‘৩৪ বছর’ ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে এক উজ্জ্বল প্রতীক
-
মৃদুল দে
- Jun 21, 2022 16:54 [IST]
- Last Update: Jun 21, 2022 16:54 [IST]
‘৩৪ বছর’— ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠেছে। এর স্মারক ২১ জুন, যেদিন বামফ্রন্ট সরকারের সূচনা। বামফ্রন্টের শত্রুরা ১৯৭৭ সালের ২১ জুন বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার দিন থেকে কুৎসা করে আসছে। এখনও তার বিরাম নেই। এই ৩৪ বছরকে পশ্চিমবঙ্গের ও ভারতীয় রাজনীতির অধ্যায় থেকে মুছে দেবার প্রয়াসও চলছে। কারণ ৩৪ বছর— অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য, তার নীতি এবং বিকল্প দিশা দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির চিরন্তন আতঙ্ক। সম্পূর্ণ জনবিরোধী একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার সবরকমের একটা বাধার মধ্যে বামপন্থী সরকার পরিচালনা তা-ও ৩৪ বছর ধরে, এক অসাধারণ মূল্যবান এক অবদান। ভবিষ্যতে গণআন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলন বিকাশের সহায়ক হয়ে উঠবে— এই দূরদৃষ্টি নিয়েই সরকার পরিচালনা শুরু। ভুলত্রুটি হয়নি, নেতিবাচক কিছুই হয়নি, যা হয়েছে তার চেয়ে বেশি করার ছিল না— এরকম বাগাড়ম্বর বামপন্থীরা কখনই করেনি এবং এটা একমাত্র কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের পক্ষেই সম্ভব।
এরকম একটা জনবিরোধী কাঠামোর বাধা ছাড়াও বামপন্থার শত্রু কায়েমি স্বার্থ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বাধা ও ষড়যন্ত্র, কেন্দ্রীয় সরকারের বাধার মধ্যে বহুবিধ সীমাবদ্ধতার কথা জনগণের কাছে বামফ্রন্ট আড়াল করেনি, নির্বাচনের আগেই পরিষ্কার ভাষায় তা বলা হয়েছে, যাতে কোনও মিথ্যা আশা-আকাঙ্ক্ষা গড়ে না ওঠে। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনের আগে প্রচারিত ৩৬ দফা কর্মসূচি এই ভিত্তির ওপরই তৈরি হয়েছে যেখানে বলা হয় এত বাধা, এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চৌহদ্দির মধ্যেই জনগণের চরম দুর্দশা কিছুটা লাঘব করা সম্ভব। জনগণের মৌলিক সমস্যার সমাধান এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় অসম্ভব ও সম্পূর্ণ অবাস্তব হলেও সরকার ও জনগণ একযোগে কাজ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে নতুন বিকল্প পথ দেখাতে পারে যা তিন দশকের কংগ্রেস শাসনকে কোথাও কখনও তুলনায় তার ধারকাছে আসে না।
যে ব্যবস্থা ভেঙে জনগণের পক্ষের রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরিই কমিউনিস্টদের মূল লক্ষ্য, সেই ব্যবস্থার মধ্যেই জনগণের আশু সমস্যাগুলির সুরাহায় তাদেরই নেতৃত্বাধীন বামপন্থীদের ফ্রন্ট অপরিজ্ঞাত ও অতীতের কোনও অভিজ্ঞতাহীন পথে বাধা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবে, এটা কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন ও নতুন পথ সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেই ‘‘৩৪ বছর’’। মার্কসবাদ প্রয়োগেরও নতুন পরীক্ষা। এজন্যই—৩৪ বছর।
এই আত্মপ্রত্যয়ের উৎস কী? স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে কংগ্রেসের ৩০ বছরের জনবিরোধী ও স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নৃশংস অত্যাচার-দমনপীড়নের মধ্যেও জনগণকে নিয়ে ধারাবাহিক লড়াইয়ের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। মার্কসবাদী বিজ্ঞানের নীতি-আদর্শের প্রতি অচঞ্চল আস্থা, জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য, অবিচলিত দায়বদ্ধতা। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে এই বামপন্থীদের মৌলিক পার্থক্য ও দৃষ্টিভঙ্গিই অব্যর্থ গতিসঞ্চারী শক্তি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে, পার্থক্য তুলে ধরার কয়েকটি মূলমন্ত্র উল্লেখ করা যায়।
গণতন্ত্র
