২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল হিলে যা ঘটেছিল ঠিক দু’বছর পর সেই জানুয়ারি মাসে তারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটলো ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়ায়। ক্যাপিটলের বেপরোয়া হামলা চালিয়ে দখল নেবার চেষ্টা করেছিল নির্বাচনে পরাজিত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের উন্মত্ত উগ্র সমর্থকরা। আর ব্রাসিলিয়ায় প্রায় একই কায়দায় রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করেছিল নির্বাচনে সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জাইর বলসনারোর অন্ধ ও হিংস্র সমর্থকরা।
আমেরিকায় যেমন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে মানুষের রায়কে অস্বীকার করে তাকে ভুয়া বলে আখ্যা দিয়ে ক্রমাগত সমর্থকদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন তেমনি ব্রাসিলিয়াতেও ট্রাম্পের ভক্ত বলসনারো সদ্য শেষ হওয়া গণতান্ত্রিক নির্বাচনের রায় অস্বীকার করে দেশে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, অশান্তি ও অস্থিরতা তৈরি করতে সমর্থকদের লেলিয়েছেন।
ট্রাম্প যেমন অতি দক্ষিণপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদের নেতা তেমনি বলসনারোও তাই। দু’জনের কেউই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নাগরিকদের রায়কে অগ্রাহ্য করে ফ্যাসিস্ত কায়দায় গায়ের জোরে হিংসা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ক্ষমতা দখল করতে চায়। গণতন্ত্রে যে তাদের বিশ্বাস নেই, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যে তারা সহ্য করতে রাজি নয় তার প্রমাণ তারা হাতে-কলমে দিয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্টে হামলা চালিয়ে ধ্বংসাত্মক কাণ্ড ঘটিয়ে সেগুলি দখল করার চেষ্টা। দুই জায়গাতেই শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়েছে। গণতন্ত্রের শক্তি অটুট থেকেছে।
অতি দক্ষিণপন্থার হাত ধরে বিশ্বের সর্বত্র যে নব্য ফ্যাসিস্তদের আত্মপ্রকাশ ঘটছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা গণতন্ত্রের একটা আবরণের আড়ালে থাকার চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মধ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলেও ক্ষমতা দখলের পরে একটু একটু গণতন্ত্রের সেই আবরণ খসিয়ে আসল রূপ প্রকাশ করে।
অতীতেও দেখা গেছে ফ্যাসিস্তরা প্রথমে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে গণতান্ত্রিক পথেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করে। ক্ষমতা দখলের পর গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ফ্যাসিস্ত স্বৈরাচার করায়ত্ত করে। একালে আমেরিকা ও ব্রাজিলে দেখা গেছে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তি গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে ধীরে ধীরে উগ্র দক্ষিণপন্থার ফ্যাসিস্ত কর্মসূচি রূপায়ণে সক্রিয় হয়। পরবর্তী নির্বাচনে পরাজয়ের পর তারা তাদের গণতান্ত্রিক মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে হিংস্র ও কদর্য চেহারা সামনে হাজির করে।
এই কদর্যতার প্রকাশ নির্বাচনে মানুষের রায়কে অস্বীকার করায়। ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে সমর্থকদের ক্ষিপ্ত ও আগ্রাসী করে তোলা। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি অস্বীকার করে গায়ের জোরে ক্ষমতা পুনর্দখল চায়। তার নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে বলসনারোর মদতে তার সমর্থক দেশের সর্বত্র একের পর এক লাগাতার বিক্ষোভ, অবস্থান, ঘেরাও ইত্যাদি চালিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার তিন কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে দখল নেবার অভিযান শুরু করে।
এটা কোনও স্বতঃস্ফূর্ত অভিযান নয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে বাছাই করে উগ্র ও হিংস্র সমর্থকদের বাসে করে নিয়ে আসা হয়েছে। ফুটবল দলের জার্সি, জাতীয় পতাকা নিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান দিয়ে তারা গণতন্ত্রের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। এটা যে অতি দক্ষিণপন্থী নব্য ফ্যাসিস্তদের পরিকল্পিত কাজ তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকছে না।
এই ঘটনার পর সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক শক্তির দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। অতি দক্ষিণপন্থাকে রুখতে গণতান্ত্রিক শক্তির আরও ঐক্যবদ্ধ সচেতন প্রয়াস জরুরি হয়েছে। আশার হিংসাত্মক দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিশ্বের বহু দেশ। লাতিন আমেরিকার বেশিভাগ দেশ লুলার সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। হামলার নিন্দা করে বিবৃতি দিতে হয়েছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনকেও। এমনকি ভোটের পর পালিয়ে আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়া বলসনারোকেও দায় এড়াবার বিবৃতি দিতে হয়েছে।
Comments :0