Modi government

হিন্দুত্ববাদীদের সন্ত্রাসবাদের দায় মুছতে তৎপর মোদী সরকারই

জাতীয়

‘‘এমনটা যে হবে জানাই ছিল। যদি প্রকৃত প্রমাণ না দেওয়া হয়, তাহলে কী রায় আশা করা যায়? আদালতে চূড়ান্ত প্রমাণ আইনজীবী হিসাবে আমি উপস্থিত করিনি। আমাকে ২০১৭ সালে এই মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার আগে আমি অজস্র প্রমাণ উপস্থিত করেছিলাম এবং সুপ্রিম কোর্ট সেগুলি গ্রহণ করেছিল। সেই প্রমাণগুলি কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল?’’ প্রশ্ন তুলেছেন রোহিনী সালিয়ান। মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় দীর্ঘ সময়ে সরকারি আইনজীবী ছিলেন রোহিনী। ৭৮ বছর বয়সি মুম্বাইয়ের এই দুঁদে আইনজীবী তাঁর কর্মজীবনে সন্ত্রাসবাদ এবং অপরাধের অনেক গুরুতর মামলা লড়েছেন। বৃহস্পতিবার মালেগাঁও মামলার রায় আসার পরে রোহিনী সালিয়ানের বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়েছে কীভাবে ‘হিন্দুত্ববাদী’ সন্ত্রাসবাদীদের মুক্ত করেছে মোদী সরকার। 
মালেগাঁওয়ের এই বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে মুম্বাই এটিএসের তৎকালীন প্রধান হেমন্ত কারকারেই প্রথম সন্ত্রাসবাদী নাশকতার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের যোগসাজশ সামনে আনেন। এর সূত্র ধরেই অন্যান্য বিস্ফোরণকাণ্ডে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং ব্যক্তিদের ভূমিকা প্রকাশ্যে আসে, গ্রেপ্তারি হয়। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে কাসভ বাহিনীর সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় রহস্যজনকভাবে নিহত হন এটিএস প্রধান হেমন্ত কারকারে। ওইরকম একটি অভিযানে কারকারে বুলেট প্রুফ জ্যাকেটটিও পরে যাননি বলে জানা যায়। যা খুবই বিস্ময়কর ছিল। তাঁর মৃত্যুর ঘটনাই এক বিরাট রহস্য। এরপরে ‘মানসিক বিপর্যস্ত’ তাঁর স্ত্রী কবিতা কারকারেরও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। অনেকেই এই সবের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদের যোগসাজশ আছে বলে মনে করেন। 
এদিন মালেগাঁওয়ের রায় আসার পরে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশ বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ কখনও গেরুয়া ছিল না, নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তার সুরেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং বিজেপি নেতারা তাদের পুরানো অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী বলেছেন, কংগ্রেস সহ বিরোধীরা হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদ শব্দ আমদানি করেছিল। তাদের আজ ক্ষমা চাইতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, হিন্দুত্ববাদীরা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে যুক্ত এটা সামনে এনেছিলেন মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসবাদ দমন শাখার প্রধান হেমন্ত কারকারে। কোনও রাজনৈতিক দল বা সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা নন। এবং সেই অফিসার আবার সন্ত্রাসবাদী হামলাতেই নিহত হয়েছিলেন। কংগ্রেস এদিন পালটা বলেছে, বিজেপি ‘শহীদ’ কারকারেকে অসম্মান করছে। মহারাষ্ট্র কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তাহলে মালেগাঁওয়ে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছিল কে বা কারা? সেখানে যে অতগুলি মানুষ হতাহত হয়েছিল, সেটার জন্য দায়ী কারা? 
কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার এক বছরের মাথায় অভিযোগ ওঠে মালেগাঁওয়ের দুটি বিস্ফোরণ, সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ, আজমের শরিফ, হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণ ইত্যাদি ঘটনায় হিন্দুত্ববাদীদের যুক্ত থাকার অভিযোগ লঘু করে দিতে চাইছে সরকার। বিভিন্ন মামলা থেকে অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদীদের সরিয়ে দিতে চাইছে তারা। সেই জন্য এনআইএ সহ তদন্তকারী সংস্থাগুলি আগের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে বিপরীত অবস্থান