রণদীপ মিত্র: শান্তিনিকেতন
‘যাঁরা ভারতীয়, তাঁদের সমগ্র ভারতবর্ষের উপর অধিকার আছে’, বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে এই মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
দেশে পা দিয়েই দেশের নানা রাজ্যে, বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গরিব শ্রমজীবী বাংলাভাষী মানুষের উপর অমানবিক হেনস্তার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন অমর্ত্য সেন। ভাষাকে নিশানা করার প্রেক্ষিতে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘একটা ভাষার যে মূল্য পাওয়া উচিত তা অনেক সময় পায় না, অবহেলিত হলে নিশ্চয়ই তা বন্ধ করতে হবে।’’ সেই সাথে তিনি যোগ করেন, ‘‘যাঁরা ভারতীয়, তাঁদের পুরো ভারতবর্ষের উপর অধিকার আছে। শুধু একটা অঞ্চলের উপর নয়।’’
বাঙালি ও বাংলা ভাষা নিয়ে বলতে গিয়ে চর্যাপদ সহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের মতামত প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক সেন স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘শুধু বাঙালি নয়, দেশের যে কোনও প্রান্তের মানুষ, অন্য প্রান্তে হেনস্তা হলে তা আপত্তিকর।’’
বৃহস্পতিবার শান্তিনিকেতনে নিজের বাসভবন ‘প্রতীচী’তে এসেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। এবার তাঁর সঙ্গী হয়েছেন কন্যা নন্দনা দেবসেন। শান্তিনিকেতনে পৌঁছাতেই স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে সম্প্রতি দেশের নানা প্রান্তে যেভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে, নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখানোর নামে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে, ‘পুশব্যাক’র নামে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ারও নজির তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘‘শুধু বাঙালি নয়, ভারতবর্ষ একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ঐক্যবদ্ধ দেশ। এখানে কোনও অঞ্চলের লোক অন্য জায়গায় হেনস্তা হচ্ছেন, এটার আপত্তির কারণ থাকবে। সে বাঙালি হোক বা পাঞ্জাবি হোক বা মাড়োয়ারী, আপত্তি করার কারণ থাকবে। প্রথম কথা হলো সব মানুষকে সম্মান দেওয়া। যে কোনও ভারতীয়, যদি একজন ওডিশা থেকে গিয়ে রাজস্থানে অবহেলিত হন বা অত্যাচারিত হন, তা নিয়েও আমাদের একই আপত্তির কারণ থাকবে। এটা আলোচনার বিষয় নয়, এটা আমাদের সংবিধানে প্রথম থেকেই বলা আছে।’’
ভারতীয় সংবিধানের উল্লেখ করেই ভারতবর্ষের মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। নাম না করেই কেন্দ্রের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, সংবিধান, মানুষের অধিকারকে পদদলিত করার বিরুদ্ধেই তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অমর্ত্য সেন। দেশের মানুষ, তার ভাষার অধিকার সম্পর্কে পরোক্ষে কেন্দ্রের সরকারের দিকে বারবার সমালোচনা তির ছুঁড়েছেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেছেন, ‘‘যারা যে ভাষায় কথা বলেন, তারা সেই ভাষায় কথা বলার সুযোগ পাবেন। তাদের বক্তব্য নিয়ে ঝগড়া করার প্রয়োজন হবে না এটাই আমাদের আশা।’’
বুঝতে অসুবিধা নেই, বাংলা ভাষায় কথা বলা গরিব শ্রমজীবী মানুষকে পরিকল্পিত নিশানা করার যে অসংখ্য উদাহরণ মাত্র কয়েকদিনে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি রেখেছে, তার দিকে ইঙ্গিত করেই মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। সেই সাথে বাংলার ঐতিহ্য ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে তিনি আরও বলেছেন, ‘‘বাংলা ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন শতাব্দী থেকে চর্যাপদ দিয়ে যে ভাষাটার জন্ম হলো, সেই ভাষার মূল্য স্বীকার করতেই হবে। তার মধ্যে নানা কাব্য হলো, লেখা হলো, তারমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ওনাদের বক্তব্য আমাদের সামনে খুব স্পষ্টভাবে ধরা হলো। এগুলোর আমাদের মূল্য দিতেই হবে। সেই মূল্যগুলোর প্রয়োজন যখন অবহেলিত হয়, একটা ভাষার যে মূল্য পাওয়া উচিত সে মূল্য যখন পায় না, তাদের উপর যখন একটা বড় রকম অবহেলা হয়, সেটা নিশ্চয়ই বন্ধ করতে হবে।’’
Comments :0