রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই, সম্প্রচারকারীর ক্যামেরাম্যান ফ্রেম ধরলেন ইস্টবেঙ্গলের ডাগআউটে। মোহনবাগানকে ছিটকে দিয়ে, শেষ চারের টিকিট নিশ্চিত হওয়ার আনন্দে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুঁড়লেন ইস্টবেঙ্গল কোচ অস্কার ব্রুজো। তারপরই স্বস্তির আলিঙ্গন বিনো জর্জকে। তিনিও অস্কারের মতোই আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাতিয়ে দিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের। গ্যালারিতে বাঁধনহারা ইস্টবেঙ্গল জনতা। দেদার নাচের সঙ্গে জয় ইস্টবেঙ্গল...জয় ইস্টবেঙ্গল...ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল তাঁদের মুখে।
ডাগআউটে সহকারীরা ও গ্যালারিতে সমর্থকরা আনন্দে মাতলেও, খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠের মধ্যে দু’দলের ফুটবলাররা হাতাহাতি জড়িয়ে পড়েন। যদিও সেই ঝামেলা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। হতাশ-বিষন্ন মুখে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেন শুভাশিস বসু, দিমিত্রি পেত্রাটোসরা। নির্বিকার হোসে মোলিনা। বড় ম্যাচ না হারলেও, সুপার কাপ থেকে ছিটকে গিয়ে মন খারাপ নিয়ে মাঠ ছাড়লেন বাগান সমর্থকরা। অন্যদিকে, মিগুয়েল ফিগুয়েরা, কেভিন সিবিল্লে, আনোয়ার আলি সহ অস্কার ব্রুজো, গ্যালারির সামনে গিয়ে অভিবাদন জানিয়ে এলেন সমর্থকদের।
সুপার কাপে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করতে হলে, জিততেই হতো মোহনবাগান সুপার জায়ান্টকে। আর ইস্টবেঙ্গলকে ড্র করলেই চলত। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের খেলাতেই ছিল জেতার তাগিদ। গোলের নিচে বিশাল কাইথ না থাকলে, ক্রসবার বাঁধা হয়ে না দাঁড়ালে, ম্যাচের সবচেয়ে সহজ সুযোগ হামিদ আহদাদ নষ্ট না করলে অন্তত ০-৩ গোলে হারতো ভারত সেরা মোহনবাগান। নব্বই মিনিট ধরে মোহনবাগান যে ফুটবলটা খেলল, তাতে তাঁদের জেতার পরিকল্পনা আদৌ ছিল কী না বোঝা গেল না! গোল লক্ষ্য করে মাত্র একটা নিয়েছেন পালতোলা নৌকার সওয়ারিরা। ভাবা যায়!
ফতোরদার মাঠের যা অবস্থা, কোনও দলের পক্ষেই ভালো ফুটবল খেলা সম্ভব নয়। কিন্তু তা বলে, জেতার তাগিদ থাকবে না? এক বছরের মধ্যে দু’দলের ফারাক অনেকখানি। এই বাগানকে চেনাই যাচ্ছে না। জেতার ইচ্ছে, গোল করা ক্ষুধা কোনোটাই নেই। ফিটনেসও তলানিতে। বরঞ্চ, চলতি মরশুমে ইস্টবেঙ্গল অনেক বদলে গিয়েছে। জেতার তাগিদ বেড়েছে। চোখে চোখ রেখে লড়াই করছে। গত দু’তিনটি মরশুমে ইস্টবেঙ্গলের মতো অবস্থা এখন মোহনবাগানের। ফলাফল, শেষ তিনটি ডার্বিতে দাপট দেখিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। আইএফএ শিল্ড ফাইনালে টাইব্রেকারে ইস্টবেঙ্গল হারলেও, ১২০ মিনিট মোহনবাগানের তুলনায় ভালো খেলেছিল বিপিনরা। মোলিনা রক্ষণাত্মক রণনীতি ডুবিয়ে দিল বাগানকে। ডুরান্ডের পর সুপার কাপে ব্যর্থ হওয়ায়, সামাজিক মাধ্যমে, মোলিনাকে কাঠগড়ায় তুললেন মোহনবাগান সমর্থকরা।
