যারা পায়নি পুলিশের কাছে যাক। পুলিশকে আমার বলা আছে কি করতে
হবে।
আমফানের বিজ্ঞপ্তিতে একদিন দেখলাম
অনুপ্রেরণা কথাটা নেই। পরদিন দেখলাম মুখ্যমন্ত্রীর ছবি নেই। তার পরের দিন
বিজ্ঞাপনই নেই। ভাবলাম কাল দেখব খবরের কাগজই নেই। কি হলো বুঝে ওঠার আগেই দেখি তিনি
ব্যাক করেছেন। তবে সেই মহিমা আর নেই। করোনায় দেখেছি তাঁকে রাত জেগে পাহারা দিতে
ইটের টুকরো দিয়ে বৃত্ত আঁকতে। আমফানে সেরকম দেখলাম না। প্রকৃত উচ্চারণ যাই হোক
আমফান কি রাজ্য সরকারের 'বিজনেস মডেল' পালটে দিল? অত্যধিক বিজ্ঞাপনে
সরকারের ইমেজ নষ্ট হয়েছে এ কথা জানান দিয়ে গেল?
রাজ্যে করোনা-যুদ্ধের মধ্যেই এল
আমফান। ওদিকে দিল্লি ব্যস্ত হয়ে পড়ল লাদাখ নিয়ে। যুদ্ধের ব্যাপারটা কম বুঝি তাই
শুধু দু’টো কথা বলে শেষ করব। এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে দেখলাম তাঁর কোটি কোটি
ভক্তকে নিরাশ করতে। গলওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষের পরে অনেকেই চেয়েছিল গরম বক্তৃতা। হেন
করেঙ্গা তেন করেঙ্গা কিন্তু শোনা গেল না। অনেকে চেয়েছিলেন উপযুক্ত জবাব যা অনায়াসে
গড়াতো তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধে। চীনের উপর বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ করোনার ব্যাপারে। এই তো সময়
ওদের শিক্ষা দেবার। ভারত উদ্যোগ নিলে আমেরিকা জাপান অস্ট্রেলিয়া সবাই সমর্থন করবে।
আর বয়কট?
সে তো নিশ্চয়ই।
চীনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়
হয়েছিল নেহরুর। সেই শোক আবার উথলে উঠছে। কিন্তু নেহরু তো জেতা যুদ্ধে পরাজয়
স্বীকার করেছিলেন জমিদারদের বিরুদ্ধে। ভূমি সংস্কারের পক্ষে জনমত তৈরি হলো আইন
তৈরি হলো কিন্তু উনি হাল ছেড়ে দিলেন। সেনা নামল পুলিশ নামল কিন্তু অন্যদিকে।
জমিদারের জমি কেড়ে নিয়ে ভূমিহীনদের দিতে পারলে দারিদ্র থাকত না জাতপাতের ঝগড়া
হিন্দু মুসলমানের ঝগড়া থাকত কিনা সন্দেহ। তাই নিয়ে কারও আক্ষেপ নেই কেন?