বিবর্ণ শিল্পাঞ্চলকে লড়াইয়ের রং
-
নিজস্ব প্রতিনিধি
- Dec 02, 2019 11:33 [IST]
- Last Update: Dec 02, 2019 11:33 [IST]
আসানসোল, ১ ডিসেম্বর— রবিবার সকাল, জিটি রোডে নিত্যদিনের ব্যস্ততা তখনও শুরু হয়নি। পুরানো বাসস্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে তখন সদ্য বাইশ পেরোনো মঙ্গল মাইতি, অ্যাপ্রন পরা এক পদযাত্রীকে দেখে এগিয়ে এলেন, ‘সত্যি কারখানা খোলা যাবে? মানে এখানেই কাজ পাবো তো’! মা’কে বাড়িতে রেখে পরের শনিবার সকালে আসানসোল থেকে ট্রেনে চাপবে বার্নপুরের এই যুবক, কাজের খোঁজে, গন্তব্য চেন্নাই।
তার কিছু পরেই সেই পুরানো বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকা থেকে শুরু হলো জনস্রোতের পথ চলা। লঙ মার্চের দ্বিতীয় দিন। ভেসে গেছে জিটি রোড, রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো মানুষজন দেখছেন, ছবি তুলছেন, এমনকি অনেকে কয়েক পা হেঁটেও ফেললেন লঙ মার্চের সঙ্গে।
ইস্কোর ঠিকা শ্রমিকের পাশে হাঁটছেন চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মচারী, পাণ্ডবেশ্বরের দিনমজুরের সঙ্গেই স্লোগান মেলাচ্ছেন দশ মাস ধরে বেতন না পাওয়া বিএসএনএল’র ঠিকা কর্মী- ভারতের শ্রমশক্তির এক নিদারুণ অবয়ব বয়ে নিয়েই যেন এগচ্ছে লঙ মার্চ, তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে, প্রতি মুহূর্তে সেই জনপ্লাবনে বাড়ছে স্রোতের সংখ্যাও।
পথ চলতে চলতেই মঙ্গল মাইতির ‘উত্তর’ হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন তাপস রুইদাস। এই মুহুর্তের প্রথম পরিচয় সাতাশ পেরোনো এই যুবক হাঁটবেন ২৮২ কিলোমিটার, স্থায়ী পদযাত্রী। তাপস রুইদাসের বাড়ি জামুড়িয়ায়। এই বয়সে ইতিমধ্যে পাঞ্জাব থেকে হরিয়ানা, হায়দরাবাদও ঘুরে এসেছেন কাজের খোঁজেই। হাসিমুখেই হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠলেন, ‘অনেক জায়গায় কাজের খোঁজে গেছি, বাড়িতে বাবা-মা আছে, বাবা দিনমজুর। সংসার চালানো কঠিন তাই যেতাম। সব জায়গা থেকে নানান ধরণের কাজ কিন্তু শিখে এসেছি’। মুখে লাজুক হাসি। পরমুহূর্তেই বলে উঠলেন, ‘গত তিন-চার বছরে যেখানেই গেছি সেখানেই দেখি বাঙালি, মেদিনীপুর, বর্ধমান,মালদার সব ছেলেরা, গ্রামে, শহরে কাজ নেই কোথাও’!
