অরূপ সেন
আগামী ৫ এপ্রিল দেশের শ্রমজীবী জনতার সম্মিলিত অসন্তোষে আরও একবার কেঁপে উঠতে চলেছে রাজধানী দিল্লির রাজপথ। মোদী সরকারের সর্বনাশা নীতির বিরুদ্ধে ঘৃণা উগরে দিতে ওইদিন রাজধানীর বুকে সুবিশাল জঙ্গী সমাবেশ করবেন এদেশের শ্রমিক-কৃষক এবং খেতমজুররা। নয়া উদারনীতি বাস্তবায়নে শাসকগোষ্ঠী যেসব আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, তা প্রতিরোধের শপথেই হবে এই ‘মজদুর-কিষান সঙ্ঘর্ষ সমাবেশ’।
সমাবেশের ডাক দিয়েছে সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস (সিআইটিইউ), সারা ভারত কৃষকসভা (এআইকেএস) এবং সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন (এআইএডবলিউএ)। তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পরে দেশে সম্পদ উৎপাদনকারী শ্রেণিগুলির সর্ববৃহৎ সমাবেশ দেখতে চলেছে রাজধানী। শ্রমিক-বিরোধী, কৃষক-বিরোধী এবং খেতমজুর-বিরোধী সরকারি নীতি প্রতিরোধের আহ্বানে এই সমাবেশ সর্বাত্মক করে তুলতে গত কয়েক মাস ধরে দেশের প্রতিটি গ্রাম-শহরের কোণে কোণে নিবিড় যৌথ প্রচার চলেছে। সেই ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলনের শীর্ষ তরঙ্গে বুধবার মোদী সরকারের দিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে খেটে-খাওয়া মানুষের দৃপ্ত সমাবেশ।
শ্রমজীবীর এই সংগ্রামে পূর্ণ সংহতি জানিয়ে সমাবেশে বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সকলের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও। শনিবার সোশাল মিডিয়ায় এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, বিজেপি সরকার দুর্বিষহ অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে চলেছে এদেশের শ্রমজীবীর ঘাড়ে। প্রতিবাদ জানানোর জন্য তাই রাজপথে নেমেছেন শ্রমিক-কৃষক এবং খেতমজুররা। কৃষকের ফসলের এমএসপি, কৃষিঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রতারণা করেছে মোদী সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। শ্রম আইনগুলি বিলোপ করে শোষণের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সরকারের বন্ধু বড়ো বড়ো কর্পোরেটদের অবাধ লুটের ব্যবস্থা হয়েছে। এই অবস্থা বদলানোর জন্য শ্রমজীবীরা ঐক্যবদ্ধভাবে যে লড়াইয়ে নেমেছেন, তার পাশে সিপিআই(এম) সর্বতোভাবে থাকছে। সমাবেশের প্রতিটি দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে সিপিআই(এম)।
কর্পোরেটপ্রেমী মোদী সরকারের উদ্দেশে মেহনতির সমাবেশ স্পষ্ট দাবি জানাবে, প্রতি মাসে সব শ্রমিকের ২৬হাজার টাকা করে ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। সি২+৫০% নীতি মেনে সব কৃষকের সব ফসলের এমএসপি দিতে হবে। উৎপাদিত সব ফসলের সরকারি সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। চার শ্রম কোড বাতিল করতে হবে। বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল, ২০২০ বাতিল করতে হবে। একইসঙ্গে সমাবেশ বলবে, এমএনরেগা’য় ২০০দিনের কাজ এবং দৈনিক ৬০০টাকা মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। শহর এলাকায় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন চাই। গরিব ও মধ্য কৃষক এবং খেতমজুরদের সব ঋণ এককালিন মকুব করতে হবে, ৬০বছরের বেশি বয়সিদের সকলকে পেনশন দিতে হবে। সমাবেশ সোচ্চার হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ বন্ধের দাবিতে। সমস্বরে বলবে, ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন (এনএমপি) এবং অগ্নিপথ প্রকল্প খারিজ করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গণবণ্টন ব্যবস্থা জোরদার ও সর্বজনীন করতে হবে। ১৪টি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য রেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। ট্যাক্স দেয় না এমন সব পরিবারে খাদ্য ও আয় নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমজীবী জনতার আরও দাবি, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর থেকে জিএসটি প্রত্যাহার করতে হবে। কেন্দ্রীয় কর কমিয়ে পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, রান্নার গ্যাসের দাম কমাতে হবে। অরণ্য অধিকার আইন (এফআরএ) কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বাসিন্দাদের