শহীদের রক্তে ভেজা পথেই
-
তীর্থঙ্কর বিশ্বাস
- Aug 31, 2021 18:44 [IST]
- Last Update: Aug 31, 2021 18:44 [IST]
আজ থেকে ৬২ বছর আগে আজকের দিনে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে গরিব মানুষ কলকাতার রাজপথে পা মিলিয়েছিলেন ‘খাদ্য চাই’ এই দাবিতে। সেদিন ৮০ জন নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। হাজার হাজর মানুষ নিখোঁজ হন। কত যে মানুষ সেদিন চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছেন তার হিসাব নেই।
আজ ৩১ আগস্ট, ঐতিহাসিক শহীদ দিবস। ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে রক্তে লেখা একটি দিন। ১৯৫৯ সালের এই দিনটিতে খাদ্যের দাবিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ মিনার ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। ‘খাদ্য চাই’– এই দাবিতে বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষ নারী-পুরুষ জমায়েত হয়েছিলেন কলকাতায়। পা মিলিয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ মিছিলে। এরাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তাঁর পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার। সশস্ত্র পুলিশ মিছিলকে ঘিরে ফেলে নির্বিচারে লাঠি চালায়, টিয়ার গ্যাস চালায়। নিরীহ গরিব মানুষের ওপর নেমে আসে নৃশংস আক্রমণ। বিধান রায়ের পুলিশ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে গ্রাম থেকে আসা ৮০জন ক্ষুধার্ত মানুষকে। ওইদিন কত মানুষ যে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছেন তার হিসাব নেই। আহত হয়েছিলেন প্রায় ৪০০০ মানুষ। ৩১ আগস্ট সেই রক্তাক্ত ঘটনার পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর রাজ্যব্যাপী পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। সেদিনও ছাত্রদের আন্দোলন ভাঙার জন্য পুলিশ লাঠি চালায়, কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। শহীদ হন কয়েকজন ছাত্র। পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন আরও তীব্র হয়। ৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য জুড়ে পালিত হয় সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল। জয়ী হয় গণতান্ত্রিক মানুষের আন্দোলন।
ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের পরে পশ্চিমবাংলার গণআন্দোলন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পার্টির কর্মীদের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ সংগঠিত হয়। শহীদ হন অনেকে। আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই ১৯৬৭ ও ১৯৬৯সালে দুই দফায় রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। ১৯৬৯-’৭০ সালের শেষদিক থেকে কংগ্রেস-নকশাল-পুলিশ কর্তৃক খুন, লুঠপাট, বিনাবিচারে জেলে পোরা, শিক্ষক-উপাচার্য হত্যা, সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে প্রচণ্ড ফ্যাসিস্তসুলভ সন্ত্রাস, ইন্দিরা-হাওয়া এবং বামপন্থীদের আলাদা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো রাজ্যে বৃহত্তম দলে পরিণত হয় সিপিআই(এম)। বামপন্থীরা আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। উপায়ন্তর না থাকায় কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের পরিচালনায় পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭২ সালে বিধানসভা নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে নজিরবিহীন সন্ত্রাস-রিগিং হয়। তারপর শুরু আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস। পরবর্তী পাঁচ বছরে পশ্চিমবাংলায় ১১০০সিপিআই (এম) নেতা-কর্মী খুন হন। ২০ হাজারেরও বেশি কর্মী বাড়িছাড়া, এলাকাছাড়া হন। পার্টি অফিস, ট্রেড ইউনিয়ন অফিস দখল ও তালাবন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন মধ্যরাতে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি হয় এই রাজ্যে বামপন্থীদের উপর আক্রমণ আরও তীব্র হয়।
১৯৭৭ সালের বিধনসভা নির্বাচনে সমস্ত সন্ত্রাস উপেক্ষা করেই গোটা দেশ ও পশ্চিমবাংলার মানুষ কংগ্রেসের এই স্বৈরাচারী আক্রমণের জবাব দেয়। দিল্লিতেও কংগ্রেস পরাস্ত হয়। পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। শুরু হয় নতুনভাবে পথ চলা। বামফ্রন্ট সরকার এরাজ্যে ৩৪বছর সরকার পরিচালনা করে। তখনও বামপন্থীদের ওপর আক্রমণ থেমে থাকেনি। রাজ্যে শ্রেণি-আন্দোলন ও গণআন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে, গরিব ও সাধারণ মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড রূপায়ণ করতে কংগ্রেস, তৃণমূল, মাওবাদীসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আক্রমণে এই ৩৪ বছরে ২৮০৬ জন বামফ্রন্ট নেতা-কর্মী শহীদের মৃত্যুবরণ করে। রক্তে ভেজা পথ ধরেই বামফ্রন্ট সরকারকে মানুষের স্বার্থে উন্নয়নের কর্মসূচি রূপায়ণ করে এগিয়ে যেতে হয়েছে।