বাস উত্তরণ
-
-
- Jun 21, 2022 21:58 [IST]
- Last Update: Jun 22, 2022 03:00 [IST]
‘শতাব্দীর নিঃসঙ্গতা’ কাটিয়ে কলম্বিয়ার আকাশে নতুন ভোরের আলোকছটা দেখা দিয়েছে। শত শতাব্দীকাল ধরে নিপীড়িত শোষিত মানবতার বুকে চেপে থাকা জগদ্দল পাথরটা সরিয়ে যথার্থ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আস্বাদ গ্রহণের সুযোগ এসেছে। আর এই সম্ভাবনা তৈরি করেছে যুগ যুগ ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী থাবার মধ্যে বহুজাতিক পুঁজির শোষণে নিঃস্ব রিক্ত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ কলম্বিয়ারই সাধারণ মানুষ। এই প্রথম তাঁরা তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়েছেন আজীবন মানুষের জন্য লড়াই করা একজন বামপন্থী নেতাকে। এককালের গেরিলা যুদ্ধের সেনানী, পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পথে ময়দানের লড়াইয়ে হয়ে ওঠা জননেতা গুস্তাভো পেত্রোকে তারা বসিয়েছেন রাষ্ট্রপতির আসনে। পেত্রোর সঙ্গী হিসাবে উপরাষ্ট্রপতি পদে মানুষ বেছে নিয়েছেন অ্যাফ্রো কলম্বিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ ফ্রান্সিয়া মার্কেজ। কলম্বিয়ার ইতিহাসে একজন বামপন্থী রাজনীতিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া যেমন নজিরবিহীন ঘটনা তেমনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা উপরাষ্ট্রপতি হওয়াও ঘটনাও অতীতে কখনো ঘটেনি। নিঃসন্দেহে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে কলম্বিয়ার জয়যাত্রা শুরু হলো বামপন্থার পথ ধরে। ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবার সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক পুঁজির বেপরোয়া শোষণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য উন্নয়নের বিকল্প পথ লাতিন আমেরিকার বুকে বামপন্থার স্পন্দন সৃষ্টি করে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে। সেই স্পন্দন ধীরে ধীরে আলোড়নে রূপান্তরিত হতে থাকে একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায়। ভেনেজুয়েলা থেকে শুরু করে একটার পর একটা দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জাল চিঁড়ে মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরাচারী সামরি জুন্টা শাসন থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্রের খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে শুরু করে। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে বামপন্থার ভিত। বিকশিত হয় জাতীয় চেতনা ও নাগরিক চেতনা। আর এই সবকিছুর মধ্যেই সাধারণ মানুষকে নতুনভাবে আকর্ষণ করতে থাকে বামপন্থা। পরিবর্তনের এই পর্বে কমিউনিস্টরা হয়তো সামনের সারিতে ছিল না তবে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থে বৃহৎ পুঁজির স্বার্থবাদী উদারনীতির বিরুদ্ধে বিকল্প পথের নানা অভিমুখ সামনে আসতে থাকে। সেগুলি বামমুখীর ভাবনারই নানারূপ। একেবার লড়াইয়ের ময়দানে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্ব পেরিয়ে মজবুত হতে থাকে বামপন্থী ভাবনা। তাই ফসল ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, পেরু, চিলি, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস প্রভৃতি দেশে গড়ে ওঠা বামপন্থী সরকারগুলি। ব্রাজিল, ইকুয়েদর সহ অন্য কয়েকটি দেশেও অনুরূপ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার মদতে এবং বৃহৎ পুঁজির সাহায্যে দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলরা স্বৈরাচারী জমানা ফিরিয়ে এনেছে। এইসব দেশেও জমানা বদলের লড়াই চলছে। কলম্বিয়ায় বামপন্থীদের জয় লাতিন আমেরিকার বুকে বামপন্থার প্রসারে নতুন উদ্দীপনার জন্ম দেবে।
আমেরিকার খিড়কি উঠোন লাতিন আমেরিকা। আর সেই খিড়কির উঠোনের প্রধান খুঁটি ছিল কলম্বিয়া। বরাবর কলম্বিয়ায় আমেরিকার আজ্ঞাবাহী সরকার মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে দারিদ্রের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে সম্পদ শোষণ ও লুটে ব্যবস্থা পাকা রেখেছে। অপমানিত, লাঞ্ছিত, সর্বহারা মানুষের ক্ষোভের মধ্যে শক্তিশালী হয়েছে একাধিক গেরিলা গোষ্ঠী। শাসকের সঙ্গে সংঘাতে জীবন গেছে ও বাস্তুহারা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সেই রক্তাক্ত ইতিহাস পেরিয়ে কলম্বিয়া এবার ভোরের আলো দেখতে পেয়েছে। নিঃসন্দেহে কলম্বিয়ার মানুষের এ এক বিপ্লবী উত্তরণ।