মানুষের আন্দোলনই বাঁচাতে পারে পরিবেশকে
-
অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
- Jun 05, 2022 16:11 [IST]
- Last Update: Jun 05, 2022 16:11 [IST]
গাছ পোঁতো, গাছই বাঁচাবে পরিবেশ। প্রতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস এলে কেবলই গাছ পোঁতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ৫ জুন যেন একটা বনমহোৎসবের দিন। একদল গাছ পুঁতে চলবে, আর এক দল গাছ কাটবে, আগুন ধরিয়ে দেবে, তাহলে চলবে কী করে? বিহিত করতে হবে না! গাছকে রক্ষা করাটাও তো জরুরি কাজ। সৌন্দর্যায়নের নামে শহরের ফুটপাত বাঁধিয়ে দিয়ে গাছের পা দুর্বল করে দিয়ে কালবৈশাখীর ওপর দোষ দিলে চলবে কী করে! উন্নয়নের নামে গাছ কাটা বন্ধ করাটাও জরুরি। কেবলমাত্র লোকদেখানো বৃক্ষপ্রীতির মধ্যে পরিবেশ ভাবনাকে আটকে রেখে রাষ্ট্র যখন পরিবেশ ধ্বংসে মদত দেয়, তখন সাধারণ মানুষের রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ কোথায়!
কেন্দ্র-রাজ্যের দুই বেনিয়া সরকার পরিবেশকে বেচেই চলেছে। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্য সরকার বন কেটে মানুষ হটিয়ে খনি তৈরি করতে যাচ্ছে, পাহাড় বিক্রি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেন প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে ছেলেখেলা করাটা সরকারের অধিকার! মানুষের পরিবেশ বিষিয়ে দেওয়ার হচ্ছে, কৈফিয়ত চাওয়া হবে না পরিবেশ দিবসে? কেবল মুখে ক্রিম লাগালে শরীর সুঠাম থাকবে? গাছের সঙ্গে জীব বৈচিত্র রক্ষার অঙ্গীকারও করতে হবে। পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি, আইন হওয়ার পরেও যদি কোনও রাষ্ট্র তা ভেঙে চলে, তার বিচার তো জনগণকেই করতে হবে। উন্নত দেশ নিজের সুখে দেদার গ্রিন হাউস গ্যাস নিষ্ক্রমণ করবে, আর অনুন্নত দেশ তার মাশুল দেবে, এতো চলতে পারে না।
বলা হচ্ছে কার্বন ফুট-প্রিন্ট কমাতে, স্থিতিশীল উন্নয়ন করতে। কিন্তু প্রযুক্তি নির্ভর সেসব চালনা করার চিন্তা আদপে কী ধোপে টেকে? তবুও পরিবেশ সম্পর্কে চেতনার মান বাড়াতে হবে। মানুষের সহজাত চেতনাকে দিয়ে লড়তে হবে প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে। আবহাওয়ার প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে যিনি ফসল ফলান, তাঁকে জলবায়ুর আন্তর্জাতিক বিধি শেখানোর প্রয়োজন পড়ে না। এটা বোঝার সময় এসেছে। বাস্তুতন্ত্র রক্ষার দাবি তুলে ২০২১ সালে পরিবেশ দিবসের যে ভাবনার প্রচার হয়েছিল, তার মূল্যায়ন হোক এবছরের পরিবেশ দিবসে। লালসার জেরে যখন ব্রাজিলের আমাজন কিংবা পুরুলিয়ার অযোধ্যা’কে জ্বলতে হয়, তখন শুধু পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে বলে চিৎকার না করে বাস্তুতন্ত্র ভাঙার প্রতিবাদ করতে হয়। বাস্তুতন্ত্র রক্ষার সেই ভাবনাকে কোন দেশ লঙ্ঘন করেছে তা হিসাব চাওয়ার দিন এসেছে।
১৯৭২সাল থেকেই রাষ্ট্রসঙ্ঘ বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সঙ্গে তার রকমারী ভাবনাকে প্রচার ও প্রসার করে এসেছে। এবছর ২০২২ সালটি তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। কেননা স্টকহোমে আয়োজিত প্রথম পরিবেশ সম্মেলনের ৫০ বছর পূর্তি ঘটছে এবছর। তাই বিশেষ করে এবছর পরিবেশ দিবসের প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যার সঙ্গে তা না মানার খতিয়ানটাও একবার দেখে নেওয়াটা দরকার। বিশ্বের পরিবেশবান্ধব সম্পদের সুরক্ষায় নেতৃত্ব দেয় রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিবেশ বিষয়ক বিভাগ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেই পরিবেশ দিবস কর্মসূচিতে এবছর বিশ্বের ১৫০টি দেশ অংশ নিচ্ছে। এবছর পরিবেশ দিবসের স্লোগান— একটাই কিন্তু পৃথিবী। স্লোগানটি আদপে একটা সাবধানবাণী। এর পিছনে নিহিত বড় অর্থ। সামগ্রিক জীবজগতের মূল আশ্রয় যেভাবে কলুষিত হচ্ছে, তা রুখতে না পারলে আর একটা পৃথিবী লাগবে পরবর্তী বসবাসের জন্য। সেটির দেখা এখনো মেলেনি। তাই একে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থিতিশীল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া প্রয়োজন। এটাই ২০২২ সালের পরিবেশ দিবসের ভাবনা।
প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে অপ্রাকৃতিক উপায়ে দৈনন্দিন জীবনে অভ্যস্ত হলে তার ফল হবে মারাত্মক। প্রকৃতির সহ্যের একটা সীমা রয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রযুক্তির লড়াই বাধানো মানুষের ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চিত করছে। সঙ্কটের সময় রাষ্ট্রনায়করা চুপ করে রয়েছেন। অগত্যা সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ রক্ষার নীতি প্রণয়নে আমজনতাকেই চাপ তৈরি করতে হবে। আক্রমণ, যুদ্ধবিগ্রহের নামে মানুষকে ত্রস্ত করে রাখার কৌশলকে কাটিয়ে উঠে বিশ্বব্যাপী এক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলাটা জরুরি।
প্রাকৃতিক পরিবেশ কারো একচ্ছত্র সম্পত্তি নয়। যে দেশ পরিবেশ দূষিত করছে, সেই আবার অন্য দেশকে পরিবেশ নির্মল করার আহ্বান জানাবে, তা চলতে পারে না। কোনও একক বা গোষ্ঠী আন্দোলন এ বিশ্বকে সকলের বসবাসযোগ্য করে তুলতে পারবে না। প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষের চেতনার মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। বিশ্বকে সুস্থ-সতেজ রাখার দায়বদ্ধতা গড়ে উঠলে পৃথিবী নিয়ে সামগ্রিক উদ্বেগও কমবে। কোভিড-১৯ অতিমারী’র সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে সকলকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। মানুষের জীবনরক্ষার চিন্তায় দুই বছর চলে গেছে। তাই এবছর পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা ও কাজের সময়।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারংবার বলছেন, ১৮৫০ সালের তুলনায় বিশ্ব উষ্ণায়নের গড় বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতেই হবে। তা না হলে, দুনিয়ার ধ্বংস প্রায় নিশ্চিত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিবেশ বিষয়ক কমিটি’র সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের মুখ্য উপাদান গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমণ গত দশ বছরে ঘটেছে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে বসেছিল ‘কপ-২৬’ জলবায়ু মহাসম্মেলন। আন্তর্জাতিক পরিবেশ নীতি ও জাতীয় পরিবেশ আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগের পাশাপাশি মাথা পিছু কার্বন নির্গমণ হার কমানোর আহ্বান জানানো হয়। অথচ সে কথায় আমল দিচ্ছে কে? উন্নত দেশের বেপরোয়া মনোভাবের জন্যই দেশে দেশে ছাত্র ও মেহনতি সমাজ পরিবেশ আন্দোলনে শামিল হতে বাধ্য হচ্ছে। তাঁদের একটাই কথা— প্রত্যেক নাগরিককে তাঁর পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব ও কর্তৃব্য পালন করতে হবে।
এবারের পরিবেশ দিবসে অনেক সংগঠন কেবল গাছ পোঁতার বাইরে আসতে পেরেছে। পরিবেশের হালহকিকত জানাতে দেশের সবচেয়ে বড় জনবিজ্ঞান সংগঠন, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রচার অভিযানে নেমেছে। রাজ্যের ৯টি পরিবেশ সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে পথে নেমেছে বিজ্ঞান মঞ্চ। সচেতনার পদযাত্রার পাশাপাশি করা হচ্ছে পরিবেশ নিয়ে বেলেল্লাপনার প্রতিবাদ। তৃণমূল সরকারের লালসার মধ্যে পড়ে কীভাবে কলকাতার পরিবেশ-প্রকৃতি বিপন্ন তাও প্রচার করা হচ্ছে। প্রতিবাদের ঝড় উঠছে কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন আলিপুর, প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার কিংবা বেঙ্গল গভর্নমেন্ট (বিজি) প্রেসের জমি হিডকো’র হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে। সেখানে গজাবে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। স্বয়ং সরকারের মদতে পরিবেশ নিধনের এমন ঘটনা বাংলার রাজনীতিতে নজিরবিহীন।
ওই সব এলাকার বাস্তুতন্ত্রে যে চরম কুপ্রভাব পড়বে তা জানা সত্ত্বেও লোভের বশে একটা সরকার এইভাবে পরিবেশ নিধন যজ্ঞে শামিল হচ্ছে। সরকারকেই যেখন পরিবেশ রক্ষার মূল দায়ভার নিতে হয়, সেখানে উলটো পথে হাঁটছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার। ওই সব এলাকার সবুজের আস্তরণ ধ্বংস হলে আশ্রয়হীন হবে লক্ষাধিক প্রজাতি। জীবনহানি ঘটবে তাদের। তার প্রভাব পড়বে কলকাতার সামগ্রিক সবুজের আস্তরণে। কিন্তু উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পরিবেশ ধ্বংসে ‘এগিয়ে বাংলা’। কালীঘাট ব্রিজ ও আলিপুর ব্রিজে সুইস গেট তৈরি করে তা বদ্ধ করার পরিকল্পনা চলছে। টালিনালা কিংবা আদি গঙ্গায় এখনো জোয়ার-ভাটা খেলে। তবু সৌন্দার্যায়নের নামে তার দুই পাড়ের জীব বৈচিত্র ধ্বংস করে কংক্রিট করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সরকার যখন বনজ ও খনিজ সম্পদ লুটে অংশ নেয়, তখন সাধারণ মানুষকে রুখে দাঁড়াতেই হয়।
সেই জন্যই দেওচা-পাঁচামী’র কয়লা লুট কিংবা তিলাবনি পাহাড় বিক্রি করার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন সাধারণ মানুষ। অরণ্যের অধিকারকে বুঝে নিতে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে অসম লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন তাঁরা। পরিবেশ দিবসে এর থেকে উৎসাহজনক দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে! আইনি কৌশলে এলাকাগুলি থেকে বিতাড়িত মানুষও আজ সরব হচ্ছেন। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে এটাই শেষ পথ। গ্রামের মানুষ লড়াই করলেও শহরবাসীর এখনো যথেষ্ট বোধোদয় হয়নি। গ্রিন সিটি’র নামে কলকাতার যত্রতত্র পরিবেশ ধ্বংস করা নিয়ে যথেষ্ট প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে না!
কলকাতায় সবুজের শামিয়ানা হু হু করে কমছে। গত দশ বছরে সবুজ কমেছে ৩০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রকের রিপোর্ট পাওয়ার পরেও রাজ্য সরকার নির্বিকার। কলকাতায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমেই চলছে। তবুও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলিকে বহুতলে মাটির নীচের জল তুলতে অনুমতি দিচ্ছে কর্পোরেশন। পাম্পের শক্তি বাড়িয়ে অতিগভীর থেকে জল তোলার ফলে বৃহত্তর কলকাতার বেশিরভাগ অঞ্চলে পানীয় জলে বাড়ছে আর্সেনিক-ফ্লুরাইড দূষণ। তবু নীতি পরিবর্তনে আগ্রহী নয় সরকার। লালসা গিলছে কল্লোলিনীকে।