Post Editorial

উচ্ছেদ নয়, হকারদের লাইসেন্স দাও

রাজ্য

অসিতাঙ্গ গঙ্গোপাধ্যায়
এক নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে আমাদের রাজ্যের হকাররা। যেমন কষ্টের মধ্যে রয়েছে অন্য শ্রমজীবী, গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষ। হকারদের কাজ করার (অতি ক্ষুদ্র ব্যবসা) কোনও প্রশাসনিক স্বীকৃতি বা লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট অব ভেন্ডিং নেই। প্রতি মুহূর্তে আছে উচ্ছেদের আশঙ্কা। আর পুলিশ, সমাজবিরোধী, তৃণমূলের কাউন্সিলর ও গুন্ডাবাহিনীর জুলুম। আছে, যার থেকে মাল নিয়ে এসে হকাররা বিক্রি করে সেই মহাজনের হুমকি, শাসানি। আবার বিক্রি-বাটার অবস্থাও ভালো নয়। গ্রামে রেগার কাজ নেই, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মজুরি বা আয় বৃদ্ধি নেই, হাতে সেভাবে পয়সা না থাকা এই মানুষরাই হকারদের ক্রেতা, এর প্রভাব পড়ছে হকারদের কেনা-বেচায়। তার সঙ্গে খাবারের জিনিস সহ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জি‍‌নিসের ভয়ঙ্কর দাম। বাড়িতে কেউ অসুস্থ থাকলে তার চিকিৎসার খরচ বেড়ে গেছে, পরিবারে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা-পড়ার খরচ বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া বাড়ছে—  যাবে কোথায় গরিব হকাররা। কোনোমতে সংসার চালানোই আজ মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই গরিব হকারদের পাশে থাকার জন্য না আছে রাজ্যের সরকার, না আছে কেন্দ্রের সরকার। গত বছর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের শহরাঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণভাবে ভোট কমেছিল। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে হকার উচ্ছেদ করে শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে হারানো জমি ফিরে পেতে হবে। শুরু হলো ২৭ জুন ’২৪ থেকে রাজ্যজুড়ে রুলডোজার দিয়ে নির্বিচারে, অমানবিক হকার উচ্ছেদ। কলকাতা থেকে শুরু হয়ে রাজ্যের সব জেলা সদর হয়ে ছড়িয়ে পড়ল প্রায় সব পৌর অঞ্চলে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গঞ্জ হয়ে ওঠা পঞ্চায়েত অঞ্চলও বাদ থাকল না। কলকাতা কর্পোরেশন ’২৩-’২৪ আর্থিক বছরে হাজার দেড়েক হকারকে লাইসেন্স (সার্টিফিকেট অব ভেন্ডিং) দিয়েছিল। যদিও আজ পর্যন্ত তা রিনিউ করেনি। সেইরকম লাইসেন্সপ্রাপ্ত হকারদেরও উচ্ছেদ করেছিল। রাজ্যজুড়ে এই নির্বিচার হকার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সাধ্যমতো লড়াই হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত সহ, হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হকাররা জীবিকা হারিয়েছে। উচ্ছেদ প্রতিরোধেও কয়েকটি উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি হয়েছে। রামপুরহাটে সিপিআই(এম) পৌর প্রতিনিধি বুলডোজারের সামনে হকারদের নিয়ে দাঁড়িয়ে তা রুখে দিয়েছিল। কলকাতার রাজাবাজারে সিআইটিইউ অনুমদিত কলকাতা স্ট্রিট হকার্স ইউনিয়নের কর্মীরা বুলডোজার ফেরত পাঠাতে প্রশাসনকে বাধ্য করেছিল। রাজ্যের আরও কিছু জায়গায় এমন প্রতিরোধ হয়েছিল।
