‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে ফের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের উসকানি দিলেন মোদী। শুক্রবার এই গান রচনার ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোদী বলেন, ‘‘বন্দে মাতরম ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক। তবে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ১৯৩৭-এ এই গানের গুরুত্বপূর্ণ পংক্তি কেটে দিয়ে দেশভাগের বীজ বপন করা হয়। রাষ্ট্র গঠনের এই মহামন্ত্রের ওপর কী কারণে এমন ভয়ঙ্কর অন্যায় করা হয়েছিল, তা আজকের প্রজন্মের জানা উচিত। এই বিভাজনমূলক মনোভাব দেশে এখনও রয়েছে।’’
একধাপ এগিয়ে গিয়ে, ‘বন্দে মাতরম’-কে বড় করতে ‘জনগন মণ’-কে ব্রিটিশদের তোষামোদের সঙ্গীত বলে আক্রমণ করেছেন কর্নাটকের বিজেপি সাংসদ বিশ্বেশ্বর হেগডে কাগেরি। মোদীর উপস্থিতিতে ডাকটিকিট উদ্বোধনের এই অনুষ্ঠানে কাগেরি বলেন, ‘‘বন্দে মাতরমের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত ছিল। তবে আমাদের পূর্বসূরীরা ‘জনগণ মন’-র মতো ব্রিটিশ প্রভুদের তোষামোদ করে লেখা এক গানের সঙ্গে ‘বন্দে মাতরম’-কে সমতুল্য করার সিদ্ধান্ত নিলেন!’’
বহুদিন ধরেই ‘বন্দে মাতরম’ গানটিকে ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদীরা সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে চলেছে। সঙ্ঘ পরিবার এই গানকে ‘জনগণ মন’-র প্রতিযোগী হিসেবে তুলে ধরছে। সম্প্রতি বিজেপি-আরএসএস’র বহু নেতা সরাসরি রবীন্দ্রনাথ এবং ‘জনগণ মন’-র বিরুদ্ধে নানা ধাঁচের আক্রমণ করে চলেছেন।
কয়েক দশক ধরেই ‘বন্দে মাতরম’-র শেষ কয়েকটি পংক্তি বাদ দেওয়া নিয়ে গান্ধী, নেহরু ও সে যুগের কংগ্রেস নেতাদের হিন্দুত্ববাদীরা আক্রমণ করে গেছে। তাদের দাবি— ‘বন্দে মাতরম’-এ দেশকে দেবী রূপে দেখা হয়েছে বলে মুসলিমরা তা গাইতে চায় না। তারা দেশদ্রোহী! কংগ্রেস ও অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দল সংখ্যালঘু ভোটের জন্য মুসলিমদের এই দেশদ্রোহী প্রবৃত্তিকে মদত যুগিয়েছে, আপস করেছে। সেই কারণেই স্বাধীন ভারতে ‘বন্দে মাতরম’-কে পরিকল্পিত ভাবে আড়াল করা হয়েছে। তার প্রথম দুই পংক্তি বাদে বাকি অংশ ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে। এই গানকে জাতীয় সঙ্গীতের সম্মান দেওয়া হয়নি।
এদিকে মোদীর মন্তব্যকে কটাক্ষ করে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, ‘‘জাতীয়তাবাদের ঠিকাদার সেজে, ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের এই দরদ হাস্যকর। ভুলে গেলে চলবে না, আরএসএস বা বিজেপি কখনই তাদের দপ্তরে ‘বন্দে মাতরম’ কিংবা ‘জনগণ মন’ গায়নি। ১৯২৫-এ স্থাপনার পর থেকে আজ অবধি আরএসএস কখনও তাদের শাখায় ‘বন্দে মাতরম’ গায়নি। তাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখা, নথি বা উদ্ধৃতিতেও ‘বন্দে মাতরম’-র কোন উল্লেখ মেলে না।’’
ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকেই এই নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা উসকানিমূলক প্রচার করে চলেছে। এর জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তির পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই গানকে হিন্দুত্ববাদীরা বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। শুক্রবার ডাকটিকিট উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে সেই উদ্দেশ্যে মোদী এই ধাঁচের আক্রমণ করেছেন।
