অনির্বাণ দে: সাগরদিঘি
পঞ্চায়েত নির্বাচন করানোয় কীসের ভয় মুখ্যমন্ত্রীর ? ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে সাগরদিঘির উপনির্বাচনের ফলাফলেও। এই বিধানসভার অন্তর্গত ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০টিতেই বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন তৃণমূল প্রার্থীর থেকে, আরেকটিতে তৃণমূল প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর প্রাপ্ত ভোট সমান সমান।
এমনকি, এই উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী দেবাশিস ব্যানার্জির বাড়ি যে বাড়ালা গ্রাম পঞ্চায়েতে সেখানেও তিনি হেরেছেন। এই পঞ্চায়েতে ৬৫৩৯টি ভোট পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী, বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস পেয়েছেন ৭৬৫২টি ভোট। ১১১৩ ভোটের ব্যবধানে এই পঞ্চায়েতে এগিয়ে থেকেছেন বাইরন বিশ্বাস। এভাবেই জবাব দিয়েছেন গোটা সমগ্র সাগরদিঘির মানুষ। গ্রামে কাজ নেই, চরম দুর্দশায় দিন কাটাতে কাটাতে তৃণমূলের লুট দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারলে সারা রাজ্যেই পঞ্চায়েতে কী ঘটাতে পারে সেই আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল শিবিরে।
২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল অবধি সাগরদিঘি থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে জিতেছেন সুব্রত সাহা। ভোটে জিতে একাধিকবার মন্ত্রীও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এলাকার কোনও উন্নয়ন হয়নি, মানুষের দুর্দশা বেড়েই চলেছে। সেই সাগরদিঘিতেই ২২,৯৮০ ভোটের ব্যবধানে তৃণমূল প্রার্থী দেবাশিস ব্যানার্জিকে হারিয়েছেন বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। বিজেপি প্রার্থীর জামানতই জব্দ হয়ে গেছে।
স্থানীয় অনুন্নয়ন আর জীবনজীবিকার সঙ্কটের পাশাপাশি চোখের সামনে দেখা শাসকদলের লুট যে মানুষের রোষ তৈরি করেছে তার প্রমাণ ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট। তৃণমূলের মুখ পুড়েছে তৃণমূল প্রার্থী দেবাশিস ব্যানার্জির নিজের গ্রাম পঞ্চায়েত বাড়ালাতেও। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা বাড়ালা জুড়েই। বৃষ্টি হলে চলাফেরা আরও মুশকিল হয়ে পড়ে। চন্দনবাটি মোড় থেকে চোরদিঘির রাস্তাই হোক আর দিয়াড় থেকে গোপালদিঘির রাস্তা, সংস্কার হয়নি গত ১১ বছরে। এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা। বছরের পর বছর এসব নিয়ে সরব হয়েও কোনও সদুত্তর পাননি গ্রামের মানুষ। শুধুই চলেছে লুট।
২০১৮ সালের পর থেকে দুর্নীতির দাপটে অতিষ্ঠ বাড়ালার মানুষ। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাড়ালার ১৮টি আসনের মধ্যে ১৭টি আসনই দখল করে তৃণমূল। প্রধান হন তৃণমূলের নেবুল চন্দ্র মার্জিত। তবে গ্রামবাসীদের অভিজ্ঞতা, নিজের হাতে পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রণ করেন সাগরদিঘি ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি দেবাশিস ব্যানার্জিই। পঞ্চায়েতে ঢুকে সরকারি আধিকারিক থেকে কর্মচারীদের ধমক দেওয়ার মতো কাণ্ডও ঘটিয়েছেন তিনি। এই পঞ্চায়েতে একশো দিনের কাজের মজুরি বাবদ এক কোটি বারো লক্ষ টাকা বকেয়া রয়েছে গ্রামের মানুষের। সেসব নিয়ে কোনও কথা শোনা যায়নি তৃণমূল নেতাদের মুখে। পঞ্চায়েতের দুর্নীতি নিয়ে বহুবার সরব হয়েছেন সিপিআই(এম)’র প্রতীকে নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য আসবিরা খাতুন। তাতে তাঁর কপালে জুটেছে হুমকি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ভয় না পেয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার ভোটের ফল বেরোতে দেখা যায়, ২৩টি বুথের মধ্যে ১৪টি বুথে লিড পেয়েছেন বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। ৮টি বুথে লিড পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী দেবাশিস ব্যানার্জি। ১টি বুথে বিজেপি প্রার্থী দিলীপ সাহা। এলাকার সিপিআই(এম) নেতা রজব আলি মল্লিকের কথায়, একদিকে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি অন্যদিকে বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দুইয়ের বিরুদ্ধেই বাড়ি বাড়ি প্রচার চালানো হয়েছিল। হুমকির মুখেও সরে আসেননি সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসের কর্মীরা।
কাবিলপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটের হিসাবে দেখা যাচ্ছে ৪৩৫৬ ভোট পেয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী, বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ৯৯৪০ ভোট। ৫৫৮৪ ভোটে এই পঞ্চায়েতে লিড পেয়েছেন বাইরন বিশ্বাস। অথচ সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে এই কাবিলপুরে পঞ্চায়েত দখল করেছিল তৃণমূল। ১৮ আসনের পঞ্চায়েতে তৃণমূলের মাত্র ৮ প্রার্থী জিতেছিলেন। এই পঞ্চায়েত ৫ জন সিপিআই(এম) সদস্য, ৪ জন কংগ্রেসের সদস্য এবং ১ জন এসডিপিআই’র সদস্য থাকা সত্ত্বেও গুন্ডাবাহিনী ব্যবহার করে পঞ্চায়েতে প্রধান হয়েছেন তৃণমূলের লাইলি বিবি। লাইলি বিবি তৃণমূলের টিকিটে জিতলেও এই পঞ্চায়েত চালান প্রধানের স্বামী তৃণমূল নেতা জের মহম্মদ, সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতির চেয়ারম্যান রেবাজুল ইসলাম। লুট আর দুর্নীতির একের পর এক উদাহরণ দেখেছেন কাবিলপুরের মানুষ। আবাস লিস্টে নাম উঠেছে তৃণমূল নেতাদের আত্মীয়দের।
মানুষের ক্ষোভ বুঝে এই এলাকায় ভোট করাতে এসেছিলেন বিদ্যুৎ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী আখরুজ্জামান, কলকাতা থেকে আসেন জাভেদ খান। তাঁদের নেতৃত্বে চলেছে বুথে বুথে হুমকি। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় জোট বেঁধে তৃণমূলের পঞ্চায়েতের দুর্নীতি এবং বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা রবিফুক ইসলাম থেকে সিপিআই(এম) নেতা ইবনে আবেদন, সদরুল আলিরা।
এই বছর ভোট দিতে আসতে পারেননি কাবিলপুরের প্রায় চার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। রাজ্যে কাজ না থাকায় কেউ পাড়ি দিয়েছেন সৌদি আরবে কেউ গুজরাটে। এলাকার বহু শ্রমিক পড়ে রয়েছেন তামিলনাড়ু, ওডিশা, কেরালায়। কর্মহীনতার এই সঙ্কটের প্রকাশ ঘটাতে পেরেছেন তাঁদের পরিবারের মহিলারাই। ঢালাও সমর্থন করেছেন বাইরন বিশ্বাসকে। দল বেঁধে প্রতীকসহ নকল ইভিএম’র নিয়ে বাড়ি বাড়ি প্রচার করেছেন সাকিলা বেগম, তুহিনা খাতুন, রোসনারা বিবি, কমলা রবিদাসরা। তাঁরাই জানাচ্ছেন, ভয় দেখাচ্ছিল তৃণমূল। মহিলা বলে ছিল বাড়তি শাসানিও, তবে সেসবে কান দেননি তারা। পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরে ভোট দিতে এলে তৃণমূলের জন্য আরও দুঃখ অপেক্ষা করছে। নির্বাচনের দু’দিন আগে গ্রামে গাড়ি নিয়ে ঘুরেছে তৃণমূল নেতারা। উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করেছে।
কিন্তু পাড়া আগলে ভোটাধিকার রক্ষা করেছেন গ্রামবাসীরা। কাবিলপুরের বাসিন্দা সিপিআই(এম) নেতা ইসমাইল শেখ জানান, এই জয়ে দুর্নীতির পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে লড়াই আরও শক্তিশালী হবে।
সাগরদিঘির ভোট ছিল তৃণমূলের ‘প্রেস্টিজ ফাইট’। তাই বিড়ি শ্রমিকদের কথাও শোনা গিয়েছিল তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জির মুখে। ১৭৮ টাকাও মজুরি পাননি বিড়ি শ্রমিকরা। কাজ কমাচ্ছেন বিড়ি মালিক, তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমান থেকে বিড়ি মালিক তৃণমূল বিধায়ক জাকির হোসেন, ইমানি বিশ্বাসরা। সাগরদিঘিতে বিড়ির মজুরি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি।
সাগরদিঘির সিপিআই(এম) নেতা মুর্শিদাবাদ বিড়ি মজদুর অ্যান্ড প্যাকার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জ্যোতিরূপ ব্যানার্জি বলেন, বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি থেকে পিএফ নিয়ে আন্দোলন করেছে বামপন্থীরাই। অভিজ্ঞতা থেকেই অভিষেক ব্যানার্জির মিথ্যায় কান দেননি সাগরদিঘির মানুষ।
সাগরদিঘিতে একসঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপি’কে পরাস্ত করার সাফল্যে মুর্শিদাবাদ জেলাজুড়ে নতুন আশা আর স্বস্তির হিল্লোল বইছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় এদিন বিজয় মিছিল হয়েছে। সাগরদিঘি লাগোয়া নবগ্রাম, পলসন্ডায় মিছিল হয়েছে। পলসন্ডায় মিছিলে ছিলেন কংগ্রেস নেতা মীর বাদাম আলি, ধীরেন্দ্রনাথ যাদব, সিপিআই(এম) নেতা মুকুল মণ্ডল, রজব আলি মল্লিক, পল্টন হাঁসদা, অমল মুখার্জি। নবগ্রামে মিছিলে ছিলেন স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতৃত্ব।
অন্যদিকে সাগরদিঘিতে হারে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ইঙ্গিত পেয়ে দিশাহারা তৃণমূল শিবির। শুক্রবার জঙ্গিপুরে তৃণমূল কংগ্রেস জেলা সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, ‘যে কোনও ভোটেই জয় পরাজয় থাকে, বুথ ভিত্তিক পর্যালোচনা করা হবে।’
Comments :0