পাঞ্জাব থেকে হায়দরাবাদ কাজের খোঁজে ঘুরে, বাড়ির টানে ফিরে আসা যুবক লঙ মার্চে হাঁটছেন, আরও দশদিন হাঁটবেন। ‘ মা’ই বলল যা, ভালো কাজের জন্যই হাঁটবি, কিছু টাকাও দিয়েছে আমাকে, যদিও মাঝে মাঝে জামুড়িয়া পৌরসভায় সমীক্ষার কাজ করে কিছু টাকা আমার কাছেও আছে, তবুও মা দিল’।
দিনমজুর পরিবারের জননী পুত্রের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন লঙ মার্চে হাঁটতে যাবে বলে- লঙ মার্চ পতাকার ভিন্নতায় নয়, শ্রমিক পরিবারের নিজস্ব মেজাজেই যেন রঙিন হয়ে উঠছে।
আসানসোল থেকে দুপুরে তখন লঙ মার্চ ঢুকছে জামুড়িয়ার নিংঘায়। মূলত কোলিয়ারি এলাকা, একশো বছরের পুরানো নিংঘা কোলিয়ারি। ভূগর্ভস্থ কয়লার গভীরতার নিরিখে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম কোলিয়ারি, চিনাকুড়ির পরেই নিংঘা। সেই নিংঘাতেও মোদী সরকারের ফরমান, কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক ইসিএল’র ১৭টি ভূগর্ভস্থ খনির কাজ বন্ধ রেখেছে। সিংহভাগই এরাজ্যের। কয়লা তোলার কাজ বন্ধ, আতঙ্ক- আশঙ্কা নিংঘা জুড়ে।
লঙ মার্চ সেই নিংঘায় প্রবেশের আগে হাই-ওয়েতেই কোলে শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে খাদান শ্রমিক পরিবারের গৃহবধূরা। ফুল ছেটালেন, জল দিলেন পদযাত্রীদের। উমা মাণ্ডিদের কাছে প্রশ্ন করার আগেই জবাব মিলেছে, ‘ আমরা তো কোলিয়ারিতে রোজ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি, বন্ধ হতে দেব না, কতবার ধর্মঘট করেছি’! শ্রমিক মহল্লার ভাষাতেই যেন এক স্বাভাবিক আগ্রাসন থাকে, খাদান এলাকায় তো আরও। মাটির নিচে দেড় মিলিয়ন টন কয়লা থাকা খাদান কেন বন্ধ করে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে সরকার, তা এখানে বোঝাতে হয় না আসিকুল্লা মিয়া, সিউ ওহিরদের। তাই নিংঘা কোলিয়ারি, পাশের শিবডাঙা কোলিয়ারির উৎপাদন বন্ধ মানে যে বাজার, দোকানপাট সবই ক্ষতির মুখে পড়বে তা অভিজ্ঞতা দিয়েই চেনেন কোলিয়ারি এলাকার বাসিন্দারা। আজগর আলি খানের কথায়, ‘আবার আমরা তো ধর্মঘট করব আট তারিখে, খাদান বন্ধ হতে দেব না, দেখি কাদের শক্তি বেশি’।
লঙ মার্চ নিছকই পথ হাঁটা নয়, পথের সন্ধানও দিচ্ছে, লড়াইয়ের নতুন বৃত্ত আঁকতে আঁকতেই তা যেন এগচ্ছে গন্তব্যের দিকে।
গীতা বাউড়ির পথ হাঁটায় সেই উপলব্ধি আরও জোরালো হয়েছে। গীতা বাউড়ি স্থায়ী পদযাত্রী নন, দ্বিতীয় দিনের শুরুতে আসানসোল গির্জা মোড় থেকে উষাগ্রাম পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার হেঁটেছেন তিনি। কিন্তু এখানেই শেষ নয় গল্প! তাঁর স্বামী দীপক বাউড়ি স্থায়ী পদযাত্রী। চিত্তরঞ্জন থেকে হাঁটছেন।
দীপক বাউরি ইস্কোর ঠিকা শ্রমিক। বছরে চার থেকে পাঁচ মাস কাজ পান, বাকি সময়ে রাজমিস্ত্রির যোগানদার কিংবা দৈনিক মজুরিতে কোনও কাজে যুক্ত হন। স্বামীকে একটু সাহায্য করতে গীতা বাউরি পরিচারিকার কাজ করেন, রবিবার ছুটি নিয়েই হেঁটেছেন মিছিলে। ‘আমার দুই মেয়ে, বড় মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক দেবে, ছোটটা সিক্সে পড়ে। জানেন বড় মেয়েই ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে, আমি যেন পুরো লঙ মার্চ শেষ করেই ফিরি সেটাও আবার বলে দিয়েছে আসার সময়’, চোখের কোনে কি একটু জল? সামলে নিয়ে দীপক বাউরির কথায়, ‘ইস্কো লড়াই করেই বাঁচিয়েছে এরাই যারা লঙ মার্চ করছে, বার্নপুরের মতো জায়গায় কোনও কাজ নেই। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে রোজ চলে যায় ভিনরাজ্যে। বুঝছেন না আমার স্ত্রীও হাঁটছে মিছিলে!’
