সাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র করার ডাক, বৃত্ত বড় করেই সংগ্রাম
-
-
- Aug 06, 2022 11:27 [IST]
- Last Update: Aug 06, 2022 11:27 [IST]
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখেনি, গত শতাব্দীর তিনের দশকের পরে ফ্যাসিবিরোধী মহাসংগ্রামেও তারা প্রগতিশীল সবাইকে সমবেত করেছিল। কমিউনিস্টদের সেই ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে শুক্রবার মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে আজকের দিনেও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান রক্ষায় সংগ্রামের বৃত্ত বড় করার আহ্বান জানালেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। এদিন মহাজাতি সদনের জনসভায় পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, আমরা ব্রিটিশদের আধিপত্যের কাছে বশ্যতা স্বীকার করিনি। সাম্প্রদায়িক আরএসএস আর চিটিংবাজ তৃণমূলের আক্রমণের কাছেও বশ্যতা স্বীকার করব না। যাঁরা শিরদাঁড়া বিকিয়ে দিতে রাজি নয়, তাঁদের সবাইকে একজোট করে এই দুই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করব।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারায় কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের নেতৃত্বে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণ ঘটানোর উল্লেখ করে সেলিম বলেছেন, কেবল একটা আলোকিত শ্রেণির আন্দোলনের বদলে স্বাধীনতা আন্দোলনে গরিব শ্রমজীবীদের টেনে এনে নতুন উপাদান যুক্ত করেছিল কমিউনিস্টরা। চারের দশকের আকালের সময় আমরা কমিউনিস্টরা মানুষের পাশে থেকেছি, আজকে বিজেপি এবং তৃণমূলের শাসনে যারা সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত তাদের কথা বলতে আমরা ভয় পাবো? জিএসটি বসিয়ে গরিবের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে, মানুষের কাজ, খাদ্য, সব অধিকার কেড়ে নিয়ে কিছু ভাতা দেখিয়ে জোর করে আনুগত্য আদায় করছে, জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ যে নতুন প্রজন্ম তাদের কাজের সুযোগ কেড়ে নিয়ে তাই নিয়ে দুর্নীতি করছে, এসবের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদেরই লড়াই করতে হবে।
এই লড়াইতে শ্রমজীবী মানুষকে ব্যাপকভাবে যুক্ত করতে পারলে কী হতে পারে তা বোঝাতে পার্থ চ্যাটার্জিকে জুতো ছুঁড়ে মারা গরিব গৃহবধূ শুভ্রা ঘড়ুইয়ের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে সেলিম বলেছেন, শ্রমজীবী মানুষের রোষ কেমন হয় টের পাচ্ছেন? গ্রেপ্তার হওয়া পার্থ চ্যাটার্জিকে যদি উডল্যান্ডস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো তাহলে হয়তো কেউ তাঁকে জুতো ছোঁড়ার সাহস দেখাতো না। কিন্তু ইডি তাঁকে শ্রমজীবীদের হাসপাতালে (ইএসআই) নিয়ে গেছিল বলেই সেখানে শ্রমজীবী গৃহবধূ রোষ দেখিয়েছেন। মোদী, দিদির হাতে আক্রান্ত এই শ্রেণির সব মানুষের কাছে আমাদের যেতে হবে, তাদের রোষকে জাগাতে হবে এবং সংগঠিত আন্দোলনে টেনে আনতেই হবে। এটাই এই সময়ের চ্যালেঞ্জ।
সভায় সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্রও বলেছেন, বুলডোজার দিয়ে কৃষকদের উচ্ছেদের চেষ্টা করলে কৃষকরাও কিন্তু ট্রাক্টর দিয়ে বুলডোজার ঘিরে ফেলতে পারে। এরজন্যই আমরা সর্বহারা আধা সর্বহারা সবাইকে নিয়ে সংগ্রামের ঐক্য গড়ার কথা বলছি। এটা কয়েকটা দলের বোঝাপড়া নয়, আমাদের শ্রেণির মধ্যে লড়াইতে আগ্রহী সবার মধ্যে বোঝাপড়া। তাই আমাদের পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে, বামফ্রন্টকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, বামফ্রন্টের বাইরের বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং তার বাইরেও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সবাইকে একজোট করতে হবে। কেউ কেউ ‘একলা চলো রে’ বলেন। কিন্তু রবি ঠাকুরের গানের ঐ কথার আগের কথাগুলো বাদ দিয়ে কেবল একলা চলা যায় না। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ আন্তরিকভাবে ডাক দিয়ে সবাইকে জড়ো করার চেষ্টা ভুলে গেলে চলবে না।