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে প্রতি বছর জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া হত। তবে ১৯৩৭-তে মুসলিম লীগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে ‘বন্দে মাতরম’-কে আক্রমণ করে মুসলিম বিদ্বেষী বলে দাগানো হয়। ‘বন্দে মাতরম’ সংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, মৌলানা আজাদ ও আচার্য নরেন্দ্র দেবকে নিয়ে এক সাব কমিটি গঠন করে। এই গানকে ঘিরে ধর্মভীরু মুসলিমদের একাংশের মধ্যে যে সত্যিই আপত্তি রয়েছে তাঁরা তা স্বীকার করেন। ইসলাম ধর্ম নিরাকারতায় বিশ্বাসী। এদিকে ‘বন্দে মাতরম’ পৌত্তলিকতার কথা বলে। পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্র যে আঙ্গিকে তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে এ গান ব্যবহার করেছেন তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য ভাবে গান্ধী তাঁর ‘হরিজন’ পত্রিকায় লেখেন, ‘‘স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে এক ঐতিহাসিক উপন্যাসে কী আঙ্গিকে এই গান ব্যবহার করা হয়েছে, তার থেকে জাতীয় জীবনে বন্দে মাতরমের আধুনিক বিবর্তন ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’ সব দিক বিচার করে সাব কমিটি সুপারিশ করে— কংগ্রেসের কোন সমাবেশে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া হলে শুধুমাত্র প্রথম দুই পংক্তিই গাওয়া উচিত। এই গানের পাশাপাশি এমন কোন গান যা নিয়ে কারোর আপত্তি নেই তাও আয়োজকদের গাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার থাকবে।
মোদীর মন্তব্য নিয়ে আক্রমণ করতে গিয়ে এদিন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ মনে করিয়ে দেন, খোদ রবীন্দ্রনাথের কথাতেই কংগ্রেসের সাব কমিটি এই সিদ্ধান্ত নেয়। নেহরুকে চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম’-র প্রথম দুই পংক্তি গাওয়া যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন। এই পরামর্শই তাঁদের সিদ্ধান্তের প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
সংবিধান প্রণয়নের সময়, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভারতের গণপরিষদ সদস্যরা বলেন, জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এমন কোন গানকে মর্যাদা দেওয়া উচিত যা ধর্ম, জাতি ও আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে উঠে ভারতবর্ষের অখণ্ডতাকে তুলে ধরবে। ‘বন্দে মাতরম’ কথাটি এবং তার প্রথম দুই পংক্তির মধ্যেও হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের ইঙ্গিত রয়েছে। ফলত তার বদলে রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণ মন’-কে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে এই গানেরও শেষ তিন পংক্তিতে হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগের উপস্থিতি থাকায় নির্ধারিত জাতীয় সঙ্গীতের থেকে তা বাদ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ‘বন্দে মাতরম’-র ঐতিহাসিক গুরুত্ব, স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান মাথায় রেখে প্রথম দুটি পংক্তিকে গণপরিষদ জাতীয় গানের মর্যাদা দেয়। ‘জনগণ মন’-র মতোই গানের বাকি অংশকে সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ তা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বলে সঙ্ঘের প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং উসকানিমূলক। এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, হিন্দুত্ববাদীদের অন্যতম নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও গণপরিষদের এই প্রস্তাবে সাক্ষর করেন। গণপরিষদের আলোচনায় এই নিয়ে তিনি কোন আপত্তি করেননি। উলটে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই গোটা দুনিয়া ভারতকে চিনেছে বলে বক্তব্য রাখেন! শ্যামাপ্রসাদের অবস্থানের বিপরীতে গিয়ে মোদী, বিজেপি ও সঙ্ঘের এখন এমন সক্রিয়তা কী কারণে তা সহজেই অনুমেয়।
Vande Matram
বিভাজনের লক্ষ্যে ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে তথ্য বিকৃতি মোদীর
×
Comments :0