বিকালে রানিগঞ্জের রানিসায়ের হয়ে রানিগঞ্জ শহর ঘুরে রাতে শিশুবাগানে এসে এদিনের মতো থেমেছে লঙ মার্চ। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া হিন্দুস্থান কেবলসের পাশ দিয়ে শনিবার হাঁটা শুরু করে রবিবার রাতে রানিগঞ্জের বন্ধ সেই বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের পাশ দিয়ে এগিয়েছে লঙ মার্চ। হিন্দুস্তান কেবলসের মতো বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের একট টুকরো লোহাও আজ অবশিষ্ট নেই, লুট করে মরুভূমিতে পরিণত করেছে শাসক তৃণমূল।
রবিবার সকালে আসানসোলের পুরানো বাসস্ট্যান্ড চত্বরের সামনে দিয়েই শুরু হয় লঙ মার্চ। এখানে সারি দিয়ে দোকান। ব্যবসায়ীরা, দোকানদাররাই সিআইটিইউ নেতৃত্বকে জানান, আপনারা এখান থেকেই লঙ মার্চ শুরু করুন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি দোকান দেরিতে খুলব! বন্ধ দোকান চত্বরেই তাই সভা করে পথ চলা শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের।
এই জিটি রোড ধরেই নয়ের দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বাঁচাতে পদযাত্রা এগিয়েছিল ইস্কোর গেটের দিকে, কলকাতা থেকে। ‘ইস্কো বাঁচাও’র দাবিতে। বামাপদ মুখার্জি, চন্দ্রশেখর মুখার্জিদের সেই মাটিতেই আরও একবার কারখানা বাঁচানোর লড়াইয়ে পথ হাঁটছে শ্রমিক তল্লাট।
শুধু আসানসোলেই গত কয়েকবছরে কাজ হারিয়েছেন ছয় হাজারের বেশি স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক। এই আসানসোলেই শুধুমাত্র তৃণমূলী মন্ত্রীর ভুল এগ্রিমেন্ট ও অবাস্তব দাবির মুখে পাততাড়ি গুটিয়েছে অন্যতম বড় রং কারখানা রেকিট কোলম্যান সংস্থা। কাজ হারিয়েছেন কয়েকশো শ্রমিক। এই মন্ত্রীর তল্লাটেই পুনম বিস্কুট, বার্নপুর সিমেন্টে তালার ওপর এখন ঝুলও জমেছে। বন্ধ হয়ে গেছে জগদীপ ডিস্টিলারি। পিলকিলটন গ্লাস ফ্যাক্টরি থেকে ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানি, রাজা বিস্কুটের পাশাপাশি একাধিক পাথর খাদানও বন্ধ হয়েছে। হাজার হাজার কর্মচ্যুত। সেখান থেকেই জামুড়িয়া হয়ে রানিগঞ্জ-চিত্রের পরিবর্তন নেই।
শিল্পাঞ্চলের বিবর্ণ মানচিত্র ধরেই এগচ্ছে শ্রমিকের লঙ মার্চ।
আসানসোলে লঙ মার্চ হওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত সভা হয়, সভাপতিত্ব করেন সিআইটিইউ নেতা বিনয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী। এখানে বক্তব্য রাখেন এআইটিইউসি’র আশিস শীল, আইএনটিইউসি’র চণ্ডী চ্যাটার্জি, টিইউসিসি’র ভবানী আচার্য ,এআইসিসিটিইউ’র বাসুদেব বসু, ইউটিইউসি’র দীপক সাহা, বিএসএনএল কর্মীদের নেতা অনিমেষ মিত্র। পরে নিংঘাতেও সভা হয়, সভাপতিত্ব করেন বংশগোপাল চৌধুরি। এখানে বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সম্পাদক অনাদি সাহু, এআইটিইউসি’র রমেশ সিং, আইএনটিইউসি’র নেপাল চক্রবর্তী প্রমুখ। দুপুরে বোগরা, রাতে রানিগঞ্জের শিশুবাগানেও সভা হয়।