হাওড়ার মঙ্গলাহাট নিয়ে কোভিড পরিস্থিতির পরে এবং একটি আগুন লাগাকে কেন্দ্র করে সমগ্র মঙ্গলাহাটকে, কথিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাটকে ঐ চত্বর থেকে চিরতরে হটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল রাজ্য সরকার। ওখানেও সিআইটিইউ অনুমোদিত হাওড়া জেলা হকার সমিতির লড়াই সেই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করেছে। বামফ্রন্ট সরকারের পরিকল্পনায় হুগলী রিভার ব্রিজ কমিশনার মঙ্গলাহাটের ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকারদের জন্য যে চোদ্দতলা বাড়ি তৈরি করেছিল তা ঐ উপভোক্তাদের না দিয়ে তার চোদ্দতলায় বসেই মমতা ব্যানার্জি ষড়যন্ত্র করছে এই উপভোক্তাদের রুজিরুটি কেড়ে নেওয়ার।
হকারদের পেশাকে যদি সুরক্ষিত রাখতে হয় তাহলে কেন্দ্রীয় হকার আইন ২০১৪ বা ‘স্ট্রিট ভেন্ডারস (প্রোটেকশন অব লাইভলিহুড অ্যা ন্ড রেগুলেশন অব স্ট্রিট ভেন্ডিং) অ্যাক্ট ২০১৪’ জানুয়ারী ভেন্ডিং কমিটি তৈরি করতে হবে। মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল রাজ্য সরকার এগারো বছর পার হয়ে গেল সেই কাজ আইন নির্দেশিত ভাবে করেনি। এই কাজ করলে পৌর‍‌ ক্ষেত্র অনুযায়ী হকারদের তালিকা তৈরি হবে, তার ভিত্তিতে হকাররা লাইসেন্স পাবে, ভেন্ডিং জোন, ভেন্ডিং টাইম ঠিক হবে। এই ভেন্ডিং কমিটিতে চল্লিশ শতাংশ হকার প্রতিনিধি থাকার কথা। ফলে এতে একদিকে হকারদের জীবন-জীবিকা যেমন সুরক্ষিত হবে তেমনি হকাররা নিয়ন্ত্রিতও হবে। এতে হকারদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও উপকৃত হবে। যানবাহনে গতি বাড়বে, দুর্ঘটনা কমবে, পরিবেশ দূষণ কমবে। কেন্দ্রীয় হকার আইন ২০১৪ রাজ্যে সঠিকভাবে কার্যকরী না করে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলের সরকার শুধু হকারদের ক্ষতি করেনি, সাধারণ মানুষেরও ক্ষতি করেছে।
গরিব হকারদের পুঁজি বলতে প্রায় কিছুই নেই। মহাজনের থেকে ধারে জিনিস এনে ‍‌বিক্রি করে একদিকে ধার মেটায় অন্যদিকে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। কোভিডের তিন বছরের ধাক্কায় যেটুকু ছিল সেই পুঁজি-পাটাও সব শেষ। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রী বড়লোক শিল্পপতিদের অনেক প্রকল্প ঘোষণা করেছিল কিন্তু গরিব হকার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্পকে বাঁচানোর জন্য প্রায় কোনও প্রকল্পের ঘোষণাই ছিল না। হকারদের ক্ষেত্রে জুটেছিল প্রাথমিক ভাবে দশ হাজার টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ। যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও আর্থিক সহায়তাই প্রায় ছিল না। ব্যাঙ্কের টাকা তো মানুষের টাকা তার থেকে ঋণ। সেই ঋণও এ রাজ্যের হকাররা পাচ্ছিল না। কারণ ঋণের শর্তের মধ্যে ছিল আঞ্চলিক সরকারের থেকে একটি সুপারিশ পত্র আনতে হবে (লেটার অব রেকমেন্ডেশন)। সেটা কোনও পৌর প্রশাসন দিচ্ছিল না, তাই হকাররা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ব্যাঙ্ক ঋণ পাচ্ছিল না। প্রায় দু’বছর পর কলকাতা পৌর সংস্থা এই এলওআর দেওয়া শুরু করে। হকাররাও ঋণ নিতে শুরু করে। এব্যাপারে ব্যাঙ্কের খানিকটা অহসযোগিতা আজও রয়ে গেছে। এবং সারা রাজ্যের সব পৌর ও পঞ্চায়েত প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই এলওআর দেওয়ার সহজ ব্যবস্থা আজও শুরু হয়নি। গরিব হকারদের জন্য ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে করে দিতে হবে, এ লড়াই আজকের হকার আন্দোলনের একটা অন্যতম লড়াই হিসাবে থেকে গেছে।
