পীযূষ ব্যানার্জি: বর্ধমান
৭ নভেম্বর— ঘুম তাড়ানির গান শুনলো উৎসব ময়দানের মাটি।
এ জেলার এমন কোনও তল্লাট নেই যেখানে ঝরেনি কৃষকের রক্ত। এখানকার মাটি ভিজেছে শহীদের রক্তে। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে ক্যানেল কর রোখার লড়াই, কখনও আবার জমির আন্দোলন থেকে গ্রামীণ জোতদার-মহাজনদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে এই মাটি। ঘুম ভাঙানির গান শুনিয়ে এই মাটিতেই কৃষককে জাগিয়ে তুলেছিলেন কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার, কমরেড বিনয় চৌধুরিরা।
সেই মাটি কি ফের জাগছে? তেমন ইঙ্গিতই স্পষ্ট হলো উৎসব ময়দানে।
মাঠে তখন বিক্ষিপ্তভাবে জড়ো হওয়া মানুষের সামনে গান শোনাচ্ছিলেন লোকশিল্পীরা। বেলা তখন দু’টো বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ময়দানের মূল ফটক দিয়ে প্রথম একটি লাল পতাকার মিছিল এসে ঢুকলো সমাবেশ ময়দানে। সেই শুরু। ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় আদিবাসীদের চিরাচরিত পোশাকে, ধামসার বোলে মাঠের দ্বিতীয় গেট ধরে আসা পরের মিছিলেই ভর্তি মাঠ। তারপর থেকে একের পর এক মিছিলে উপচে পড়েছে ময়দান।
লোকশিল্পীদের গণনাট্য সঙ্ঘের গানের অনুষ্ঠান শেষে ঠিক সাড়ে তিনটেয় শুরু হয়ে যায় সমাবেশের মূল কাজ। তখনও আসছে কৃষক মিছিল। বক্তৃতার ফাঁকে বক্তাকে বারেবারেই জানাতে হয়েছে, ‘‘মিছিল ঢুকছে। আরও মিছিল ঢুকবে। মিছিল ঢোকার জায়গা করে দিন। না হলে, মিছিল রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে যাবে।’’ কিন্তু মানুষ আর এঁটে উঠতে পারছে না উৎসব ময়দান। কানায় কানায় ভর্তি কৃষক সমাবেশ যখন বক্তৃতার মাঝখানে, তখনও ময়দান ছাড়িয়ে মাঠের দূরপ্রান্ত থেকে শোনা যাচ্ছে ধামসার আওয়াজ। সেই মিছিল আর মাঠে ঢুকতে পারেনি।
ঘুম ভাঙানিয়া এই সমাবেশে এসেছিলেন খণ্ডঘোষের আরিন গ্রামের কৃষক হরিসাধন মালিক। ১৪ বিঘা জমিতে খাস ধান চাষ করেছিলেন। ধান উঠলে উন্নতমানের গোবিন্দভোগ চাল রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তাঁর জমি থেকে এবার আর ধান উঠবে না। বিঘাতে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সমবায় থেকে শুরু করে মহাজন, সার-কীটনাশকের দোকান মিলিয়ে ২লাখ টাকা ঋণ। যেখানে বিঘাতে ১০ বস্তা ধান মিলতো, এবার দু’বস্তাও মিলবে না বলেই তাঁর আশঙ্কা। ‘‘অগ্রহায়ণ মাসের ৮-১০ তারিখ থেকে ধান কাটা হয়। কিন্তু ধান তো শুয়ে আছে মাটিতে। তার ওপর দিয়ে এখনও জল বইছে। দু’বস্তা পাবো কি না জানি না।’’ বিপুল যেখানে ক্ষতি, সেখানে রাজ্যের কৃষকবন্ধু প্রকল্পে বছরে ৫ হাজার করে দু’বারে অনুদান মাত্র ১০ হাজার টাকা! আর মোদী সরকারের কাছ থেকে পিএম-কিষান থেকে অনুদান আসে এককালীন ৬ হাজার টাকা! রায়না-খণ্ডঘোষের মতো এলাকার সব কৃষক এখন জড়িয়ে গেছেন ঋণজালে।
কৃষক কি তাহলে এইভাবেই মরবে? এইভাবেই মার খাবে? মাঠভর্তি জনতার কাছে প্রশ্ন করেছিলেন সারা ভারত কৃষকসভার নেতা হান্নান মোল্লা। ‘‘লোকে বলে, কৃষকরা ঋণ নিয়ে জন্মায়, ঋণ নিয়ে বাঁচে। আর ঋণ নিয়ে মরে। যখন চাষ করে তখন সার বীজ কীটনাশক সব বেশি দামে কিনতে হবে। আর যখন ফসল উঠবে তখন তার দাম থাকবে না। লোকসান করে কতদিন বাঁচা যায়? সরকার কোন ঋণ দেয় না কৃষকদের। ফলে তারা ঋণের ভারে জর্জরিত। কেন কৃষকদের একবার হলেও ঋণ মকুব হবে না?’’ বলেছেন হান্নান মোল্লা।