সন্ত্রাস, অত্যাচার, আন্দোলন দমন, লাঠি-গুলি, পুলিশ ও সমাজবিরোধীদের হামলা, মিথ্যা অভিযোগে মামলায় ফাঁসানো, বিনা বিচারে আটক আইন, ভয়-হুমকি ছাড়া কংগ্রেস শাসন করতে পারেনি এরাজ্যে। জনগণের জরুরি দাবি নিয়ে আন্দোলনের ওপর সবসময় আক্রমণ হয়েছে, নেতাদের বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থার আগে তার চেয়েও কম ভয়ঙ্কর কংগ্রেসী শাসন এ রাজ্যে ছিল না— ১৯৭০ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত— কংগ্রেস ও তাদের সমাজবিরোধী বাহিনী এবং পুলিশ ও তাদের সমাজবিরোধী বাহিনী এবং পুলিশ, সিআরপি একযোগে সিপিআই(এম) ও বামপন্থীদের ওপর সীমাহীন সন্ত্রাস চালিয়েছে। পাশাপাশি নকশালপন্থীরাও তাদের খুন-হামলা সিপিআই(এম)’র বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত করে। এ সময়ে এলাকা ছাড়া হয় কয়েক হাজার পরিবার, দেড় হাজারের বেশি সিপিআই(এম) কর্মী ও নেতা খুন হন। ১৯৭২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সন্ত্রাস ও রিগিং করে কংগ্রেসের চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রহসনও সারা দেশের অদ্বিতীয় কলঙ্কিত নজির। কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলকে এরকম ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাসের মধ্যে কখনও পড়তে হয়নি।
২১ জুন সরকার শপথ নিয়েই ঐদিন মন্ত্রীসভার প্রথম সভা থেকে ঘোষণা করে এবং জনগণের প্রতিও আবেদন করে যে, বিরোধীদের প্রতি কোনও প্রতিহিংসামূলক আচরণ যেন না হয়, সমস্ত অংশের মানুষের এবং বিশেষত, বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার যেন সুনিশ্চিত হয়। ৩৪ বছর অক্ষরে অক্ষরে তা পালিত। রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সব বন্দিরা মুক্ত হয়। কংগ্রেস সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দশ হাজারের বেশি ফৌজদারি মামলা বাতিল করা হয়। বাতিল জরুরি অবস্থার সব নিপীড়ন ব্যবস্থা, বিনা বিচারে আটক আইন। বরখাস্ত শিক্ষা-সরকারি কর্মীদের পুনর্বহাল, পুলিশ ও সরকারি কর্মী সহ সকলের সংগঠন করার অধিকার স্বীকৃত। প্রতিহিংসামূলক হেনস্তা, হয়রানি, বদলি, ভয়-হুমকি ইত্যাদি নিশ্চিত হয়। অতীতের কংগ্রেস শাসনে বর্তমান বিজেপি, রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস বা অধিকাংশ অবামপন্থী শাসনে বিরোধীদের এ ধরনের অধিকার কল্পনাও করা যায় না। শুধু পুনঃপ্রতিষ্ঠা নয়, সম্প্রসারিত করা হয় গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা।
এরকম একটা শ্রেণিবৈষম্যের সমাজে সমাজবিরোধী, ষড়যন্ত্রী নানারকম অন্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সক্রিয় থাকে যাদের পেছনে দেশ-বিদেশের কায়েমি স্বার্থের মদত সবসময় থাকে। গণতান্ত্রিক অধিকারের সুস্থ পরিবেশের সুযোগ নিয়ে নানা স্লোগানে জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বামপন্থী ফ্রন্ট সরকারের শুরু থেকে এরা অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে যেমন জামাতে-ইসলাম, আরএসএস, আনন্দমার্গ, আমরা বাঙালি ইত্যাদি। পুলিশ প্রশাসনের মধ্যেও একটা অংশ সরকারকে হেয় করার কাজে নানাভাবে লিপ্ত থাকে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত কোনোরকম হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে সরকার। চারটি প্রধান সংবাদপত্র গোষ্ঠী এসময়ে সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচারে লিপ্ত থাকে, পরে অন্য পত্রিকাও আসে, বেশিরভাগ মূলত বামফ্রন্টের শত্রুতা করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির শক্তিকে মদত দেবার ভূমিকাই তারা পালন করেছে ৩৪ বছরে। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা কংগ্রেস কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পর এরাজ্যের ওপর বৈষম্য ও আর্থিক চাপ সৃষ্টির স্বল্প সময়ে অভূতপূর্ব সাফল্য এবং বিকল্প নীতির কার্যকারিতা দেখে বামপন্থী সরকারকে বিপদে ফেলা এবং তার মধ্য দিয়ে পতন ঘটানোর চেষ্টা শুরু করে। প্রায় প্রতিদিন ঐসব সংবাদপত্রে আওয়াজ তোলা হয়, ৩৫৬ ধারায় বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করা হবে। এতেই ক্ষান্ত হয়নি, কংগ্রেসের মস্তান বাহিনীকে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য নামানো হয়। বেশকিছু ক্ষেত্রে পুলিশ চরম হিংসাত্মক ও নৈরাজ্যমূলক কার্যকলাপে বাধা দেয়নি। ১৯৮০-৮১ সাল জুড়ে নানা অজুহাতে কংগ্রেসী তাণ্ডব চলে। বোমা-পিস্তল নিয়ে ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ আচমকা পূর্বকল্পিত ছক অনুসারে কংগ্রেস কলকাতায় হিংসাত্মক আইন-অমান্য করে পুলিশের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে। বোমা ও পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হলে ৩ এপ্রিল ডাকা কংগ্রেসী বন্ধে ব্যাপক বোমাবাজি করে রাজ্যজুড়ে নৃশংস বর্বরতা চালায়। এটা কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রেরই অংশ। একদিনের ঘটনায় ২৫ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৫জন কংগ্রেসী বন্ধের দিন কাজে যোগ দিতে গিয়ে বোমায় প্রাণ হারান, নিহতদের মধ্যে ৫জন মহিলা কলকাতায় ১৭৮ জন সহ রাজ্যে মোট আহত হয় ২৮৫ জন। এই সন্ত্রাসের আরেক উদ্দেশ্য, স্বাধীনতার পর এই চার বছরে অর্জিত জনগণের অভূতপূর্ব অধিকার কেড়ে নেওয়া। জরুরি অবস্থায় গণতন্ত্র ধ্বংসের পরও কংগ্রেস স্বৈরতান্ত্রিক রাস্তা থেকে সরে আসেনি, পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতাও। এছাড়া শাসন চালানো তাদের পক্ষে খুব কঠিন।
আর্থিক সঙ্কটের জন্য দ্বারস্থ হতে হচ্ছে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফ’র কাছে, তাদের শর্ত মানতে গিয়ে জনবিরোধী ব্যবস্থা বাড়িয়েই যেতে হচ্ছে। অন্যান্য রাজ্যগুলিরও এই অবস্থা। এই সঙ্কট থেকেই কংগ্রেসে ভাঙন, বিচ্ছিন্নতাদের হাত ধরা। আপস-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মনোভাব নমনীয়তর করা। বিজেপি-আরএসএস তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ থেকে ছ’বছরের জন্য কোয়ালিশন সরকার গঠন করে কংগ্রেসের চেয়েও আগ্রাসী আর্থিক আক্রমণ পরিচালনা করে, সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক ও বৈধ রূপ দিতে নেমে পড়ে। তার চরমে প্রত্যক্ষ ফ্যাসিস্ত পদ্ধতি নিয়ে এখন আট বছর ধরে মোদীর শাসন। কংগ্রেসও আক্রান্ত। যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলার মধ্য দিয়ে বামফ্রন্ট সরকারকে পথ চলতে হয়েছে, তার শেষ অধ্যায়ে কংগ্রেস, বিজেপি, আরএসএস সহ দেশের সব প্রতিক্রিয়াশীল ও দক্ষিণপন্থী শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের পেটোয়া প্রচারযন্ত্র, আধুনিক মিডিয়া, বহু ধরনের এনজিও, বিদেশি এজেন্সি, কর্পোরেট শক্তি একজোট হয়, সামনে নিয়ে আসে আরএসএস পুষ্ট তৃণমূল কংগ্রেসকে। ৩৪ বছরের ঐতিহ্যের পরিসমাপ্তি রচিত হয় ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। ১১ বছরের তৃণমূল শাসন ফ্যাসিস্ত পদ্ধতির শাসন, সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর ব্যাভিচার, দুর্নীতি, জঙ্গলরাজ, দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে তুলেছে গণতন্ত্র সম্প্রসারণে ও বিবিধ নজিরবিহীন সাফল্যে বামফ্রন্টের ৩৪ বছর। পরিণত হয় ভারতীয় গণতন্ত্রের অগ্রগণ্য ঘাঁটিতে।
এটা কোনও ভারতীয় বৈশিষ্ট্য নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের অবগমনের ঐতিহাসিক ধারা। বোনাপার্টের শাসন ধারার উদ্ভব অন্যভাবে বলতে গেলে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যখন গণতান্ত্রিক সংবিধান বা সংসদীয় পথে শাসকশ্রেণি শসন চালাতে অক্ষম হয়ে উঠছে, বা যখন সঙ্কট রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেঙে ফেটে পড়ার পর্যায়ে এসে ঠেকে, তখন একজন স্বৈরতন্ত্রী নেতৃত্বের উদয় হয়। মার্কস তাঁর বিখ্যাত ‘লুই বোনাপার্টের ১৮ই ব্রমেয়ার বইতে তুলে ধরেছেন। সেই থেকে একবিংশ শতাব্দীর আজকের দিনের ঘটনাবলী পর্যন্ত তা বৈজ্ঞানিক সূত্র ও সত্যে পরিণত হয়েছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর স্বৈরতন্ত্রী আঘাত ছাড়া তৃণমূলী শাসন বা মোদী শাসন একদিনও টিকে থাকতে পারে না, যখন তিন দশকের নয়াউদারীকরণ ব্যবস্থার নিরাময়হীন কোথাও শাসকশ্রেণি সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিতে অক্ষত রেখে সহজভাবে এবং আগের মতো চালাতে অক্ষম এবং জনগণকে থরহরিকম্প গহ্বরে নিক্ষেপ করতে বাধ্য। ফ্যাসিস্ত, আধা-ফ্যাসিস্ত, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও চরম দক্ষিণপন্থার দৌরাত্ম্যের উৎস এখানেই। এর বিরুদ্ধেই আজকের বিশ্বজনীন লড়াই, এই আবহই ‘৩৪’ বছরকে মর্যাদার শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত করছে, যখন ৩৪ বছর ধরে গ্রাম থেকে শহর, পঞ্চায়েত থেকে পৌরসভা, সমবায় থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র গণতান্ত্রিক পরিচালনা, বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সময়মতো নির্বাচন এবং যে-ই জিতুক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে কাজ— ইত্যাদি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। কংগ্রেস অতীতে যে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করেছে, সঙ্ঘ পরিবারের ও প্রতিক্রিয়ার সহযোগে তৃণমূল কংগ্রেস সেই হিংস্রতাই বামফ্রন্টের সময় করেছে। জড়ো করে সব খুনি, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সমাজবিরোধীদের। ১১ বছর এই পাশবিক শক্তিই তৃণমূলের ভরসাস্থল। ফলে আগাপাছতলা দুর্নীতি, লুট, জুলুম, নৈরাজ্য, খুনোখুনি নারী নির্যাতন, জালজুয়াচরি, গণতন্ত্র বধ, অধিকারহরণ তৃণমূলী শাসনের বৈশিষ্ট্য। এই স্বৈরতন্ত্রী ও ফ্যাসিস্তসুলভ দুঃশাসনের বৈপরীত্যে ‘৩৪ বছর’ অক্ষয় কীর্তিতে ইতিহাসে আরও মহান হয়ে উঠেছে।
নতুন পরিস্থিতিতে বামফ্রন্ট সরকার
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুরাতিক্রম্য বাধা, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা, কেন্দ্রীয় শাসনের বৈরিতা, বহুরকমের ষড়যন্ত্র ছাড়াও পরিস্থিতি পরিবর্তনের প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে বামফ্রন্টকে। এই ৩৪ বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটেছে, তার জন্য কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিদেশে এবং দেশে কুৎসা আক্রমণের ঝড় বয়েছে, নয়া-উদারীকরণ নতুন নতুন আর্থিক অসুবিধা, সঙ্কট ও জটিলতা সৃষ্টি করেছে, কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, দেশজুড়ে সঙ্ঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িকতা রাজনৈতিক প্রাঙ্গণকে গ্রাস করেছে, আর্থিক অসাম্য ও সঙ্কটে জর্জরিত দেশের আর্থিক বোঝার চাপও যথেষ্ট, যা উন্নয়নের স্রোতকে পদে পদে ব্যাহত করেছে। তার মধ্যেও সমাজের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে বামফ্রন্ট জনগণকে নিয়ে তার কর্মসূচি রূপায়ণ সর্বসাধ্য কাজ করেছে নীতির প্রতি এবং নিচের অংশের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি অবিচল দায়বদ্ধতার মাধ্যমে। এরকম অবস্থায় মানুষকে সবটা বোঝানো সম্ভব হয়েছে, তা নয়। এই দুর্বলতা এবং শত্রুপক্ষের সর্বাত্মক কুৎসা অভিযান বহু মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে সীমাহীন নিপীড়ন সইতে হয়েছে, বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, ৩৪ বছরের সময়কালেও আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে, গত ১১ বছর এই তৃণমূলী হিংস্রতা ও অপশাসনের মোকাবিলার লড়াই থেকেও বামপন্থীরা এক ইঞ্চি সরেনি। যে পরিস্থিতিই হোক, জনগণ থেকে বামপন্থীদের বিচ্ছিন্ন করার বহুমুখী অভিযান সফল হয়নি, হবেও না। এই অফুরন্ত অদম্য শক্তিই শত্রুর শঙ্কা এবং নির্যাতিত শ্রমজীবী জনগণের চিরন্তন প্রত্যয়।
ভূমিসংস্কার
ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভূমিসংস্কারের মতাদর্শগত প্রেরণা জোগায় নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে, চাষ যার, জমি তার। কংগ্রেস নেতারাও এই স্লোগানের অংশীদার। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকসভা তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দাবিতে লড়াই করে আসছে। তেলেঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ এবং তেভাগা আন্দোলন ছাড়াও প্রত্যক্ষ রাজ্যে ছোট-বড় অসংখ্য আন্দোলন কংগ্রেস স্বাধীনতার পর ভূমিসংস্কারের কথা বলে, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রিপোর্টে একটি অধ্যায় থাকতো ভূমিসংস্কার অনেক গলদপূর্ণ আইনও হয়েছে দেশে, যা কার্যকর হবার নয়। বিভিন্ন দলের ক্ষমতার কেন্দ্র গ্রামীণ ধনী, বৃহৎ জমির মালিক, গ্রামীণ ঠিকাদার ও কর্পোরেটরা। এই ব্যবস্থা ভাঙতে তারা অপারগ।
কেরালায় ষাটের দশকেই সরকার যথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের পদক্ষেপ নেয়। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে স্বল্পকালীন ২২ মাসের যুক্তফ্রন্টের সময়ে আইন-বহির্ভূত বেনামী জমি উদ্ধার অভিযানে কৃষকদের আলোড়ন গোটা দেশের কৃষক সমাজের নজর কাড়ে। ১৯৭১-১৯৭৬ সালে কংগ্রেস তা কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে প্রতিরোধ সংগ্রাম হয়। নিম্ন জাতসম্প্রদায়ের মধ্যে কেবলই কৃষক ও খেতমজুর, এরাই কৃষকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভূমিসংস্কার আইনের সংশোধনে সরকার প্রথমেই হাত দেয়। তার সঙ্গে বর্গা অপারেশন বা বর্গাদারদেরও নাম নথিভুক্ত করার কর্মসূচি। যে প্রশাসন, পুলিশ, আদালত ভূমিসংস্কারে কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় বাধা তৈরি করেছে, তাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য ১৯৭৮ সালে নতুন পূর্ণাঙ্গ আইনে গঠিত পঞ্চায়েতকে ভূমিসংস্কারে যুক্ত করা হয়— যেমন বেনামী ও সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার, ভূমিহীনদের মধ্যে জমিবণ্টন এবং বর্গাদারদের অধিকারের সুরক্ষা। দেশের বামফ্রন্ট সরকারগুলিই দেশে একমাত্র এই নজির স্থাপন করেছে। এটা মৌলিক ভূমিসংস্কার নয়, কিন্তু গ্রামের কায়েমি স্বার্থের ওপর বড় আঘাত। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ভূমিসংস্কারের পরিবর্তন, গ্রামীণ গরিবদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সেই পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা এ রাজ্যে তৃণমূলীদের লুটের ব্যবস্থায় পরিণত, যার অতি সামান্য কিছু সংবাদ যা বেরুচ্ছে, তার কয়েকহাজার গুণ বেশি লুট ও আপরাধ সংগঠিত হয়েছে। এজন্য পঞ্চায়েত, পৌরসভা দখল রাখতে অবর্ণনীয় সন্ত্রাস, রিগিং, পুলিশ-প্রশাসনের ব্যবহারকে একটা ভয়ঙ্কর মাত্রায় তৃণমূল নিয়ে গেছে।
ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের অস্তিত্বই এখন বিজেপি-আরএসএস’র হাতে বিপন্ন। ফ্যাসিস্ত মতাদর্শী এই শক্তির সবসময়ের চক্ষুশূল সংসদীয় গণতন্ত্র। একনায়কতন্ত্রী ফ্যাসিস্ত হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারব্যবস্থা, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, তদন্ত সংস্থা থেকে সব গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাতন্ত্য বুলডোজারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে সরকারের আর্থিক আক্রমণও তীব্রতর। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জীবন-জীবিকার অধিকার রক্ষার দেশের এই জরুরি সংগ্রামে কেরালা, ত্রিপুরার বামপন্থী সরকার এবং বিশেষত:পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের উজ্জ্বল ইতিহাস একটা অন্যতম অনুপ্রেরণা।