দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। ১৯৪৬ এর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার স্মৃতি পুরোপুরি মুছে যায়নি। কিন্তু তার চেহারা ও প্রভাব আজ আলাদা একেবারেই। তা সত্ত্বেও এই ভারতই একটা ক্ষেত্রে আজও অন্য চেহারায় ধরা পড়ে। সেই চেহারা এক সদা হাস্যমুখ মানুষের। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর গণ্ডি টপকে মানুষটি পৌঁছে যান পাকিস্তানে। আবার ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশের বাঙালিরা এঁর গানে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। লন্ডনের সুরম্য অট্টালিকা থেকে বোম্বের ধারাভি বস্তি, টোকিও থেকে কলকাতার কোনও শান্ত বাঙালি পাড়া— সর্বত্র তাঁর গান চলে। তিনি মহম্মদ রফি।
১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর অবিভক্ত পাঞ্জাবের কোটা সুলতান শাহ গ্রামে জন্মেছিলেন মহম্মদ রফি। ১৯৪২ সালে শ্যামসুন্দরের সুরে গুল বালোচ ছায়াছবিতে তিনটি গান গেয়েছিলেন। প্রথম গান ছিল ‘সোনিয়ে নি/হেরিয়ে নি/ তেরে ইয়াদ নে আন সতায়া’। গানটি যদিও পরবর্তীকালে রফি আর কোনোদিনই খুঁজে পাননি। শুধু রফি কেন কেউই পাননি। পাওয়ার কথাও নয় বোধহয়।
১৯৪৩ সালে বোম্বে শহরে দ্বিতীয়বার আসেন রফি। প্রথমবার এসেছিলেন গান রেকর্ড করতে; গুল বালোচের। গ্রামের মেলায় দেখানো হচ্ছিল ফিল্মটি। সেখানে নিজের গান শুনে তাঁর মনে হয়েছিল হয়তো কিছু করা সম্ভব। তিনি যদিও ছোট থেকেই গান পাগল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সায়গলের প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। লাহোরে ব্রিটিশদের এক সরকারি অনুষ্ঠানে গান শোনাতে গিয়ে সমস্যা হয় কেএল সায়গলের। তখন কিশোর বয়সি রফি সেই মঞ্চে উঠে গান গেয়ে শান্ত করেন দর্শকদের। সায়গল প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে ‘শাহজাহান’ ফিল্মে ‘রুহি রুহি রুহি মেরে স্বপ্নোঁ কি রানি’ গানটিতে সায়গলের সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মহম্মদ রফি। এরপর ১৪ বছর বয়স থেকে আকাশবাণীর লাহোর কেন্দ্রে গান করেছিলেন তিনি। যাই হোক, বোম্বেতে বেশ কিছু ঘোরাঘুরির পর শ্যামসুন্দর তাঁকে ‘গাঁও কি গোরি – দ্য ভিলেজ গার্ল ’ ফিল্মে সুযোগ দিলেন গান করতে। আজি দিল হো কাবু মেঁ/ তে দিল দার কি অ্যায়সি কি ত্যায়সি’। যদিও সেই গান প্রকাশের আগেই প্রকাশিত হয় নওশাদের সুরে ‘হিন্দুস্তান কে হাম হ্যাঁয়/ হিন্দুস্তান হামারা/ হিন্দু মুসলিম দোনোঁ কে আখোঁ কা তারা’। ফলে কার্যত এটাই প্রথম প্রকাশিত রেকর্ড।
যদিও সবাই মনে করেন বৈজু বাওরা-র আগে রফি নাকি একেবারেই বিখ্যাত ছিলেন না, ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। মেলা (‘ইয়ে জিন্দেগি কে মেলে’), শহীদ (‘ওয়াতন কি রাহ মে’), জুগনু (‘ইয়াহাঁ বদলা ওয়াফা কা বেওয়াফাই কে’), ‘তেরা খিলৌনা টুটা’, বালক কিংবা অন্দাজ (‘বচপন কে দিন ভুলা না দেনা’) প্রভৃতি গান বিপুল জনপ্রিয় হয়। মহম্মদ রফির শুধু হিন্দি ফিল্মে প্রকাশিত গানের সংখ্যা বৈজু বাওরার আগে ছিল ২৫০-এর বেশি।
কত গান গেয়েছেন তিনি ? ছাব্বিশ হাজারের গল্পটা ভুয়ো। মেরে কেটে সাড়ে ছয় হাজার। সেটাই অনেক। ছাব্বিশটা ভাষায় গান গেয়েছেন। হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, মারাঠি, কোঙ্কনি, গুজরাটি, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, ছত্তিশগড়িয়া, ওড়িয়া, অসমীয়া, বাংলা, মৈথিলী, ভোজপুরী, অওধি, ব্রজভাষা— এই আঠারোটা ভারতীয় ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, ডাচ, মরিশাসের ভাষা, ক্রেওল, আরবি, ফারসি (দারি) ও সিংহলি— এই আটটা বিদেশি ভাষায়। এর মধ্যে ডাচ গানটি লাইভ রেকর্ড বলে অনেকে হিসাবের মধ্যে রাখেন না। নেপালি ভাষায় গান করেননি, কিন্তু একটি গানের প্রথম লাইন ছিল নেপালি (‘আজকো জুনলি রাতমা’)।
বাংলায় প্রথম গান ১৯৫৭। ‘ওই দূর দিগন্ত পারে’ আর ‘নাই বা পরিলে আজ মালা চন্দন’। কথা পবিত্র মিত্র, সুর বিনোদ চট্টোপাধ্যায়। গেয়েছেন নজরুলগীতি, কথা ছিল শ্যামাসঙ্গীত গাইবেন। হয়ে ওঠেনি। তবে শুধু বিনোদ চট্টোপাধ্যায় নন, গেয়েছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, বাসু-মনোহরির সুরেও (বাংলা)। শ্যামল মিত্রের সুরে অজস্র ধন্যবাদ ছবিতে গেয়েছেন। গেয়েছেন প্রহরী ছবিতে। এছাড়া ইন্দ্রাণী ছবিতে গেয়েছেন নচিকেতা ঘোষের সুরে (সভি কুছ লুটা কর)। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছেন বাংলা ছবি খেলাঘর ফিল্মে। একটি হলো ‘কহতি হ্যায় মুঝকো দুনিয়া’ এবং অন্যটি হলো ‘প্যারি বোলে বুলবুল’।
মহম্মদ রফির ইংরেজি গান দুটির একটি হল জনপ্রিয় ‘হাম কালে হ্যায় তো ক্যায়া হুয়া’ গানটির ইংরেজি সংস্করণ। অপরটি ‘বাহারোঁ ফুল বরসাও’ এর ইংরেজি। দু’টি গানেরই সুরকার শঙ্কর জয়কিষন। এর মধ্যে দ্বিতীয়টির কথা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। ‘Although we hail from different lands/We share one earth and sky and sun/Remember Friends the World is One’ অর্থাৎ ‘যদিও আমরা বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা/ আমাদের একটাই পৃথিবী, আকাশ এবং সূর্য / মনে রেখো বন্ধুগণ বিশ্ব কিন্তু একটাই’। গানটি লিখেছিলেন হরীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি। হ্যাঁ, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত বিজয়ওয়াড়া কেন্দ্র থেকে প্রথম লোকসভায় বিজয়ী নির্দল প্রার্থী, অভিনেতা, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ফিল্মের সিধু জ্যাঠা হরীন্দ্রনাথ। যিনি ‘লা মার্সেই’ গানের হিন্দি অনুবাদ করেন। যাঁর দাদা ভারতের প্রথম যুগের কমিউনিস্ট বিপ্লবী অবনী চ্যাটার্জি।