এদিন প্রথম একাদশ অপরিবর্তিত রাখেন অস্কার। লিস্টন, মনবীর, আলবার্তো, শুভাশিস, আপুইয়া, অনিরুদ্ধ, ম্যাকলারেনদের ফেরান মোলিনা। প্রথমার্ধে দাপট ইস্টবেঙ্গলের। মোহনবাগানের মাঝমাঠকে খেলতে দিলেন না সাউল ক্রেসপো, রশিদরা। নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পেরেছে ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচের ৬ মিনিটে ডানপ্রান্ত দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন মহেশ, বাধাপ্রাপ্ত হলে পেনাল্টি আবেদন করেন। রেফারি সাড়া দেননি। মিগুয়েলের ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তাঁর গোলমুখী শট, আলবার্তোর হাতে লেগে প্রতিহত হওয়ায়, লাইন্সম্যানের কাছে তিনি পেনাল্টির আবেদন করলেও লাভ হয়নি। ২৪ মিনিটে এগিয়ে যেতে পারত ইস্টবেঙ্গল। মিগুয়েলের সেন্টারে হেড করেন বিপিন সিং, তাঁর প্রচেষ্টা ক্রস বারে লেগে প্রতিহত হয়। ২৮ মিনিটে মহেশের প্রচেষ্টা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৪১ মিনিটে লিস্টনের পাস থেকে আপুইয়ার শট সহজেই তালুবন্দি করেন গিল। এই ডার্বিতেও নিস্প্রভ ম্যাকলারেন। প্রথমার্ধে তাঁকে দু’বার অফসাইডের ফাঁদে ফেললেন আনোয়ার-কেভিন সিবিল্লে জুটি।
দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ায় মোহনবাগান। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো গতি-ছন্দ কোনোটাই ছিল না বাগানের আক্রমণে। ম্যাচের ৬০ মিনিটে সহজ সুযোগ মিস করেন হামিদ। সোজাসুজি বিশালের হাতেই শট মারলেন তিনি। ৭৭ মিনিটে রবসন, পেত্রাটোসদের নামিয়ে দেন মোলিনা। তাতে সুযোগ তৈরি হলো। খেলায় ছন্দ এল। সেই ভেদশক্তির অভাবেই ভুগল বাগান। হামিদের পরিবর্তে নামা হিরোশী নায়ক হয়ে যেতে পারতেন! তাঁর গতি এতটাই মন্থর, বক্সে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ট্যাকেল করে বিপদ মুক্ত করেন আলবার্তো। ম্যাচের সংযুক্তি সময়ে,ইস্টবেঙ্গলের অর্ধে চাপের পরিস্থিতি তৈরি হলেও, স্নায়ুর চাপ সামলে বাজিমাত করেন জয় গুপ্তারা। সেমিফাইনালে লাল হলুদ মুখোমুখি হবে গ্রুপ ‘সি’র চ্যাম্পিয়নদের।
ইস্টবেঙ্গল: প্রভসুখন গিল (গোলরক্ষক), জয় গুপ্তা, আনোয়ার, কেভিন, রাকিপ, রশিদ, সাউল (সৌভিক), মিগুয়েল, বিপিন (বিষ্ণু), মহেশ (এডমুন্ড), হামিদ (হিরোশী)
মোহনবাগান: বিশাল কাইথ (গোলরক্ষক), শুভাশিস (সুহেল), আলবার্তো, টম, মেহতাব, আপুইয়া, অনিরুদ্ধ (টাংরি), লিস্টন (রবসন), সাহাল (কামিন্স), মনবীর (পেত্রাটোস), ম্যাকলারেন
Derby
অমীমাংসিত বড় ম্যাচ, শেষ চারে ইস্টবেঙ্গল সুপার কাপ থেকে বিদায় মোহনবাগানের
×
Comments :0