লাইসেন্সের জন্য, উচ্ছেদের বিরুদ্ধে, পুনর্বাসনের পক্ষে, আইন অনুযায়ী ভেন্ডিং কমিটি চেয়ে এক ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে রাজ্যের সিআইটিইউ অনুমোদিত হকার সংগঠনগুলো আছে। রাস্তার আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে আইনি লড়াইও লড়তে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ স্ট্রিট হকার্স ফেডারেশন অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর অনুমোদিত বামপন্থী হকার সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে ‘হকার যৌথ মঞ্চ’-এর পক্ষ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা লড়ে জিতেছে। অতীতে কলকাতার ইউনিয়ন এবং আজকে কলকাতা ও পূর্ব মেদিনীপুরের হকার ইউনিয়ন হাইকোর্টে মামলা লড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গ স্ট্রিট হকার্স ফেডারেশনকে সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটি গড়ে তুলেছিল ২০১৪ সালে। আটটি জেলার হকার ইউনিয়নগুলো এই রাজ্য ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজ ২০টি জেলার জেলাগত ও অঞ্চলগত হকার ইউনিয়নগুলো এই ফেডারেশনের মঞ্চকে শক্তিশালী করেছে। ফেডারেশন গত এগারো বছর ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে আছে। হকার জীবিকার অন্যান্য দাবির পাশাপাশি ‘কেন্দ্রীয় হকার আইন ২০১৪’ এরাজ্যে লাগু করতে হবে এটাই ছিল প্রধান দাবি। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ দাবিগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ‘রাজ্যের সব হকারকে লাইসেন্স দিতে হবে’ —এই দাবিকে প্রধান দাবি করে ৫দফা দাবিতে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। দাবিগুলো: ১) সব হকারকে লাইসেন্স দিতে হবে। ২) হকার উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে। ৩) উচ্ছেদ হওয়া হকারদের পুনর্বাসন দিতে হবে। ৪) কেন্দ্রীয় হকার আইন মেনে ভেন্ডিং কমিটি তৈরী করতে হবে। ৫) হকারদের ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এই দাবিগুলোর সপক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দেওয়ার জন্য হাজার হাজার হকারের স্বাক্ষর সংগ্রহ চলছে। আগামী ২০ নভেম্বর কলকাতায় বিভিন্ন জেলা থেকে কয়েক হাজার হকার সমবেত হবে। ঐদিন মুখ্যমন্ত্রীর সময় চেয়ে তার কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। কলকাতার বড়বাজার (ব্রাবোর্ন রোড প্রিপলপট্টি) ও পার্ক স্ট্রিট মোড় (নেলসন মেন্ডেলা পার্ক) থেকে দুটি সুসজ্জিত সোচ্চার মিছিল শুরু হবে। রাজ্যের নগরোন্নয়ন ও পৌর বিষয়ক (হকার সম্পর্কিত সহ) মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়রকেও ডেপুটেশন দেওয়ার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
আগামী ২০ নভেম্বর ’২৫, মহানগরী কলকাতার প্রাণচঞ্চল মধ্যাংশ দেখবে রাজ্যের কয়েক হাজার হকার আবারও পথে নেমেছে। হকার মহামিছিল সোচ্চারে আওয়াজ তুলবে ‘সব হকারকে লাইসেন্স দাও’, ৭৮ বছরের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে ‘আমাদেরও খেয়ে-পরে বাঁচতে দাও।’

 

 

Comments :0

Login to leave a comment