তৃণমূলকে দিয়ে জমি চাষ করাচ্ছে সঙ্ঘ
-
বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য
- Jun 02, 2022 09:49 [IST]
- Last Update: Jun 02, 2022 09:49 [IST]
উত্তর ও পশ্চিম ভারতে অনেক দশক জুড়েই আরএসএস তাদের ‘প্রশিক্ষণ’ শিবির চালায়। সাধারণ মানুষকে ‘হিন্দু’ থেকে আরএসএস-র তৈরি হিংস্র ‘হিন্দুত্ববাদী’ তৈরি করার প্রচেষ্টা চালায়। এই কাজের জন্য বাংলায় বরাবরই তাদের পথ কঠিন ছিল, কারণ অবশ্যই ৩৪ বছরের বাম সরকার ।
২০১১-এর পর থেকে সেই দরজা খুলে গেছে। বাংলার বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল এলাকায় ঘন ঘন এরকম প্রশিক্ষণ শিবির, চিন্তন শিবির ইত্যাদি শুরু হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়ারিতে এরকমই একটি শিবিরে মে মাসের ১৭ তারিখ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত নিজে উপস্থিত ছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। আর সেই খবর পাওয়া মাত্রই তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর অধীনস্ত পুলিশকে নির্দেশ দিলেন আরএসএস প্রধানের জন্য ফল ও মিষ্টি পাঠাতে এবং ভালো করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। সাথে আরও বললেন যে , প্রশাসনের তরফে আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি না রাখতে, যাতে উনি বুঝতে পারেন যে ‘আমরা’ সবাইকে স্বাগত জানাই ।
এই ‘আমরা’ বলতে নিশ্চিতভাবেই উনি নিজেকে আর তাঁর ব্যক্তিগত মালিকানার দলকেই বুঝিয়েছেন কারণ বাংলার মানুষ কখনই কোনও উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতাকে স্বাগত জানায় না। দাঙ্গাবাজদের স্বাগত জানানো এবং একজোট হয়ে থাকা ওঁর আর ওঁর দলের পুরানো অভ্যাস। ২০০২-এর কুখ্যাত গুজরাট দাঙ্গার পরে মোদী ফের ক্ষমতায় আসতেই তৃণমূল নেত্রী ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এসবের একটা মূল কারণ আরএসএস-র প্রত্যক্ষ মদতেই ওঁর ব্যক্তিগত দল তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেসে থাকাকালীনই বলেছিলেন বিজেপি তাঁর কাছে অচ্ছ্যুত নয়। তার মাত্র এক মাস পরেই আরএসএস-র সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ১ জানুয়ারি, ১৯৯৮-তে তৈরি করলেন নিজের দল। টাকা দিল সঙ্গ-বিজেপি। দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনে নতুন দলের রেজিস্ট্রি হলো, প্রতীকও হলো বিজেপি-র সক্রিয় সহযোগিতায়। বাংলায় পরপর দুবছর ১৯৯৮-৯৯ লোকসভা ভোটে তৃণমুল-বিজেপি জোট হলো। বাংলার সবচেয়ে বড় কাগজ তাদের প্রথম পাতায় শিরোনাম করল তৃণমূল নেত্রীরই বলা সেই বিখ্যাত উক্তি – ‘ বিজেপি-কে ফ্রন্টে এনে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়ব’। সেই কথামতো লড়লেন এবং বাংলায় সেই প্রথম বিজেপি দু’টি সাংসদ আসন পেল তৃণমূলের ভোটে। ব্যালটে পদ্ম প্রতীককে চিনিয়ে বাংলায় এক দানবীয় ফ্যাসিস্ত শক্তিকে জমি দিল তৃণমুল। এরপরের পাঁচ বছর ধরে কেন্দ্রের বাজপেয়ী মন্ত্রীসভায় রেল, কয়লা ও দপ্তরবিহীন মন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী। এরই মধ্যে ২০০১ সালে বিবিসি-তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন – আর এস এস-বিজেপি তাঁর ‘স্বাভাবিক মিত্র’। ২০০৩ সালে দিল্লিতে আরএসএস-র এক বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বললেন – ‘ আপনারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক’। সাথে আবেদনও করলেন ‘ যদি আরএসএস ১ শতাংশ সাহায্য করে, আমরা বাংলা থেকে কমিউনিস্টদের সরাতে পারব’। একই মঞ্চে সেদিনও ছিলেন মোহন ভাগবত। কমিউনিস্টদের সরানোর কথা বলায় আরএসএস সেদিন উচ্ছ্বসিত হয়ে তৃণমূল নেত্রীকে উপাধি দিয়েছিল – সাক্ষাৎ মা দুর্গা ! এইভাবে সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকল। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে জোট হলো বিজেপি-র সাথে। এরপরেই সিঙ্গুরের ঘটনার সময় তৃণমূল নেত্রীকে সক্রিয় সমর্থন দিল বিজেপি । রাজনাথ সিং নিজে ছুটে এলেন ‘চকলেট-স্যান্ডুইচ’ খ্যাত সেই বিতর্কিত অনশনের মঞ্চে । আরও এক বছরের মধ্যে এই ভয়ঙ্কর শক্তির সাথে জোটানো হলো হিংস্র মাওবাদী, ভাড়াটে কিছু বুদ্ধিজীবী সহ নামে বেনামে থাকা সঙ্ঘের আরও কিছু শাখাপ্রশাখাকে। জঙ্গলমহলে দিনে দুপুরে সিপিআই(এম) নেতাকর্মীদের খুন শুরু করল এই হিংস্র বাহিনী । কমিউনিস্টদের সরাতে এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেইসময় কলকাতার আমেরিকান দূতাবাসের ভুমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০১২ সালে আরএসএস-এর মুখপত্র পাঞ্চজন্য পত্রিকায় তৃণমূল নেত্রীকে প্রশংসা করে লেখা হয়েছিল ‘ ওর মতো সাধারণ জীবনযাপন করা নেতৃত্ব গোটা দেশে আরও তৈরি হোক, আর উনি সেই ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ যিনি রাজনীতি থেকে টাকা উপার্জন করতে আসেননি’। আরএসএস যখন এসব লিখছে ঘটনাক্রমে তারপর থেকেই সামনে আসতে শুরু করে সারদা থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি টাকার একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারি। আর বর্তমানে তো এমন একটাও দিন নেই যেদিন তৃণমূল সরকারের কোনও না কোনও নতুন আর্থিক কেলেঙ্কারি সামনে আসছে না । কয়লা, লোহা, বালি, গোরু, সিন্ডিকেট, শিক্ষক নিয়োগ– কিছুই বাদ নেই । ভারত কেন গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম কোনও দুর্নীতিবাজ দলের নজির নেই। আর সব কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচাতে এদের মাথায় আছে আরএসএস-এর ছাতা। আরএসএস-এর নির্দেশমতই তাই এখন বেছে বেছে সেইসব রাজ্যে যেখানে বিজেপি কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে , সেখানে ভোটের ঠিক দু’মাস আগে একটা করে পার্টি অফিস খুলছে তৃণমূল। দেদার টাকা উড়িয়ে সেখানে ভোট কেনার ব্যবস্থা করছে। মাত্র ৩/৪ শতাংশ ভোট কেটে নিলেই বেশ কিছু আসনের ফল এদিক ওদিক হয়ে যায়, সুবিধা লাভ করছে বিজেপি। যেই ভোট শেষ হয়ে যাচ্ছে সেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে সব হাওয়া। ঠিক যেন মেলা শেষ, তাই অস্থায়ী দোকানও ভ্যানিশ। গোয়া এরকম ঘটনার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। পরের বছর বিজেপি-কে বাঁচাতে ত্রিপুরাতেও ঠিক এরকম ‘গোয়া মডেলের’ ব্যবস্থা করেছে আরএসএস তার বিশ্বস্ত সাথি তৃণমূলকে দিয়ে। এর বিনিময়ে তৃণমূল পাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে চলা কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির সব তদন্তগুলিকে গুরুত্বহীন করে ঠান্ডাঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার আশ্বাস ।
বস্তুত, আরএসএস-র সাথে সুসম্পর্কে কোনোদিনই ভাটা পড়েনি তৃনমূল নেত্রীর। এই রাজ্যে বিজেপি-র বিরুদ্ধে নির্বাচনে তৃণমূল লড়লেও আরএসএস-র সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বরাবরই তৃণমূলকেই সাহায্য জুগিয়ে গেছে, এমনকি সদস্যদের সরাসরি নির্দেশও দিয়েছে তৃণমূলকেই ভোট দেবার জন্য। কারন দুটি – এক, কমিউনিস্ট বিরোধিতা , দুই বিজেপি-র ভোটে জেতার থেকেও আরএসএস-র কাছে বেশি প্রয়োজন বাংলার অসাম্প্রদায়িক সমাজের চরিত্র পরিবর্তন। তাই ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল জেতার পরে আরএসএস-র বাংলা পত্রিকা ‘স্বস্তিকা’ও স্বস্তি ব্যক্ত করেছিল তৃণমূল নেত্রীর প্রতি। আর করবে নাই বা কেন ? ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগেই একটা সর্বভারতীয় চ্যানেলের অনুষ্ঠানে তৃণমূল নেত্রী আরও একবার পরিস্কার করে বলেছিলেন – ‘আরএসএস-র সাথে আমার কোনও বিরোধ নেই’। আসলে এই রাজ্যে সঙ্ঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। বাংলায় জাতি ধর্ম বর্ণে ভেদাভেদের কাজটা সুন্দরভাবে করেছেন দশ বছরে। উর্বর জমি তৈরি করেছেন সঙ্ঘ পরিবারের। ২০১১ থেকে ২০২১ মাত্র দশ বছরে সঙ্ঘের প্রকাশ্য শাখার সংখ্যা দেড়শ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দু’হাজারে। এমনিতেই সঙ্ঘ পরিবার আদপে একটা গুপ্ত সংগঠন। নামে বেনামে এদের হাজার রকম শাখা প্রশাখা। এদের সদস্যদের অল্প অংশই প্রকাশ্যে, বেশির ভাগটাই গোপনে, কিছু অংশ স্লিপার সেল হিসেবে আবার কেউ বা কখনও প্রয়োজনে ‘হুইল চেয়ারে’! এদের পয়লা নম্বর দুশমন কমিউনিস্টরাই ।
১৯৯৮ সালে আসানসোলে এক নির্বাচনী জনসভায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পরিস্কার ভাষায় বলেছিলেন- কংগ্রেসের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশটাই আজ বাংলায় তৃণমূল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বরাবর মতই জ্যোতিবাবুর মুল্যায়ন ছিল নির্ভুল। আজ সেটা প্রমাণিত সত্য ।