ব্যর্থতার বলি
-
-
- Oct 12, 2021 07:02 [IST]
- Last Update: Oct 12, 2021 07:02 [IST]
উৎসবের আড়ম্বরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মৃত শিশুর মায়ের কান্না। গত এক মাসের বেশি সময় ধরে, প্রধানত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিনই মায়ের কোল খালি করে চলে যাচ্ছে সন্তান। সন্তানহারা বাবা-মায়ের কান্নার রোলে ভারী হচ্ছে হাসপাতাল চত্বর। কেউ মারা যাচ্ছে জন্মের কয়েকদিন পর, কেউ কয়েক মাস পর, আবার কেউ কয়েক বছর পর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভর্তির দু’চারদিনের মধ্যেই মৃত্যু হচ্ছে। এমনকি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর বাড়ি যাবার পথেই মারা গেছে শিশু। গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৬৭জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যদিও বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা অনেক বেশি। অবশ্য এক্ষেত্রেও সরকার মৃতের সংখ্যা আড়াল করতে মরিয়া। করোনা মৃত্যুর মতো এক্ষেত্রেও কো-মর্বিডিটি তত্ত্বের মতো অজুহাত খাড়া করে মৃত্যু কমিয়ে দেখিয়ে বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছে।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে জ্বর, বমি, পেটখারাপ ও শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা দেয় জলপাইগুড়িতে। তারপর ছড়িয়ে পড়ে উত্তরবঙ্গের সব জেলায়। প্রথম মৃত্যুর খবর আসে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। সমস্ত সরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিহোমে শিশু রোগীর ভিড় বাড়তে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন ভোটে জেতার জন্য পড়ে আছেন ভবানীপুরে। উত্তরবঙ্গে হাজার হাজার শিশুর যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে কিনা, কেন আচমকা এত শিশুর একই উপসর্গ দেখা যাচ্ছে, তার খোঁজ নেবার দায় কারও নেই। সরকারি মহল থেকে বিষয়টিকে উপেক্ষা করে বলা হয় আবহাওয়া বদলের কারণে হয়েছে। প্রতিবারই এমন হয়। কোনও অজানা রোগ নয়, নানা সমস্যা থাকায় মৃত্যু হচ্ছে। এমনও বলা হয় যে দেরিতে হাসপাতালে আসায় মৃত্যু হচ্ছে। মায়ের অপুষ্টির কারণে কম ওজনের শিশু হচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। এমন জ্ঞান বিতরণ করে সরকার তাদের দায় সেরেছে। অর্থাৎ দোষ বাবা-মায়ের, তাদের পরিবারের। সরকারের কোনও দোষ নেই, দায়ও নেই। অতএব মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গোটা সরকার এবং শাসক দল উপনির্বাচন পর্ব শেষ করে উৎসবে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। আরএসএস ঘোষিত সাক্ষাৎ দুর্গা গত কয়েকদিন ধরে দুর্গার চোখে তুলি ঠেকাচ্ছেন আর মণ্ডপ উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন। সরাসরি এবং ভার্চুয়াল মিলিয়ে প্রতিদিন গন্ডা গন্ডা মণ্ডপ উদ্বোধন করছেন। প্রায় সব জেলায় তিনি মণ্ডপের ফিতা কাটছেন কলকাতায় বসে। দলের নেতা-মন্ত্রীদের সকলেরই এক-একটি করে পূজা কমিটি হচ্ছে। তাঁরা পড়ে আছেন আড়ম্বরে কে কাকে টেক্কা দেবেন সেই প্রতিযোগিতায়। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে যখন শতাধিক শিশু কাতরাচ্ছে, মারা যাচ্ছে, তখন কলকাতা থেকে ভার্চুয়ালি শিলিগুড়ির এক গুচ্ছ মণ্ডপ উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ মৃত্যুশয্যায় শিশুদের বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করেননি। যেন ওরা মৃত্যু জন্যই জন্মেছে।
অল্প সময়ে কিছু সাধারণ উপসর্গ নিয়ে বেশ কয়েকটি জেলাজুড়ে যখন হাজার হাজার শিশু আক্রান্ত হয় এবং ৬৭জন শিশুর মৃত্যু হয় তখন বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যদি সাধারণ ব্যাপার হতো তাহলেও মৃত্যু ঠেকানো এবং রোগমুক্তির দায় সরকারের থাকে। তাছাড়া এমনটা তো আগে সচরাচর দেখা যায়নি। এমন হঠাৎ হলো কেন? এইসব প্রশ্নের সদুত্তর সরকারের জানা নেই। সরকার উত্তর খোঁজার চেষ্টাও করেনি। করোনাকালের দেড় বছরের মাথায় এই ঘটনার পেছনে যদি অপুষ্টির কথা যুক্ত হয় তাহলে তো অপরাধীর কাঠগড়ায় সরকারকেই দাঁড় করাতে হয়। কাজ হারিয়ে, রুজি হারিয়ে মানুষ যখন দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে তখন সরকারের দায় তাদের খাবার ও কাজের জোগান দেওয়া। ঘোষণা অনুযায়ী সকলে যদি পর্যাপ্ত খাদ্য পেত, আইসিডিএস কেন্দ্রগুলি যদি চলতো, মিড ডে মিল যদি পাওয়া যেত এবং ১০০ দিনের কাজ যদি মিলতো তাহলে তো কোনও মা ও শিশুর অপুষ্টির কারণ থাকত না। কম ওজনের বা কম প্রতিরোধ ক্ষমতার শিশুর জন্ম হতো না। শিশু মৃত্যুর ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে করোনাকালে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার থেকে রক্ষা করতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। আর সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই মেতে আছে উৎসবে।