নিচ্ছে। ২০১৫ সালের ২৫ জুন মালেগাঁও বিস্ফোরণের এই মামলার সরকারি আইনজীবী রোহিনী সালিয়ান সরাসরি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রে মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পরই, এনআইএ’র এক অফিসার তাঁকে ফোন করে দেখা করতে চান। ওই অফিসার বলেন, মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত হিন্দু নেতাদের বিষয়ে তিনি যেন ‘নরম মনোভাব’ দেখান। এমনটাই ‘ওপর মহলের নির্দেশ’। ওই অফিসার এও বলেন, মহারাষ্ট্র সরকার হিন্দু নেতাদের এই মামলায় অভিযুক্ত হিসাবে পেশ করুক, এটা ‘ওপর মহল’-এর কর্তারা চান না। বলা হয়, সরকারি আইনজীবী পালটাতেও চান তাঁরা। ২০১৪ সালের মে মাসের শেষে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদী। এক বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ২৫ জুন রোহিনী সালিয়ান এই অভিযোগ করেন। অর্থাৎ সরকারে এসেই অতি তৎপরতায় এই ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করতে থাকে মোদী সরকার। যেমন, ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যা বা ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার ঘটনাগুলি থেকে মোদী, শাহ সহ মোদী ঘনিষ্ঠ গুজরাটের সমস্ত অভিযুক্ত আধিকারিকরাও অব্যাহতি পেয়ে গেছেন। 
সালিয়ানের অভিযোগ সত্য প্রমাণ করে এক বছরের মাথায় এনআইএ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, কর্নেল পি এস পুরোহিতের মতো ছ’জন উগ্র হিন্দুত্ববাদীর বিরুদ্ধে মালেগাঁও বিস্ফোরণে যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া এত বড় পদক্ষেপ এনআইএ নিতে পারে না, তা স্পষ্ট। তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মালেগাঁওয়ের এই মামলায় রোহিনী সালিয়ানাকে সরকারি আইনজীবীর পদ থেকে সরিয়ে দেয় মোদী সরকার। শুধু মালেগাঁও নয়, অন্যান্য মামলাগুলি থেকেও একের পর এক হিন্দুত্ববাদীরা ছাড়া পেতে থাকে এনআইএ সহ তদন্তকারী সংস্থাগুলির অবস্থানের জন্য। যেমন, একদা আরএসএসের প্রচারক স্বামী অসীমানন্দ ওরফে নবকুমার সরকারকে সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে এনআইএ। আজমের শরিফ এবং হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের ঘটনা থেকেও অসীমানন্দ সহ অন্য হিন্দুত্ববাদীদের মুক্তি মিলেছে মোদী সরকারের আমলেই। প্রশ্ন উঠেছিল, অভিনব ভারত বা আরও নানা নামের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন নয়, অসীমানন্দের গ্রেপ্তারিতে সরাসরি আরএসএস জড়িয়ে পড়ছিল সন্ত্রাসবাদী নাশকতার ঘটনায়। তাই কি এই তৎপরতা? এর মধ্যে মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণ মামলায় অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদীদের মুক্তির নির্দেশ দেওয়ার পরেই ইস্তফা দেন বিশেষ এনআইএ আদালতের বিচারপতি রবীন্দ্র রেড্ডি। তার উপরে কি এইরকম রায় দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছিল, সেই প্রশ্নও ওঠে। এদিন মালেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তি, এই ধারাবাহিকতার নবতম সংযোজন। 
রোহিনী সালিয়ান এদিন বলেছেন, ‘‘অনেকদিন ধরেই এমনটা হবে আমি আশা করেছিলাম। প্রথমে যা প্রমাণ দেওয়া হয়েছিল তা বাদ দিয়ে যদি অন্য প্রমাণ দেওয়া হয় আদালতে, তাহলে যা কিছুই হতে পারে। এনআইএ-র মতে, আগের প্রমাণগুলি ভুয়ো। তাই তারা নতুন করে তদন্ত করেছে। নতুন করে সাক্ষীদের বয়ান নথিভুক্ত করেছে। আগে অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড (এটিএস) যে ১৬৪ টি রেকর্ড করেছিল, নতুন বয়ান তার থেকে ভিন্ন। নতুন যে প্রমাণ আদালতে দেওয়া হয়েছে, রায়ও তার ভিত্তিতেই হয়েছে।’’ তিনি বলেন, এই রায়ে আমি হতাশ নই, কারণ এটা আমার কাছে রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা খুব কঠোর পরিশ্রম করি, কিন্তু কেউ চায় না যে সত্য বেরিয়ে আসুক। তাই এটা শেষ পর্যন্ত জনগণের ব্যর্থতা। কারণ আমরাই এই সরকারকে নির্বাচিত করেছি এবং তারা যেভাবে প্রয়োজন সেভাবেই শাসন করবে। আপনি সরকারকে দোষ দিতে পারেন না, দোষ নিজেদেরকেই দিতে হবে, বলেছেন রোহিনী।  

Comments :0

Login to leave a comment