কন্যাশ্রী, ৭০ প্রকল্পের খরচের কোনও হিসাব পরীক্ষাই হচ্ছে না
-
প্রসূন ভট্টাচার্য
- Feb 25, 2021 13:24 [IST]
- Last Update: Feb 25, 2021 13:24 [IST]
মহাবিশৃঙ্খলা চলছে রাজ্য সরকারের কোষাগার ব্যবস্থাপনায়। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের দাবি করলেও তৃণমূল সরকার কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা সিএজি’কে দিয়ে সেগুলির হিসাব পরীক্ষা করতে দিচ্ছে না। তথ্যের অধিকার আইনে একটি প্রশ্নের ভিত্তিতে জানা গেছে, কখনো নিরাপত্তা আবার কখনো গোপনীয়তার অজুহাতে সিএজি’কে তথ্য জানাতে অস্বীকার করেছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। ফলে কন্যাশ্রী, সবুজসাথী সহ রাজ্যের প্রায় ৭০টি প্রকল্পের কোনও হিসাবপরীক্ষাই হয়নি। কলকাতা হাইকোর্ট কেবল আমফানের হিসাব পরীক্ষার দায়িত্ব সিএজি’কে দিতেই সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিতে নেমেছে তৃণমূল সরকার। দশবছরে সব প্রকল্পের কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খরচের নিরপেক্ষ ও আইনি বাধ্যতামূলক অডিট না করে মমতা ব্যানার্জি যদি রাজ্য চালিয়ে থাকেন তাহলে দুর্নীতির পরিমাণ কী হতে পারে তা ভেবেই শিউরে উঠছেন অনেকে।
সরকারি হিসাবপরীক্ষণে সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সিএজি সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়, তার কাছে তথ্যগোপন করাকে সরাসরি সংবিধান অমান্য করা বলেই মনে করছেন আইনজ্ঞরা। এই ঘটনা জানার পরেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেবল মুখে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে চুরি ও টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ করছেন কেবল দলীয় রাজনৈতিক মিটিংয়ে। রাজ্যপাল কেবল রাজনৈতিক তরজায় ব্যস্ত। কেন রাজ্যপাল এবং প্রধানমন্ত্রী রাজ্য সরকারকে সিএজি অডিটে বাধ্য করাচ্ছেন না? কেন বছরের পর বছর অডিট না হলেও কেন্দ্রীয় গ্র্যান্ট অকাতরে অমিত মিত্রের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে? প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
সিএজি’র থেকে প্রাপ্ত একটি তথ্য উল্লেখ করে সমাজ ও আইন গবেষক কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী অভিযোগ করেছেন, ২০১৭ সালে নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তর থেকে সিএজি’কে কন্যাশ্রী প্রকল্পের হিসাব সংক্রান্ত তথ্য প্রদানে অস্বীকার করে বলা হয়েছে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার কারণে এই সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া যাবে না। এমনকি মুখ্যসচিবের কাছে দরবার করেও সেই তথ্য মেলেনি। একইভাবে খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের থেকেও গণবণ্টন সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি, স্বরাষ্ট্রদপ্তর থেকে পাওয়া যায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারি খরচের তথ্য, সিএজি তথ্য পায়নি সরকারের যাবতীয় ই-প্রোকিওরমেন্টের হিসাবেরও। বর্তমান সরকার কোনও সামাজিক প্রকল্পের হিসাব সংক্রান্ত তথ্য এখনও পর্যন্ত সিএজি’কে দেয়নি। শুধু কন্যাশ্রী প্রকল্পেই পাঁচবছরে খরচ দেখানো হয়েছে ১লক্ষ ২৪ হাজার কোটি টাকার। এর কেন হিসাব পরীক্ষা হবে না?
বুধবারই রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে এই নিয়ে অভিযোগ করে হস্তক্ষেপের আবেদন করে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বিশ্বনাথ গোস্বামী। তিনি লিখেছেন, সিএজি’কে অডিটে বাধা দেওয়া ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের বিপুল টাকা খরচে যে প্রকল্পগুলি রূপায়িত হচ্ছে তার সোস্যাল অডিটে কারচুপি হচ্ছে। রাজ্য সরকারের স্থানীয় স্তরের প্রকল্প রূপায়ণকারী সংস্থাকে দিয়েই অডিট করানো হচ্ছে এবং ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
সিএজি’কে তথ্য প্রদানে অস্বীকারের যে অভিযোগ বিশ্বনাথ গোস্বামী করেছেন সেই সময়কালে রাজ্যের মুখ্যসচিব ছিলেন বাসুদেব ব্যানার্জি, তিনিই বর্তমানে রাজ্যের মুখ্য তথ্য কমিশনার। তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন, সিএজি সরকারের স্বতন্ত্র একটি হিসাব পরীক্ষণ সংস্থা, তথ্য পরীক্ষার সাংবিধানিক অধিকার তাদের আছে। তারা যদি তথ্য না পায় তাহলে সেটা তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করে দিতেই পারে। সেই রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ হয়। তবে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে আমি মুখ্যসচিব থাকলেও আমার কাছে এই ধরনের কোনও তথ্য সংক্রান্ত চাহিদার কথা আসেনি। সাধারণভাবে মুখ্যসচিব স্তর পর্যন্ত এগুলো আসেও না, বিভাগীয় সচিবস্তরেই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। কাজেই আমার পক্ষে তথ্য অস্বীকারের এরকম ঘটনা স্মরণে রাখা সম্ভব নয়।
যদিও বিশ্বনাথ গোস্বামীর অভিযোগ, কোনও একটি দপ্তরের সচিব একা সিদ্ধান্ত নিয়ে সিএজি’কে হিসাব পরীক্ষায় বাধা দিয়েছে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, উপরের স্তরের এমনকি মুখ্যসচিবও এতে যুক্ত থেকেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া এই ঘটনা অসম্ভব।
কিন্তু রাজ্য সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা প্রকল্পগুলির হিসাবপরীক্ষা যে সিএজি’কে দিয়ে করানো হয়নি তা স্পষ্ট হয়ে গেছে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান সুখবিলাস বর্মার কথায়। তিনিও বলেছেন, কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, ইত্যাদি প্রকল্পের খরচের সিএজি’র অডিট করা রিপোর্ট আমরা বারবার চেয়েও পাইনি। এই সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও কোনও তথ্যই সিএজি’কে দিয়ে অডিট করাচ্ছে না। এর পিছনে যে বিপুল অঙ্কের চুরি আছে তা আড়াল করতেই এই পদক্ষেপ। সরকার ক্লাবকে টাকা দিচ্ছে, দুয়ারে সরকার করছে, কিন্তু খরচের হিসাব পরীক্ষা করানোর সাহস নেই। বিধানসভায় আমার প্রশ্নের উত্তরে পার্থ চ্যাটার্জি জানিয়েছেন যে দুয়ারে সরকার এবং পাড়ায় সমাধান করতে গিয়ে ইতিমধ্যেই নাকি ২৮৬ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু কেবল মাইক বাজিয়ে সই করতে কীভাবে এত টাকা খরচ হলো রাজ্যবাসী সেটা জানতে চাইবে না?
পরিবহণ মন্ত্রী থাকা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল থেকে বিজেপি’তে যোগ দিয়েই অভিযোগ করেছেন সবুজ সাথীর সাইকেল নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। প্রকাশ্য সভায় বিজেপি নেতারা এইসব অভিযোগ করলেও কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা তাদের প্রতিনিধি রাজ্যপাল কেন চুপ করে বসে আছেন? এই প্রশ্নও উঠছে।