না জানিয়ে বনাঞ্চল ধ্বংসের অনুমতি দেওয়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি বন (সংরক্ষণ) আইনের যাবতীয় সংশোধনী ও বিধি প্রত্যাহার করতে হবে। প্রান্তিক অংশের মানুষের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন বন্ধ করে সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করতে হবে। সমাবেশ থেকে স্লোগান উঠবে, সকলের জন্য উচ্চমানের এবং সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সকলের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অতি-ধনী ও কর্পোরেটের ওপর কর বাড়িয়ে এবং সম্পদ কর চালু করে সব শ্রমিককে মাসে ১০হাজার টাকা করে পেনশন দিতে হবে। মোদী সরকার এই দাবি মানলে শেষপর্যন্ত আপসহীন লড়াই, জানিয়ে দেওয়া হবে সমাবেশ থেকে।
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লির বুকে ঐতিহাসিক ‘মজদুর-কিষান সঙ্ঘর্ষ সমাবেশ’ হয়েছিলো। কর্পোরেটমুখী সরকারের বিরুদ্ধে এবারের সমাবেশও স্মরণকালের মধ্যে বৃহত্তম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সমাবেশের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, শ্রমজীবীদের দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে গত কয়েক মাসে নানান কর্মসূচি হয়েছে। ‘‘এখনো যে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়নি, তাঁদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছনোর লক্ষ্য’’ নিয়েই বাড়ি বাড়ি প্রচার চালিয়েছে শ্রমিক-কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনগুলি। তার আগে জানুয়ারিতে হয়েছে রাজ্যভিত্তিক কনভেনশন। জেলা-পর্যায়ের যৌথ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৪০০’রও বেশি জেলায়। পাশাপাশি জাঠা, শোভাযাত্রা, ধরণা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়েছে দেশের শ্রমজীবীদের দুর্দশা এবং সরকারি নির্মমতার কথা।
দেশের সংগ্রামী শ্রমজীবীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হচ্ছে রাজধানী দিল্লিও। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক সহ দিল্লির প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, শিল্পী, পেশাজীবী এবং সর্বস্তরের সমাজকর্মীকে নিয়ে ইতিমধ্যেই গঠিত হয়েছে একটি অভ্যর্থনা কমিটি। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শ্রমজীবীরা দলে দলে পৌঁছতে শুরু করবেন দিল্লিতে। সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, এআইকেএস’র সাধারণ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণাণ এবং এআইএডবলিউএ’র সাধারণ সম্পাদক বি ভেঙ্কট জানান, সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানাতে তৈরি হয়ে গিয়েছেন কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবক। শুধু উদ্যোক্তা সংগঠনগুলির কর্মী-সমর্থকরাই নন, মেহনতীর লড়াইয়ে সংহতি জানিয়ে সমাবেশ সফল করতে সব রকমের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজধানীর বিভিন্ন অংশের মানুষ। সমাবেশে যোগ দিতে যাঁরা আগে এসে পৌঁছবেন তাঁদের জন্য দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি আশ্রয় শিবির থাকছে। বুধবার সকাল ১১ টায় শুরু হবে সমাবেশের কর্মসূচি।
নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, আন্দোলনের এই পথেই সারা দেশে শ্রমজীবীদের ঐক্য ও বোঝাপড়া আরও মজবুত করে তোলা হবে। শাসকের সর্বনাশা নীতি মোকাবিলায় যৌথ প্রতিরোধ কর্মসূচি আরও তীব্র করে তোলা হবে। এই যৌথ সংগ্রামে সক্রিয় সংহতির হাত বাড়াতে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে আহ্বানও জানান নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলেছেন, জীবনজীবিকা ও কাজের পরিবেশের আশু দাবিগুলিই শুধু নয়, আজকের সংগ্রাম বিজেপি-আরএসএস জমানার সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী আক্রমণ থেকে দেশের অর্থনীতি এবং আমাদের সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে রক্ষার জন্যও। তাই বিজেপি-আরএসএস’র উদারনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শাসনকে পর্যুদস্ত করার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।
Comments :0