পার্থ ঘনিষ্ঠের বাড়িতে টাকার পাহাড়
-
নিজস্ব প্রতিনিধি
- Jul 23, 2022 13:02 [IST]
- Last Update: Jul 23, 2022 13:02 [IST]
নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি হানা
=====================================
শিল্পমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহিলার বাড়িতে নগদেই অন্তত ২০ কোটি টাকা
কলকাতায় ১৮ বাড়ির নথি উদ্ধার
পিংলায় মন্ত্রীর আত্মীয়দের বাড়ি থেকে মিলল সোনা
গভীর রাত পর্যন্ত জেরা পার্থকে
তল্লাশি পরেশ অধিকারীর বাড়িতেও
১৩ জায়গায় হানা দিয়ে দুর্নীতির প্রমাণ হাতেনাতে
================================
কলকাতা, ২২ জুলাই— টাকার পাহাড়। দু’হাজার, পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল। চক্ষু চড়কগাছ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী আধিকারিকদেরও। অবস্থা এমনই যে টাকা গোনার মেশিন আনতে হয় ইডি’র আধিকারিকদের।
দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুর থানা এলাকার অভিজাত আবাসনের এই ফ্ল্যাটের মালিক অর্পিতা মুখার্জি। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বলেই তাঁকে চেনেন সকলে। শাসক তৃণমূলের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রীরাও তাঁকে চেনেন। একাধিক অনুষ্ঠানে পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গে তাঁকে দেখা গেছে। দু’টি ওডিয়া সিনেমাতে অভিনয় করেছেন এই অর্পিতা মুখার্জি।
সেই অর্পিতা মুখার্জির ফ্ল্যাট থেকেই উদ্ধার হওয়া টাকার পাহাড় রাত পর্যন্ত গোনার পরে দেখা যায় পরিমাণ ২০কোটির বেশি। নগদে ২০ কোটির বেশি টাকা রয়েছে কেবল ঘরেই। এদিনই রাতে নিউ বারাকপুরের জাগৃতি সঙ্ঘের কাছে তাঁর আরেকটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে ডলার, সোনাও।
এখানেই শেষ নয়। বেহালা, রাজারহাট, যাদবপুর সহ একাধিক জায়গায় ১৮টি বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমির নথিপত্রও বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি। প্রতিটির মালিকানা অর্পিতা মুখার্জির নামে। পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পর্বেই এই সম্পত্তি বেড়েছে তাঁর। তাঁকে এদিনই আটকও করেছে ইডি।
রাজ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত বেনজির দুর্নীতির তদন্তে শুক্রবার ভোর থেকে তল্লাশি অভিযান শুরু হয় ইডি’র। সেই তল্লাশি অভিযানেই সকাল আটটা থেকে দফায় দফায় প্রায় চোদ্দ ঘণ্টা লাগাতার জেরা চলেছে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির। বিকালের দিকে নাকতলায় বাড়িতে পার্থ চ্যাটার্জির জেরা থেকে মেলা সূত্র ধরেই তদন্তকারী আধিকারিকরা দ্রুত যান হরিদেবপুর থানা এলাকার সেই অভিজাত আবাসনে। সেখানে তল্লাশিতে সামনে আসে নগদ টাকার পাহাড়ের ছবি। তাজ্জব ইডি’র আধিকারিকরাও। পার্থ চ্যাটার্জির বাড়ি রাতেই ঘিরে ফেলেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। চারদিক দিয়েই অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে কাউকে ঢুকতে-বেরোতে দেওয়া হয়নি।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে আদালতে, তদন্তকারী সংস্থার জেরায়। এবার সেই দুর্নীতির পিছনে কোটি কোটি নগদ টাকার পাচারের তদন্তে প্রথম দিনের তল্লাশিতেই ইডি’র হাতে এল এই বিপুল পরিমাণ টাকার হদিশ। সূত্রের খবর, এটিও হিমশৈলের চূড়ামাত্র। অবৈধ নিয়োগ থেকে তোলা টাকার সামান্য একটা অংশই শেষমেষ পড়ে ছিল। সেই সামান্য অংশের পরিমাণই ২০ কোটি। মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখার্জির বাড়ি থেকে ২০টি মোবাইল ফোনও উদ্ধার হয়েছে। পাওয়া গিয়েছে সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রাও। সোনার পরিমাণও বিপুল, মূলত অলঙ্কার।
একই সঙ্গে এদিন পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলাতেও পার্থ চ্যাটার্জির স্ত্রীর নামে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বিপুল বিনিয়োগের তদন্ত চালাতে গিয়ে তাঁর জামাইয়ের দুই আত্মীয়ের বিপুল সম্পত্তির হদিশ মিলেছে। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা উদ্ধার করেছে আয়কর দপ্তর, জানা গেছে একটি সূত্রে।
