Tmc awas yojana scam

গ্রামে তিন বাড়ি, মুম্বাইয়ে দুটি ফ্ল্যাটের মালিকও তালিকায়

রাজ্য

দুর্নীতির নব নব কৌশলেই যেন টিকে আছে শাসক তৃণমূল। এলাকা ভিত্তিক বদলায় সেই কৌশল।
যেমন চন্দ্রকোনা-২নম্বর ব্লকের বসনছোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত। তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য অভিজিৎ রায়ের বাড়ি। সামনে রয়েছে গোয়ালঘর আর খামারঘর। বাড়ির সামনে গোয়ালঘর দেখিয়েই নিজের স্ত্রী, ছেলে সহ গোটা পরিবারের নাম আবাস যোজনায় নথিবদ্ধ করেছিলেন।
সমীক্ষার কাজ করতে গিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদর চোখে তা ধরা পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। আর এরপরেই তৃণমূলী বাহিনীর হুমকির মুখে পড়েন চার আইসিডিএস কর্মী। এমনকি খুনের হুমকিও শুনতে হয়। গোটা ঘটনায় আতঙ্কিত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা ব্লক অফিসে গিয়ে রীতিমতো কেঁদে ফেলেন। এই সমীক্ষার কাজ থেকে তাঁদের বাদ দেওয়ার আরজি জানান। কান্নাভেজা গলায় তাঁদের আকুতি, সমীক্ষার কাজে কোনও দুর্নীতির ছবি দেখতে চোখ বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে, প্রশ্ন করলেই খুনের হুমকি। এই সমীক্ষার জন্য তো আমার পরিবার শেষ করে দিতে পারি না, আমাদের রেহাই দিন। গ্রামছাড়া হতে হবে না-হলে।
শেষমেষ পরিস্থিতি বুঝে এবার বসনছোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার যাদবনগর বুথে গোটা ঘটনার তদন্ত করতে যান খোদ যুগ্ম ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক। সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে তাঁরও চোখ কপালে। যুগ্ম বিডিও সেই গ্রামে সরেজমিনে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন, শুধু গোয়াল ঘরের আড়ালে দোতলা ঝাঁ চকচকে পাকা বাড়ি নয়, তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য অভিজিৎ রায় নিজের স্ত্রী দীপালি রায়কে পরিবার থেকে আলাদা থাকেন দেখিয়ে আবাস যোজনা তালিকায় নাম ঢুকিয়েছেন। নিজের নাম ছাড়াও আলাদা করে নিজের স্ত্রী সহ দুই পুত্রের নামও নথিবদ্ধ করেছে। 
এমন ঘটনা ব্যতিক্রমী নয়, গোটা রাজ্যের একাধিক জেলার মতো পশ্চিম মেদিনীপুরের স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। একদিকে সীমাহীন নির্লজ্জ দুর্নীতির ছবি অন্যদিকে সমীক্ষা চালাতে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলী বাহিনীর হুমকির মুখে পড়া অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, সহায়িকা, আশা কর্মীরা। রীতিমতো আতঙ্কের ছবি জেলায় জেলায়।
সমীক্ষা করার জন্য আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের তালিকা দেওয়া হচ্ছে। তাতে কিন্তু বুথের মোট নথিভুক্ত নামের হিসাব নেই। যেটুকু তালিকা প্রকাশ্যে আসছে তাতেই দেখা যাচ্ছে উপভোক্তার তালিকায় থাকা ৬০-৭০ শতাংশই বিত্তবান নয়তো সরকারি কর্মচারী অবসর নিয়েছেন এবং এক থেকে দোতলা পাকা বাড়ি রয়েছে এমন ব্যক্তিদের নামই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে শাসক তৃণমূলের অনুগতরাই তালিকা জুড়ে। তাতে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য থেকে দলীয় নেতা সবাই রয়েছেন। 