মান্না দের মতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রভাবিত গানে মহম্মদ রফি নিজস্ব অলঙ্কার প্রয়োগ করতেন আশ্চর্য দক্ষতায় এবং নিখুঁতভাবে। চলচ্চিত্রের নেপথ্য গায়নে গায়কী নিয়ে চরিত্র হয়ে ওঠাই হলো প্লেব্যাকে গায়কের কাজ। এই কাজটি একান্তভাবে মহম্মদ রফিরই অবদান। তাঁর গলার টেক্সচারে গীত এবং কাওয়ালির গায়কী যুক্ত হয়েছিল। এর সঙ্গে তাঁর উর্দু, হিন্দি এবং পাঞ্জাবি উচ্চারণশৈলী। তিনি গান শিখেছিলেন কিরানা ঘরানার আব্দুল ওয়াহিদ খান, জীবনলাল মাট্টু ও ফিরোজ নিজামীর কাছে।
সে ছিল এক অন্য ভারতবর্ষ। সেখানে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মানো লতা মঙ্গেশকর ইসলাম ধর্মাবলম্বী অভিনেত্রী মধুবালার জন্য গাইতেন ‘মোহে পনঘট পে নন্দলাল ছোড় গয়ো রে’। আর মহম্মদ রফি গাইতেন ইউসুফ ওরফে দিলীপকুমারের জন্য ‘মধুবন মে রাধিকা নাচেরে’। সেই গান লিখতেন শাকিল বদায়ুনী আর সুর দিতেন নৌশাদ। সেই অবস্থা ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে আসা ভারতের চেহারা আজ অন্যরকম। কিন্তু আজও ভারতের জনগণের মধ্যে মহম্মদ রফি ততটাই জনপ্রিয়, যতটা সেদিন ছিলেন।
কার জন্য গান করেননি? পৃথ্বীরাজ কাপুর থেকে মিঠুন চক্রবর্তী, উত্তম কুমার থেকে গোবিন্দা, সবারই লিপে তাঁর গান আছে। সেই শ্যামসুন্দর থেকে শুরু করে অনু মালিক পর্যন্ত প্রায় তিন প্রজন্মের সুরকারদের সুরে গেয়েছেন। যার মধ্যে লচ্ছীরাম, ধন্নীরাম, জি এস কোহলি বা গণেশের মতো অধুনা বিস্মৃত সুরকার থেকে শুরু করে নৌশাদ, সলিল চৌধুরি, শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর-জয়কিষন, জয়দেব, বসন্ত দেশাই, কল্যাণজী-আনন্দজী, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, রাহুল দেববর্মণ, বাপ্পি লাহিড়ি সবাই আছেন।
গায়িকাদের মধ্যে শুধু লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গেই আছে ৪৫৯টি গান (৩টি গুজরাটি ও ৭টি পাঞ্জাবি সহ)। সেই নূরজাহান থেকে শুরু করে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁশলে, গীতা দত্ত, শামশাদ বেগম এমনকি অনুরাধা পড়োয়ালের সঙ্গেও গান গেয়েছেন।
