খাদ্য আন্দোলনের প্রথম শহীদ রান্ধুনী হেমরম
-
মানবেশ চৌধুরি
- Aug 31, 2021 18:13 [IST]
- Last Update: Aug 31, 2021 18:13 [IST]
খাদ্য আন্দোলনের প্রথম শহীদ অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুর জেলার কমরেড রান্ধুনী হেমরম।
সারা রাজ্যের মতো এ জেলায় ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাস থেকেই ধান চালের দাম বাড়তে থাকে। সেসময় কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভার উদ্যোগে খাদ্য সঙ্কট নিরসনের দাবিতে থানায় থানায় বিরাট বিরাট মিছিল সংঘটিত হতো। এরকম একটা মিছিল হয়েছিল বালুরঘাটে এসডিও অফিসে ডেপুটেশন দেওয়া উপলক্ষে। পায়ে হেঁটে দশ হাজার মানুষ শামিল হয়েছিলেন। যার মধ্যে পাঁচ হাজারই ছিলেন তপন থানার।
১৯৫৪ থেকে ’৫৮-’৫৯ সাল পর্যন্ত বন্যা, খরা ইত্যাদির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র, বিশেষ করে চালের দাম বাড়িয়ে দিত। বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি হতো। খাদ্য সঙ্কট তখন ছিল একটা সাধারণ ঘটনা। ঐ সময় কোথাও ইউনিয়ন বোর্ডের অফিসের সামনে ধরনা দেওয়া হতো, কোথাও জোতদাররা দেড়িয়া-দুনা (দেড়গুণ/দু’গুণ) সুদ যাতে আদায় করতে না পারে তার জন্য আন্দোলন হতো। কোথাও সার্কেল অফিসার বা এসডিও-এর কাছে গণডেপুটেশন নিয়ে গিয়ে জিআর, টিআর-এর দাবি করা হতো।
১৯৫৮ সালে কালিয়াগঞ্জে দুটি বড় তাৎপর্যপূর্ণ সংগ্রাম হয়েছিল। গোরুর গাড়ি বোঝাই করে টেস্ট রিলিফের কাজের চাল কালিয়াগঞ্জ থেকে মুদাফৎ নামে একটা গ্রামে যাচ্ছিল। কংগ্রেসী আমলে এখনকার সময়ের মতো টেস্ট রিলিফের চাল গ্রামের অঞ্চল পঞ্চায়েত বাবু আর কংগ্রেসী নেতাদের বাড়িতে চলে যেত। কখনও দু-এক কোদাল মাটি কাটা হতো।
গ্রামে গ্রামে তখন চরম খাদ্যাভাব। আদিবাসী-রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ না খেতে পেয়ে ধুঁকছেন। জঙ্গলের কচুর মূল, ওলের ডাটা, শাকপাতা সেদ্ধ করে কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন।
মুদাফৎ যাবার পথে পড়ে বাতাসন গ্রাম। মুদাফৎ-কইপুকুর আদিবাসী পাড়ার পুরুষ মানুষ বাড়িতে প্রায় নেই বললেই চলে। কমরেড রান্ধুনী হেমরমের নেতৃত্বে বাতাসনে সেই গোরুর গাড়ি আটক করে নারীরা খাদ্যসামগ্রী ছিনিয়ে নিলেন। পাশেই সীমান্ত চৌকি। সেই বিওপি থেকে সশস্ত্রবাহিনী এসে গুলি চালিয়ে দিল। কমরেড রান্ধুনী হেমরম সেখানেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
এই হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কালিয়াগঞ্জ শহরের মহেন্দ্রগঞ্জে বিরাট জনসভা সংগঠিত হয়।
আর একটি ঘটনা হলো, কালিয়াগঞ্জ শহরের আমবাগানে দাশিয়া, মাহিনগর, শেরগ্রাম প্রভৃতি গ্রামের নারীরা জমায়েত হন। বেশিরভাগই রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁরা তৎকালীন সিপিআই, পরে পার্টি ভাগ হলে সিপিআই(এম) নেতা কমরেড কানু ঘোষের নেতৃত্বে খাদ্য বোঝাই ট্রেন আটক করেন। তাঁরা ওয়াগন ভেঙে তাঁদের ক্ষুধার্ত শিশু পুত্র-কন্যা পরিজনদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করেন। পুলিশ এলে মারমুখী নারীরা ‘গোলামের ব্যাটারা....’ এই কথা বলে পুলিশবাহিনীকে হটিয়ে দেন। এই ঘটনাতেও কালিয়াগঞ্জ ও সারা জেলায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
১৯৫৯ সালে পর্বে পর্বে সংঘটিত হয় রাজ্যজুড়ে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন। ঐ প্রত্যেক পর্যায়েই বিশেষ করে কালিয়াগঞ্জ ও গঙ্গারামপুরের কৃষকরা বড় বড় আন্দোলন গড়ে তোলেন। ৩১ আগস্টে যে দিন কলকাতায় লক্ষ লক্ষ নর-নারী আইন অমান্য করেন ও শত শত নিহত হন জল্লাদ কংগ্রেসী পুলিশের লাঠির আঘাতে, সেইদিন কালিয়াগঞ্জে শত শত কৃষক আইন অমান্য করে প্রেসিডেন্সি জেলে নীত হন।