এই প্রবীণ নেতার মুখেই সারা মাঠ এদিন শুনেছে দিল্লির বুকে কৃষকদের ৩৮৪দিনের একটানা লড়াইয়ের কথা। কৃষকের লড়াইয়ে কিভাবে মোদী সরকার বাধ্য হয়েছে তিন কালা কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। কিন্তু তারপর পাঁচ বছর পার হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখনও কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করার সময় পাননি। আগামী ২৭ নভেম্বর দিল্লির কৃষক আন্দোলনের পাঁচ বছর পূর্ণ হবে জানিয়ে হান্নান মোল্লা সমাবেশকে বলেছেন, ‘‘৭৩২ জন কৃষকের আত্মত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী চিঠি দিয়ে আমাদের সঙ্গে বসতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী চিঠি দিলে বিশ্বাস করবেন না? কিন্তু পাঁচ বছর পার হয়ে গেল, এখনও উনি সময় পাননি! এমন বিশ্বাসঘাতক প্রধানমন্ত্রী এর আগে দেশে কখনও আসেনি।’’
কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় কম যান না এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও। সেটাই সমাবেশকে বলছিলেন সারা ভারত কৃষকসভার সাধারণ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণানও। ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল আর ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি, দু’টি দল মিলেই বাংলা আর ভারতের মানুষকে লুট করে যাচ্ছে। চলতি এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ১ লক্ষ কৃষক আর খেতমজুর আত্মঘাতী হয়েছেন। তার মধ্যে ১২ টি রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যা শূন্য! সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গও আছে! যে রাজ্যে ফসলের দাম না পেয়ে আলুচাষি, ধানচাষি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কি করে এমন মিথ্যা কথা বলতে পারেন!
এ রাজ্যে কৃষক বাড়ির সন্তান এখন কাজের সন্ধানে দলে দলে ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছে। সেই প্রসঙ্গে বিজু কৃষ্ণান জানান, ‘‘আমি কেরালা থেকে আপনাদের কাছে এসেছি। কেরালায় আমার গ্রামে মালদহ, মুর্শিদাবাদের সব ছেলেরা নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে যান। কেরালায় মজুরি বেশি। আর এরাজ্যে শিল্প নেই, কাজ নেই বলে ওঁরা জানায়।’’
কৃষক কি শুধুই মার খাবে? ফসলের দামে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। সংগঠনের ৩৮ তম সম্মেলন তাই কিভাবে বিকল্প পথ তৈরি করে লড়াইয়ের নতুন অভিমুখ গড়তে পারে তার দিশা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষকসভার সম্পাদক অমল হালদার। বলেছেন, ‘‘নতুন করে আবার জাগাতে হবে গ্রামকে। প্রত্যেক গ্রামের কৃষক, খেতমজুর, শ্রমিকদের নিয়ে বাঁধতে হবে জোট। না হলে কেউই বাঁচতে পারবে না।’’
ফসলের দাম না পাওয়া, ঋণজালে জর্জরিত কৃষক কৃষিপণ্য বিপণন করার অধিকারটুকুও হারাতে চলেছেন। বর্ধমানের জৌগ্রাম থেকে হুগলীর ডানকুনি পর্যন্ত জাতীয় সড়কের ওপর একাধিক জায়গায় আদানি গোষ্ঠী রাইসমিল থেকে কৃষিপণ্য গুদামজাত করার পরিকাঠামো তৈরি করেছে। নয়া এই বিপদের সামনে তাই ঘুম জাগানিয়া কৃষক আন্দোলন চাইছে কৃষকসভা। তাই তো সারা ভারত কৃষকসভার রাজ্য নেতা সৈয়দ হোসেন সমাবেশে আসা কৃষকদের কাছে বলেছেন, ‘‘মাটিতে নতুন আওয়াজ তৈরি হচ্ছে। এই আওয়াজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’
প্রকাশ্য সমাবেশের পরই এদিন বর্ধমান শহরের রবীন্দ্র ভবনে শুরু হয়েছে প্রতিনিধি অধিবেশন। ৩৮ তম সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিজু কৃষ্ণান। সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেছেন সম্পাদক অমল হালদার। পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষকসভার সভাপতি বিপ্লব মজুমদার সভাপতি হিসাবে পরিচালনা করছেন সম্মেলন। তাঁকে সহায়তা করছেন ভক্তরাম পান, আবু বক্কর, অসীমা রায়, মেঘলাল শেখ, আশিস সরকার ও মহম্মদ সেলিম গায়েন। এদিন প্রতিনিধি অধিবেশনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার।
Krishak Sabha Bardhaman
ফের জাগছে মাটি, শপথের সমাবেশে রণধ্বনি কৃষকের
×
Comments :0