অভিনেতাদের মধ্যে রাজ, শাম্মী, শশী তিনভাই, তাঁদের বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুরের কথা তো আগেই বলেছি। পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম হিসাবে অভিনয়ে আশা রণবীর এবং ঋষির জন্যেও রফি প্লে-ব্যাক করেছিলেন। এছাড়া বাংলার, বিশ্বজিৎ, অসিতবরণ সহ উত্তমকুমারের জন্যেও করেছেন। অজস্র নাম না জানা অভিনেতা, যাঁরা একটা বা দু’টো সিন ছাড়া ফিল্মে খুব একটা সুযোগ পেতেন না, তাঁরাও মাঝে মাঝে গাইতেন রফির গান। হিরোর লিপে গানের পাশাপাশি চরিত্রাভিনেতা, বৃদ্ধ, ভিক্ষুক সকলের জন্য ব্যবহার হয়েছে তাঁর কন্ঠ।
একদিকে অজস্র দেশাত্মবোধক গান (আওয়াজ দো হাম এক হ্যায়) কিংবা গান্ধী- নেহরুকে নিয়ে লেখা একাধিক গান (শুনো শুনো অ্যাগয় দুনিয়াওয়ালোঁ, শুনো শুনাতে আজ তুমহে হাম, মেরে আওয়াজ শুনো), রাজনৈতিক প্রচারের গান (দো বৈলোঁকা জোড়া), অগুনতি রোমান্টিক গান (তেরে পাস আকে মেরা ওয়াক্ত গুজর জাতা হ্যায়), ধর্মীয় গান (মন তড়পত হরি দর্শন কো আজ, পরওয়ারদিগার-এ-আলম তেরা হি হ্যায় সাহারা), নজরুলগীতি (ব্রজগোপী খেলে হোরি, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে), ভিক্ষুকের কণ্ঠে গান (আদমি মুশাফির হ্যায়), পাশ্চাত্য ধর্মী গান (জান পেহচান হো), কন্যা বিদায়ের গান (বাবুল কি দুয়ায়েঁ লেতি যা, চলো রে ডোলি উঠাও কাহার)। অসমর্থিত এক সূত্র থেকে পাওয়া গবেষণা বলছে ৫১৭ রকম আলাদা আবেদনের গান গেয়েছেন তিনি।
ভারত ভাবনার প্রতীক রফির কণ্ঠে ধরা পড়ত সমগ্র দেশের ছায়া। সাধারণ শ্রমিক থেকে বড় শিল্পপতি সবাই তাঁর গানে আজও বুঁদ হয়ে থাকে। ২৩ বার ফিল্ম ফেয়ারে মনোনয়ন পেয়ে ৬বার পুরস্কার জিতেছেন। তবে এই পুরস্কার দিয়ে তাঁকে ধরা যায় না। তাঁকে বুঝতে গেলে বুঝতে হবে সেই জাদুকে যে জাদুতে ৮ বার আলাদা রকম ভাবে গেয়েছিলেন ‘তারিফ করুঁ ক্যা উসকি’। ‘জানে ক্যা ঢুন্ডতে রহতি হ্যায়’ গানে ‘চিঙ্গারি হ্যায়’ শব্দ দুটি চারবার আলাদা রকম গেয়েছিলেন। ‘আঁচল হ্যায় ঢলা’ তিনি এমনভাবে বলেছিলেন যেন মনে হয়েছিল সত্যিই আঁচল ঢলে পড়ছে। ‘য়হ দেখ কে দিল ঝুমা’ লাইনের ঝুমা শব্দটির উচ্চারণ ছিল এমন যেন মা কোলে শিশুকে নিয়ে দোলা দিচ্ছে। ‘সুবহ জরুর আয়েগী/সুবহ কা ইন্তেজার কর’ লাইনটি প্রতিবার আলাদা গেয়েছে একেকটি অন্তরার চরিত্র অনুযায়ী। আর সেই অন্তরা তিনি নিজে গাননি। গেয়েছিলেন তালাত মেহমুদ।
মনে রাখতে হবে এই লোকটির গান ছাড়া রামনবমী পালন হয় না (‘রামজি কি নিকলি সওয়ারি’)। আবার মেহনতি মানুষের গানও এঁরই কণ্ঠে ধ্বনিত হয় (‘হম মেহনতওয়ালোঁ নে জব ভি মিলকর কদম বঢ়ায়া / সাগর নে রাস্তা ছোড়া পর্বত নে শিশ ঝুকায়া/ সাথি হাত বঢ়ানা)। পৃথীবীর সমস্ত স্বৈরাচারী শাসকের জন্যও তাঁর কণ্ঠ থেকে বার্তা শোনা গিয়েছে ততটাই আবেগে – ‘য়হ দুনিয়া নহীঁ/ জাগির কিসিকি/রাজা হো রঙ্ক য়হাঁপে সব হ্যায় ঠেকেদার/ কুছ তো আকর চলে গয়ে/ কুছ জানে কো তৈয়ার’।