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয় তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট। পরবর্তী সময়ে এই জোট থেকে কংগ্রেস বেরিয়ে যায়। নির্বাচনে জয়ী হবার পরদিন থেকেই তৃণমূলের নেতৃত্বে বামপন্থীদের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু হয়। খুন, পার্টি অফিস আক্রমণ, নির্যাতন, নারীদের ওপর হিংস্রতা, ধর্ষণ একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে সারা রাজ্যজুড়ে। যেসব ভুমিহীন কৃষক বামফ্রন্ট আমলে জমি পেয়েছিলেন তাঁদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করে জমি দখল করে নিচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, অরাজকতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার। তৃণমূল সরকারের আমলে এরাজ্যে এখনও পর্যন্ত খুন হয়েছেন ২২৮জন বামপন্থী নেতা, কর্মী, সমর্থক।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তদশ বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে বামপন্থীদের ফলাফল হয় বিপর্যয়কর। এরাজ্যে কখনও এতো খারাপ ফল হয়নি বামপন্থীদের। বিধানসভায় একজনও বামপন্থী প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি’র মধ্যে মেরুকরণ ঘটেছে। প্রধাণ বিরোধী হিসাবে বিজেপি’র অভ্যুত্থান হয়েছে। এরাজ্যের মানুষের মধ্যে বামপন্থীদের যে গণভিত্তি ছিল তার বিরাট ক্ষয় হয়েছে।
ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের অমর শহীদদের স্মরণ করে ৩১ আগস্ট দিনটি ১৯৫৯সালের পর থেকে প্রতি বছরই শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয়। রাজ্যের মানুষ এই দিনটিকে গণআন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে শহীদ দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি এরাজ্যের গণআন্দোলনে নিহত অমর শহীদদের। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন আমরা স্মরণ করছি তাঁদের। শপথ নিচ্ছি শহীদদের আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার।
২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে এবছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এরাজ্যে শহীদের মৃত্যু বরণ করেছেন ৬জন সিপিআই(এম) সদস্য, কর্মী। তাঁদের নাম দেওয়া হলো:
১২ জানুয়ারি, ২০২১– উত্তর দিনাজপুর জেলার চাকুলিয়া এলাকার কানকিতে বিজেপি-তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতিদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন সিপিআই(এম) কানকি এরিয়া কমিটির অন্তর্গত হাসান শাখার সদস্য কমরেড গুরুচাঁদ রায়। সন্ধ্যাবেলায় দু’জন দুষ্কৃতী মোটরবাইকে চড়ে এসে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে দরিদ্র কৃষক কমরেড গুরুচাঁদ রায়কে।
১৫ ফেব্রয়ারি, ২০২১– বাঁকুড়া জেলার কোতুলপুরের চোরকলার বাসিন্দা ডিওয়াইএফআই’র সদস্য কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যাকে পুলিশ বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার কাজের দাবিতে নবান্নে স্মারকলিপি দেবার জন্য জমায়েত হয়েছিল রাজ্যের ছাত্র-যুবরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পুলিশ রাস্তার চারিদিক অবরুদ্ধ করে, অলিগলি বন্ধ করে কাজ চাইতে আসা ছাত্র-যুবদের উপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের লাঠি-কাঁদানে গ্যাস চালাতে থাকে পুলিশ বাহিনী। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে কলকাতার রাজপথ। ৫০০-র উপর ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। পুলিশের এই নৃশংস আক্রমণে গুরুতর আহত হন যুব কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যা। ১৫ ফেব্রয়ারি সকালে কলকাতার একটি নার্সিংহোমে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৫ ফেব্রয়ারি, ২০২১– উত্তর দিনাজপুর জেলার ডালখোলা থানা এলাকার বাসিন্দা সিপিআই(এম) রানিগজ্ঞ শাখা সম্পাদক কমরেড রফিক আলমকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী।
২০ এপ্রিল, ২০২১– মুর্শিদাবাদ জেলার হরিহরপাড়ার রায়পুর অঞ্চলের খোশালপুর বিলধারি পাড়ায় নমাজ পড়ে ফেরার সময় তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী বোমা মেরে হত্যা করে সিপিআই(এম) কর্মী কমরেড কাসমত শেখ ওরফে কাশেম আলিকে।
২৮ এপ্রিল, ২০২১– মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকলে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জাফিকুল ইসলাম আটটি গাড়ির কনভয় নিয়ে এলাকা টহল দেবার সময়ে গাড়িতে পিষে দেয় তিনজন সিপিআই(এম) কর্মীকে। রাত ১১টা নাগাদ ডোমকলের শাহবাজপুর গ্রামে এই গাড়ির কনভয় নিয়ে ঢোকেন জাফিকুল ইসলাম। এলাকায় সন্ত্রাস চালাতে ভয় দেখাতে থাকেন। পাড়ার মোড়ে কয়েকজন সিপিআই(এম) কর্মী দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলে তিনি তাঁদের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেন। ঘটনাস্থলে তিনজন গুরুতর আহত হন। তাদের মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে মৃত্যু হয় সিপিআই(এম) কর্মী কাদের মণ্ডলের।
২ মে, ২০২১ – পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুরের নবগ্রামে নৃশংসভাবে খুন হন সিপিআই(এম) কর্মী কমরেড কাকলি ক্ষেত্রপাল। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার পর রাজ্যজুড়ে বেপরোয়া হিংস্র তাণ্ডব চালায় তৃণমূল কংগ্রেসের উন্মত্ত বাহিনী। সিপিআই(এম)’র হয়ে নবগ্রামের ষষ্ঠীতলার পাড় এলাকায় নির্বাচনের কাজ করে ছিলেন কাকলি ক্ষেত্রপাল, সে কারণেই তার বাড়িতে ঢুকে তৃণমূলের লোকেরা হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে খুন করে তাঁকে।