শুক্রবার সকাল থেকে রাজ্যের দুই মন্ত্রীর বাড়ি সহ একযোগে ১৩টি জায়গায় ম্যারাথন তল্লাশি অভিযান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র। সাম্প্রতিক কালে এরাজ্যে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের এত বড় ও দীর্ঘ তল্লাশি অভিযান দেখা যায়নি। টানা চোদ্দ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে জেরার মুখে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও বর্তমানে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এদিকে, শুক্রবার সকাল থেকেই এই বড় আকারের তল্লাশি অভিযান আবার চেনা চিত্রনাট্য মেপে তরজাও শুরু হয়েছে তৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যে।
স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে নিয়োগ নিয়ে সবথেকে বড় কেলেঙ্কারি। প্রাইমারি টেট থেকে এসএসসি, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে বেনজির দুর্নীতি। কোটি কোটি টাকার খেলা। অবৈধভাবে অকৃতকার্য এমনকি খালি খাতা জমা দেওয়া পরীক্ষার্থীরাও চাকরি পেয়েছে স্রেফ এই দুর্নীতি চক্রের মদতে। আদালতের নির্দেশে একাধিকজন চাকরি হারিয়েছেন এই দুর্নীতির জেরেই।
শুক্রবারের ম্যারাথন তল্লাশি মূলত নিয়োগ দুর্নীতি বিপুল টাকার যে চক্র চলেছে তার উৎস ও গন্তব্যের খোঁজে। নিয়োগ দুর্নীতিতে এবার মানি-লন্ডারিং বা টাকা নয়ছয়ের তদন্তে তল্লাশির মুখে দুই মন্ত্রী—এও এক বেনজির ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে।
এদিন ভোর পাঁচটাতেই প্রায় ৫০জনের বেশি ইডি আধিকারিক একাধিক দলে ভাগ হয়ে তল্লাশি অভিযান শুরু করেন। সকাল আটটায় একটি দল পৌঁছায় দক্ষিণ কলকাতার নাকতলায় পার্থ চ্যাটার্জির বাড়িতে। তার আগে ভোর ছ’টায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলির ফুলবাগানের বিলাসবহুল বাড়িতে হানা দেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র আধিকারিকরা। একই সময়ে আবার কোচবিহারে মেখলিগঞ্জে শিক্ষা দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর বাড়িতেও চলে তল্লাশি অভিযান। যদিও এদিন তিনি কলকাতায় ছিলেন। পার্থ চ্যাটার্জির তৈরি করা নিয়োগ নজরদারি কমিটির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিন্হার বাড়ি, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অপসারিত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য, এসএসসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও নিয়োগ কমিটির প্রাক্তন সদস্য সৌমিত্র সরকারের বাড়িতেও একযোগে চলে তল্লাশি অভিযান। এছাড়া, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখার্জির বাড়িতে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জামাই কল্যাণময় ভট্টাচার্য, তাঁর মামা কৃষ্ণচন্দ্র অধিকারী, স্কুল নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে জড়িত চন্দন মণ্ডল ওরফে ‘রঞ্জন’-র বাগদার বাড়িতে অভিযান চলে। শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে বেশ কয়েকজন আধিকারিকের বাড়ি সহ মোট ১৩টি জায়গায় এদিনের তল্লাশি চলে।
সকাল আটটা থেকে দফায় দফায় ১৪ ঘণ্টার বেশি জেরা চলেছে পার্থ চ্যাটার্জির। এদিন সকালেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সঙ্গে নিয়েই যায় তদন্তকারী দল নাকতলায়, তাঁর বাড়িতে। পার্থ চ্যাটার্জির বাড়িতে মোতায়েন থাকা তাঁর রাজ্য সরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের মোবাইল নিয়ে নেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যদেরও এক জায়গায় বাসিয়ে তাঁদের মোবাইল নিয়ে নেওয়া হয়। তারপরেই শুরু হয় ম্যারাথন জেরা। দুপুরের দিকে পার্থ চ্যটার্জি জেরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে দাবি তাঁর আইনজীবীদের। এরপর তিনজন সরকারি চিকিৎসক আসেন। যদিও কিছু পরেই তাঁরা আবার বেরিয়ে যান। ফের শুরু হয় জেরা।
এর আগে গত ১৮ মে সাড়ে ৩ঘণ্টা সিবিআই’র জেরার মুখোমুখি হন পার্থ চ্যাটার্জি। নিয়োগ কমিটির পাঁচজন সদস্যকে মুখোমুখি বসিয়ে পার্থ চ্যাটার্জিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিবিআই আধিকারিকরা। মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিকে তাঁর সমস্ত পদ থেকে অব্যাহতি দেবার জন্য ইতিমধ্যে আদালতও রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছে। ফের আরেক দফাও জেরা হয়। যদিও মুখ্যমন্ত্রী কার্যত পাশেই দাঁড়িয়েছেন।
এসএসসি’র গ্রুপ-সি পদে বেলাগাম দুর্নীতি, নিয়োগ পিছু বড় অঙ্কের টাকা খেলা হয়েছিল। তদন্তের সেই টাকার গন্তব্যস্থল জানতে চাইছেন গোয়েন্দা আধিকারিকরা। আর গন্তব্যস্থলের খোঁজেই যেন সামনে আসছে এই বিপুল সম্পত্তির চেহারা। তদন্তের স্বাভাবিক গতিতেই যদি আয়করের নথির সঙ্গে ইতিমধ্যে নেতা, মন্ত্রীদের জমা দেওয়া তথ্যের অসঙ্গতি দেখা যায় তবে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলা রুজুর পথেই হাঁটবে সিবিআই। অস্বস্তি তাই আরও দ্বিগুণ হচ্ছে শাসক শিবিরে। পরেশ অধিকারীর মেয়ের নাম যেভাবে মেধা তালিকায় এক নম্বরে নিয়ে আসা হয় সেই দুর্নীতির জেরার পরে মন্ত্রীর আয়কর সংক্রান্ত নথিও আয়কর দপ্তরের কাছ থেকে হাতে পেয়েছে ইডি, সিবিআই।
কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে এদিন ভোর ছটা থেকে শুরু হয় মন্ত্রী পরেশ অধিকারির বাড়িতে এই তল্লাশি অভিযান। জানা গেছে ইডি’র আধিকারিকরা শিলিগুড়িতে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। এদিন ভোর রাতেই তারা মেখলিগঞ্জে পৌঁছে যান। তল্লাশি চলাকালীন খবর পেয়ে পুলিশ এলেও কেন্দ্রীয় বাহিনী তাঁদের বাড়িতে ঢোকার অনুমতি দেয়নি। মন্ত্রী ও মন্ত্রীপুত্র বাড়িতে না থাকায় কন্যা অঙ্কিতা অধিকারী ও মন্ত্রীর স্ত্রীকে টানা ৯ ঘণ্টা জেরা চলে। মূলত বিপুল সম্পত্তির উৎস, পরিমাণ জানতেই জেরা, তল্লাশি বলে জানা গেছে।
গত ২০ জুন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি, তৃণমূলের বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করে হাইকোর্ট। ১৩জুন আদালত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির কারণে ২৬৯জন শিক্ষককে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশের পরই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রাথমিক স্কুলগুলিতে বেআইনি নিয়োগের ছবি ধরা পড়েছে। বহু স্কুল থেকে দুর্নীতি নিয়োগের দায়ে চাকরি ছাড়তে হয়েছে শিক্ষকদের। টেট নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের সম্পত্তির হিসাবও চায় হাইকোর্ট। মানিক ভট্টাচার্যের বাড়িতেও সকাল থেকেই চলে দফায় দফায় তল্লাশি।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে এসএসসি’র নিয়োগ দুর্নীতিতে অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলিকে। গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি, নবম-দশম শ্রেণির নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে সিবিআই’র প্রাথমিক তদন্তেও পর্ষদ সভাপতির নাম এসেছে। গ্রুপ-সি নিয়োগ দুর্নীতিতে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশও করেছে বাগ কমিটি। গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাঁর আইন বিরুদ্ধে সন্দেহজনক ভূমিকা, অসঙ্গতি মিলেছে। এর আগে সিবিআই কল্যাণময় গাঙ্গুলির বাড়িতে তল্লাশি চালায়, তাঁকে নিজাম প্যালেসেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয় জেরার জন্য। এদিনও দশ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে তল্লাশি।
পার্থ চ্যাটার্জির তৈরি করা নিয়োগ নজরদারি কমিটির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা। সম্পূর্ণ লকডাউনের পথে যখন গোটা সেই সময় এসএসসি’র নতুন ভবনে ডেকে এনে অবৈধ নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে, মূলত যারা চাকারি আশায় আগেই দালাল অথবা তৃণমূল নেতা, মন্ত্রীদের টাকা দিয়ে রেখেছে। হলফনামাতেও কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই হাজার হাজার নিয়োগের কথা জানানো হয়নি, নিয়োগপত্র শান্তিপ্রসাদ সিনহার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি তা বিলি করেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে দফায় দফায় তাঁর বাড়িতেও তল্লাশি, জেরা।