ডেবরা ব্লকের গোলগ্রাম গ্রামপঞ্চায়েত এলাকার পারুলডিহি বুথ। এই বুথে ৪২ জনের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে। ৪২ জনের মধ্যে তৃণমূলের দয়া দাক্ষিণ্যে মাত্র তিনজন গরিব মানুষ কোনমতে ঠাঁই পেয়েছেন। এই গোলগ্রাম পঞ্চায়েতের পারুলডিহি বুথের বাসিন্দা শেখ বক্কর আলি। তৃণমূলী মাতব্বর। তৃণমূলের বুথ কমিটির সদস্য। বিপুল টাকার মালিক ফলে দাপটও বেশি তৃণমূলে। পারুলডিহি গ্রামে তিনটি পাকা বাড়ি আছে। তাঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মুম্বাইতে থাকে। সেখানে দুটি ফ্ল্যাট। এহেন তৃণমূলী মাতব্বর শেখ বক্কর আলি নাম আবাস যোজনার তালিকায়!
এলাকার মানুষ তাজ্জব। তৃণমূলের সুপারিশে যাঁরা তালিকাভুক্ত হয়েছেন সেই তালিকা এবার তথ্যের অধিকার আইনে সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতা স্বপন শূর। তিনি সেই তালিকা এরপর জেরক্স করে গ্রামে টাঙিয়ে দিয়েছেন। সেই তালিকা দেখে রীতিমতো ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষজন। সিপিআই(এম)’র আবেদন, এই বেনজির দুর্নীতির প্রতিবাদে শামিল হন। আশ্চর্যের হলো, একটি বুথে এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সেই গ্রামে সমীক্ষা করতে লোক পাঠায়নি প্রশাসন। 
পারুলডিহি বুথের তৃণমূলের বুথ সভাপতি দিব্যেন্দু বিকাশ সামন্ত ও তাঁর দাদা শীর্যেন্দু বিকাশ সামন্ত দুজনেরই নাম রয়েছে। এর আগে তাঁদের বাবা শিশির সামন্তও আবাস যোজনার টাকা পেয়েছেন। একই পরিবার, দোতলা পাকা বাড়িও রয়েছে। এই বুথের তৃণমূলের সম্পাদক তপন প্রধানের পাকা বাড়ি রয়েছে, তাঁর নামও তালিকায়। তৃণমূল নেতা গৌতম প্রধান ও তাঁর ছেলে রঘুনাথ প্রধান— বাবা ছেলের নামও তালিকায়। বিশ্বনাথ সাউ ও তাঁর ভাই তারক সাউ একই পরিবার, দুজনেরই আবাস যোজনার তালিকায়। 
তৃণমূলের নেতার তিনটি পাকা বাড়ি, এমন চার ভাই শেখ কালাউদ্দীন, জালালুদ্দিন, ইকবালউদ্দীন ও সালাউদ্দিনের নাম তালিকায় রয়েছে। দোতলা পাকা বাড়ি অবসর প্রাপ্ত বিএলআরও দপ্তরের সরকারি কর্মী প্রণব কাজলি, তাঁর ছেলে দেবু কাজলির নামও আবাস যোজনায়। মুম্বাইতে কাঠের ঠিকাদার, গ্রামে দোতলা পাকা বাড়ির মালিক অলোক কাজলির নামও তালিকায়। তৃণমূলের বুথ সহ সভাপতি, পাকা বাড়ির মালিক রঘুনাথ প্রধান ও তাঁর ছেলে গৌতম প্রধান, দুজনেরই নাম রয়েছে আবাস যোজনায়। 
   পরিস্থিতি এমনই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে  বুথে বুথে আবাস যোজনার তালিকা প্রকাশ করে প্রকাশ্যে তা টাঙানোরও সাহস দেখাতে পারছে না প্রশাসন। গ্রাম সংসদ সভা করে আবাস যোজনার তালিকা তৈরি করার আইনি নির্দেশ থাকলেও তা কোথাও করা হয়নি। ২০১৮ সালে ভিলেজ রিসোর্স পার্সেন (ভিআরপি) দিয়ে যে তালিকা তৈরি করা হয় সেই তালিকা তেরির পরেও জালিয়াতি করা হয়েছে, এমন অভিযোগ তথ্য দিয়ে জমা দিয়েছেন দাসপুরের সোনাখালি এরিয়া কমিটির সম্পাদক অমল ঘোড়ই। ভিআরপি তালিকা অনুযায়ী দাসপুর-২ নম্বর ব্লকের ১৫,৪৭৮টি মাটির বাড়ি নথিবদ্ধ হয়। কিন্তু লোকসভা ভোটের পর সেই তালিকা থেকে দু’হাজার অধিক পরিবারের নাম বাদ যায়। এই বাদ যাওয়া সকলেই গরিব মানুষ, ভাঙা দরমার ঘরে থাকেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment