তাজমহল নিয়ে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি
-
রাম পুনিয়ানী
- May 16, 2022 16:56 [IST]
- Last Update: May 16, 2022 16:56 [IST]
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের দেশ। শুধুমাত্র প্রাকৃতিকই কেন, মানুষের তৈরি চমৎকার সব নিদর্শন রয়েছে দেশজুড়ে। এর আকর্ষণ শুধুমাত্র দেশের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সারা বিশ্বের পর্যটকরা এই সব নিদর্শন চাক্ষুষ করতে আসেন। প্রাণভরে দেখে, আশ্চর্য অনুভূতি স্মৃতি সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য তাজমহল। মোঘল বাদশা তাঁর প্রিয় স্ত্রী মুমতাজ মহলের স্মৃতিতে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে রয়েছে তাজমহল। ইউনেস্কোর তরফে বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছে তাজমহল।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শা-জাহান কবিতার একটি অংশে তাজমহল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘একবিন্দু নয়নের জল, কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল, এ তাজমহল।’ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকরা তাজমহল দেখতে আসেন। এটি ভারতবর্ষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনস্থল-সৌধ এবিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে উত্তর প্রদেশের যোগী সরকারের এসব নিয়ে কিছু যায় আসে না। কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। ক্ষমতায় আসার ছ’মাস পূর্তি উপলক্ষে যোগী সরকারের তরফে রাজ্যের পর্যটন সংক্রান্ত একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে। সেই বইয়ের শিরোনাম ‘উত্তর প্রদেশ পর্যটন-অসীম সম্ভাবনা’। এই বইতে রাজ্যের যে সমস্ত পর্যটনস্থলের উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গোরখনাথ পীঠ। যার প্রধান খোদ মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ। এছাড়াও নানা জায়গার উল্লেখ করা হয়েছে রাজ্যের দর্শনীয় স্থান হিসাবে। এই বইতে মূলত ধর্মীয় স্থানগুলি নিয়েই লেখা রয়েছে। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলেও, এটিই সত্যি, এই বইতে দর্শনীয় স্থান হিসাবে তাজমহলের বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই যোগী বলেছিলেন, তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ নয় এবং বিদেশি পর্যটকদের তাজমহলের প্রতিকৃতি উপহার দেওয়ার প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত। পরিবর্তে বিশেষ অতিথিদের গীতা কিংবা রামায়ণ উপহার দেওয়া যেতে পারে। যোগীর কথা অনুযায়ী, এই দু’টি বই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক। তাজমহল নিয়ে যোগীর এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাঁর সাম্প্রদিক চেহারাকে আবারও সামনে এনেছে।
একটি সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারকে যখন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়, সে সময় যোগী সরকারের এক মন্ত্রী বলেন, তাজমহল ভারতীয় ঐতিহ্যেরই অংশ। তবে সরকারের প্রকাশিত বইতে শুধুমাত্র সেই সব দর্শনীয় স্থলগুলিরই উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোর প্রচার এবং প্রসার প্রয়োজন। তিনি এমনও বলেন, তাজমহলের জন্য সরকার আলাদা করে অর্থ বরাদ্দ করেছে এবং আগ্রায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বানানোরও পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে বিজেপি শিবির থেকে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। কেউ বলছেন, তাজ ‘হিন্দু’ মন্দির। আবার কেউ বলছেন, তাজ কোনও গুরুত্বপূর্ণ সৌধ নয়। আবার এমনও মন্তব্য উঠে আসছে বিজেপি শিবির থেকে, তাজমহল হলো ভারতবর্ষের দাসত্বের প্রতীক। বিজেপি নেতা সঙ্গীত সোম এই প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তাতে মুসলিম বাদশাহদের তৈরি নিদর্শন নিয়ে বিজেপি’র দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হয়ে যায়। তাঁর মতে, ‘রাজ্য সরকারের প্রকাশিত পর্যটন সংক্রান্ত বই থেকে তাজমহলের নাম সরিয়ে দেওয়া নিয়ে কিছু লোক খুবই দুঃখ প্রকাশ করছে। আমরা কোন ইতিহাসের কথা বলছি? সেই ইতিহাস, যেখানে তাজমহলের নির্মাতা নিজের পিতাকে জেলে বন্দি করেছিলেন? আমরা কি সেই ইতিহাসের কথা বলছি, এই স্মৃতি সৌধের নির্মাতা উত্তর প্রদেশের হিন্দুদের সর্বনাশ করেছিলেন? এটা খুবই দুঃখের এবং দুর্ভাগ্যজনক, সন্ত্রাসী শাসকও আমাদের ইতিহাসের অংশ।’
