Editorial

লোক দেখানো ভাষা আন্দোলন

সম্পাদকীয় বিভাগ

দু’-চারদিন কড়া ভাষায় বিবৃতি, কয়েকটি সভায় গরম গরম বক্তৃতা, মিছিলে দু’পা হেঁটে হুঙ্কার। ব্যস, এ পর্যন্তই। তারপর মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর ভাইপোর নেতৃত্বে  বহুল প্রচারিত ভাষা আন্দোলনের যবনিকা পতন। পরিস্থিতির চাপে ঠেকায় পড়ে এমন লোক দেখানো আন্দোলন মাঝে মধ্যে করতেই হয়। তা নাহলে বিরোধীদের আক্রমণের মুখে জবাব দেবার মতো কিছু থাকে না।
বাংলায় বিশেষ করে বাংলাভাষীদের কাছে ‘ভাষা আন্দোলন’ শব্দবন্ধের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। মাতৃভাষা বাংলার অধিকার ও মর্যাদার দা‍‌বিতে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের গোড়ায়  তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাড়া জাগানো ভাষা  আন্দোলন, পরবর্তীকালে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার  মর্যাদার দাবিতে  আন্দোলন আজও বাঙালি তথা বাংলাভাষী‍‌দের  ভাষা চেতনার ঐতিহাসিক পুঁজি। তাই ভাষা আন্দোলন শুধু স্পর্শকাতর নয়, ভীষণভাবে আবেগঘনও। সেই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের আবেগ ও চেতনা‍‌কে নিয়ে ক’দিনের হুল্লোড়বাজি হয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে বি‍‌জেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এরাজ্যের পরিযায়ীদের ওপর পুলিশ বাড়াবাড়ি রকমের নির্যাতন চালাচ্ছে। তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের আটক করে সীমান্তের ওপারে পাঠানোর নামে পাইকারি হারে বাংলায়  কথা বলা পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের লোকজনদের তুলে নিয়ে গিয়ে যথেচ্ছ অত্যাচার চালাচ্ছে বি‍‌জেপি সরকারের পুলিশ। এরাজ্যের মানুষকে জোর করে বাংলাদেশি প্রমাণের জন্য মারধর করছে, নানাভাবে হয়রান করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জোর করে সীমান্তের ওপারে বের করে দেওয়া হয়ে‍‌ছে। কয়েকজনকে আবার ফিরিয়ে আনতে বাধ্যও হয়েছে।
এইভাবে শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার অপরাধে পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষী মানুষের ওপর এমন অত্যাচার-নির্যাতন  প্রবল ক্ষোভ ‍‌‍‌তৈরি হয়েছে। তার প্রতিফল ঘটছে প্রতিবাদ আন্দোলনের।  ঠেকায় পড়ে  শাসক তৃণমূলও বাধ্য হয়েছে  প্রতিবাদে গর্জে উঠতে ও কিছু  প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে। তারপরই যথারীতি  সব ভোঁ-ভাঁ। ভারতের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে অধিকার দিয়েছে দেশের যে কোনও জায়গায় যেতে, বাস করতে, কাজ করতে, এমনকি জমি কিনতেও। ভাষা যা-ই হোক না কেন, সরকার যে দলেরই হোক না কেন কারও অধিকার নেই প্রশ্ন তোলার। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি সংবিধানকে অবমাননা করে সংবিধানের বিরুদ্ধে কাজ করছে। মুখ্যমন্ত্রী কলকাতায় বিবৃতি দিয়ে আর মিছিল করে দায় এড়িয়েছেন। কোনও কড়া পদক্ষেপ নেননি। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কড়া চিঠি পাঠাতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দরবার করতে পারতেন। যেতে পারতেন সুপ্রিম কোর্টেও। কিছুই করেননি। আরএসএস দুর্গার পক্ষে আরএসএস-বিজেপি-কে বিব্রত করতে চাননি। বাংলা পরিযায়ীদের উপর কট্টর হিন্দুত্ববাদী অত্যাচারকে আস্তে আস্তে হজম করে নিয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা বুঝে গেছে এই রাজ্য সরকারের কোমরের জোর নেই। তাই এ রাজ্যের বুকে বাংলাভাষী ছাত্রদের ওপর হামলা চালাবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় এই ঘটনায় যখন পুলিশের স্বতঃপ্রণোদিত এফআইআর করার কথা তখন ছাত্ররা মার খেয়ে সারারাত থানার সামনে অবস্থান করে পুলিশকে বাধ্য করতে হয়েছে ডায়েরি করতে। কোনও ওপরওয়ালার নির্দেশে পুলিশের এমন নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা! হিন্দুত্ববাদীদের বেশি না ঘাটিয়ে তুষ্টু রাখার জন্যই কি পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে। এরপর তো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে পরিযায়ী যন্ত্রণায় সরকারের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানপন্থীদের বাংলা বিদ্বেষেও সরকারের কিছু যায় আসে না।

Comments :0

Login to leave a comment