১৯২৬ সালে গণবাণী পত্রিকায় মুজফ্ফর আহ্মদ স্বাধীন ভারতে সার্বজনীন ভোটাধিকার, জমিদারি উচ্ছেদ, শ্রমিকদের মজুরি ও কাজের সময়, সামাজিক কুপ্রথার অবসান, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, প্রেস ও বক্তব্যের স্বাধীনতা, নারী পুরুষ সমানাধিকার, সাধারণের হিতকারী ব্যবস্থার সামাজিক মালিকানা ইত্যাদি দাবির কথা তুলে ধরেছিলেন। মহম্মদ সেলিম এর উল্লেখ করে বলেছেন, আজকের দিনে এর সবগুলোই আক্রান্ত। সেই সময়ে নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতাটি লিখে কাকাবাবুকে শুনিয়েছিলেন। আজ যদি এমন কবিতা কেউ লেখে তাহলে শাসকরা কী করবে? দেশদ্রোহী বলে আক্রমণ করবে। সুভাষ বসু আর নেহরুর পরিকল্পিত প্ল্যানিং কমিশনকে তছনছ করে এরা নীতি আয়োগ তৈরি করেছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুর্নীতি থেকে বাঁচার জন্য একান্ত আলোচনা করতে মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি গিয়েছেন। অমর্ত্য সেন মানুষের সক্ষমতা তৈরির কথা বলেছেন। দিদির লুট আর মোদীর লুট মিলেমিশে মানুষের সক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, ৫০০ টাকার ভাণ্ডার দেখিয়ে বশ্যতা আদায়ের চেষ্টা করছে। দুই পক্ষ মিলে রাজ্যপালকে ভাঁড় সাজিয়েছিল, এখন তাঁকে উপরাষ্ট্রপতি বানানোর ভাঁড়ামো করছে। এরাজ্যকে সততার প্রতীক দেখিয়ে প্রতারণা করা হয়েছিল, এখন দেশবাসীকে সিংহের গর্জনের প্রতীক দেখিয়ে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। রাম, কালীপুজো এসবের মধ্যে মানুষকে আটকে রেখে দেদার কর্পোরেট লুটের বন্দোবস্ত হচ্ছে।
সূর্য মিশ্র বলেছেন, আরএসএস না থাকলে এরাজ্যে তৃণমূলের জন্মই হতো না। ওরা তৃণমূলনেত্রীকে মা দুর্গা বলেছিল, আর ইনি ওদেরকে দেশপ্রেমিক বলেছিলেন। এদের মধ্যেকার সম্পর্ককে কখনও ভুলে যাবেন না।
মিশ্র বলেছেন, হিন্দুত্বের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই, এটা আরএসএস’এর রাজনৈতিক প্রজেক্ট। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে যা দীর্ঘতম মন্দা। আইএমএফ ২০২৩ সালে মন্দার কথাও বলেছে। এরকম পরিস্থিতির মধ্যেই ফ্যাসিবাদ মাথা তোলে, এখানেও সেই লক্ষ্মণগুলিই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ সহ নানা জায়গায় প্রতিরোধও দেখা যাচ্ছে।
সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম সভায় বলেছেন, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গড়তে আজকের ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ফসল সংবিধান আক্রান্ত। মনুসংহিতা দিয়ে তাকে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা হচ্ছে। কেন্দ্রের শাসক দলের এই অপচেষ্টায় পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনা উৎসাহ পাচ্ছে। নারীর অধিকার, আদিবাসী ও দলিতদের অধিকার আক্রান্ত হচ্ছে। আর তার আড়ালে কর্পোরেট লুট বাড়ছে। তাদের সম্পদ বাড়াতে জল জমি জঙ্গল লুট হয়ে যাচ্ছে, এরাজ্যে দেউচা থেকে ফরাক্কার আমবাগান সবই আক্রান্ত হচ্ছে। মুজফ্ফর আহ্মদের সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
মহাজাতি সদনের এদিনের অনুষ্ঠানে সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু সহ এরাজ্যের সিপিআই(এম)’র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করে বিমান বসু মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মদিবস উদ্যাপনের বিশেষ প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেছেন, কাকাবাবু কখনোই জন্মদিন পালন করতে চাননি। কিন্তু আজ থেকে ৫৯ বছর আগে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মতাদর্শগত সংগ্রামের উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট পার্টিতে সিদ্ধান্ত করে তা পালন করা শুরু হয়েছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশতে জানতেন বলেই তিনি কাকাবাবু নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সমসাময়িক আন্দোলন সংগ্রামকে শক্তিশালী করাই আমাদের উদ্দেশ্য।