গত কয়েক বছরে তাজমহলে পর্যটকের সংখ্যা কমেছে। এবং পর্যটনস্থল হিসাবে এর প্রচার নিঃসন্দেহে জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাজমহলের নাম সরকারি বই থেকে কেন সরিয়ে দেওয়া হয়েছে? তাজমহল নিয়ে আদিত্যনাথ বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত মন্তব্য করেছেন, তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার, তাজমহল তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়। তাজমহল এমন এক ব্যক্তির দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, যাকে হিন্দুত্বের ভাবনায় হামলাকারী মানা হয়। ভারতীয় সংস্কৃতিকে মহাত্মা গান্ধীর মতো মনীষীরা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে, যোগী এবং তাঁদের দৃষ্টিকোণ পুরোপুরি বিপরীতধর্মী। বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদীদের কাছে, হিন্দু সংস্কৃতিই ভারতীয় সংস্কৃতি।
এর থেকেও কিছু সঙ্ঘী এবং হিন্দুত্ববাদীর আস্ফালন এবং আকাট যুক্তি, তাজমহল একটি হিন্দু মন্দির এবং এর নাম তেজো মহালয় ছিল! যদিও ইতিহাস কিংবা কোনও যুক্তিতেই তার প্রমাণ মেলে না। শাহজাহানের ‘বাদশাহনামা’ গ্রন্থে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, তাজমহলের নির্মাণ শাহজাহানই করিয়েছিলেন। সেই সময়কালে ভারতে আসা এক ইউরোপীয় পিটার মুডি লিখেছিলেন যে, বাদশা শাহজাহান নিজের প্রিয়তম স্ত্রীর মৃত্যুতে দুঃখের সাগরে ডুবেছিলেন। তাঁরই স্মৃতিতে একটি সুন্দর মহল তৈরি করছেন। ফরাসি পর্যটক তেওরনিয়র, যিনি সে সময় ভারতে ছিলেন, তিনিও একই কথা বলেছেন। শাহজাহানের হিসাব রাখার খাতাতেও তাজমহল নির্মাণের খরচের উল্লেখ রয়েছে। যেখানে নির্মাণ সামগ্রী কেনা, মজুরি এবং অন্যান্য খরচের হিসাব রয়েছে।
তাজমহলকে শিব মন্দির বলার যে দাবি উঠেছে, তার একমাত্র ভিত্তি, তাজমহল যে জমিতে তৈরি হয়েছিল, সেটি শাহজাহান রাজা জয় সিংয়ের থেকে কিনেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য, রাজা জয় সিং বৈষ্ণব ছিলেন। এবং কোনও বৈষ্ণব রাজার থেকে নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করা যায় না, তিনি সেখানে শিব মন্দির বানাবেন!
পুরো বিষয়টির সারমর্ম হলো, তাজমহলের গুরুত্ব কমানোর এক অপচেষ্টা চলছে। ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করে বলপূর্বক হিন্দুত্ববাদী ভাবধারা স্থাপনের পরিকল্পনার অংশ এটি। এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হচ্ছে। তথ্য বিকৃত করা হচ্ছে। এমনও দাবি করা হচ্ছে যে, মহারাণা প্রতাপ এবং আকবরের হলদিঘাটের যুদ্ধে, মহারাণা বিজয়ী হয়েছিলেন। হলদিঘাটের যুদ্ধ ছিল ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেটা কিন্তু ধর্মের কারণে হয়নি। আমরা সকলেই জানি, আকবর এবং রাণা প্রতাপের সেনাবাহিনীতে হিন্দু-মুসলিম উভয়েই ছিলেন। না তো আকবর মুসলিমদের রক্ষক ছিলেন, আর রাণা প্রতাপও হিন্দুত্বের পতাকাবাহক ছিলেন না। দু’জনেই নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন।
বিষয়টা এমন, তাজমহল এবং মুসলিম রাজাদের তৈরি অন্য নিদর্শন সাম্প্রদায়িক শক্তির চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতদিন অবধি, তাজমহলকে শিবমন্দির বলার প্রচেষ্টা চলছিল। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির লোকেরাই ক্ষমতায় রয়েছেন। ছলে-বলে তাজমহলকে ভারতীয় ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাজমহল যাতে কোনোভাবেই জায়গা না পায়, তার প্রচেষ্টা চলছে। ঠিক যেভাবে উত্তর প্রদেশের হিন্দুত্ববাদী সরকার তাজমহলকে তাদের প্রকাশিত পর্যটন পুস্তিকা থেকে উধাও করে দিয়েছেন, একইভাবে হয়তো মুসলিমদেরও সমাজ থেকে মুছে ফেলতে চাইছে। আচ্ছা, তাদের পরবর্তী লক্ষ্য লাল কেল্লা হবে না তো! যেখান থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসে ভাষণ দেন?
তাজমহল এবং এরকম অন্যান্য ঐতিহাসিক এবং পৌরতাত্ত্বিক নিদর্শন, সৌধ, স্তূপ ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভারতের বাকি সংস্কৃতির মতোই এগুলিরও সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। যাতে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতির প্রসার করা যায়।