শিশুদের জন্যও গান আছে। সেখানে সুললিত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে, ‘তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা/ ইন্সান কি অওলাদ হ্যায় ইন্সান বনেগা’।
নয়া উদারবাদকে পথ করে নিতে হলে রফিকে আশ্রয় করতে হয়। যখন মুক্ত বাজার ঢুকছে দেশে, নয়া উদারবাদ থাবা বসাচ্ছে সেই ন’য়ের দশকের শুরুর দিন গুলোয়। তখন তার বাজারের উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয় নস্ট্যালজিয়া। ফলে জোর কদমে চলে রিমেক। টি সিরিজের ক্যাসেটে ‘রফি কি ইয়াদেঁ’ অ্যালবামে উঠে আসেন সোনু নিগম, দেবাশিস দাশগুপ্ত, বিপিন সচদেব। এছাড়া আনোয়ার, মহম্মদ আজিজ, সাবির কুমার, ভিকি মেহতা বা মঙ্গল সিংরাও ছিলেন। একের পর এক মিউজিক কোম্পানি মহম্মদ রফির গান, বিভিন্ন শিল্পীদের দিয়ে রেকর্ড করে বাজারে ছাড়েন। এমনকি দেবাশিস দাশগুপ্তকে দিয়ে টি-সিরিজ রফির হিন্দি গান বাংলায় অনুবাদ করে ‘ভার্সান সঙ’ হিসাবেও প্রকাশ করেন।
আবার নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলেও রফিকেই লাগে। তার গানেই ধরা পড়ে, ‘কাল কি দৌলত / আজ কি খুশিয়াঁ/ উনকি মেহফিল/ আপনি গলিয়াঁ/ আসলি ক্যা হ্যায় নকলি ক্যা হ্যায়/ পুছোঁ দিল সে মেরে’ বা ‘ক্যায়সে দিওয়ালি মনায়ে হম লালা/ আপনি তো বারাহ মহিনে দিওয়ালা’। কিংবা ‘জুলমোঁ আমীরোঁ কা সহকর চুপ নহিঁ রহনা হ্যায়/ পৈর সে নঙ্গে হম/ ওহ সর পর টোপী পহনা হ্যায়’।
বোম্বের ফিল্মে প্লে ব্যাক শুরু হয়েছিল প্রায় একশ বছর আগে। সারা দুনিয়ার ফিল্মের ক্ষেত্রে এটা ভারতের অবদান, যার উৎস ও প্রেরণা লুকিয়ে ছিল দেশীয় কথকথা ও যাত্রা থিয়েটারে। হিন্দি ফিল্মও প্রথম দিকে পার্শি থিয়েটারের প্রভাব (বাংলা থিয়েটারেরও) এড়াতে পারেনি। ফলে প্রবল অতিনাটকীয়তা ছিল।
দিনের পরিশ্রম শেষে শ্রমজীবী মানুষ ভিড় করতেন এইসব থিয়েটার, সিনেমায়। সেই বোম্বের শ্রমজীবীরা, যাঁরা নৌ সেনাদের সমর্থনে হাতে অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে লড়েছিলেন। ‘যাহাই জনপ্রিয় তাহাই পরিত্যাজ্য’ ফর্মুলায় বিশ্বাসী মানুষ বোম্বের ফিল্মকে পাত্তা দিতে চান না। অথচ সেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছিল বামপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মীদের রক্ত মাংস মজ্জা দিয়ে।
এখানেই মেহনতি মানুষের মনের রাজা রফি-কিশোর-হেমন্ত-মুকেশ-মান্নার গুরুত্ব। তাঁদের গানই পারে নয়া উদারবাদের উল্টো পথ দেখাতে, অন্য গানের ভোর তৈরি করতে।
‘চলি আতি কেয়ামত আঞ্জুমান মে’— একটা প্রায়-অপার্থিব কণ্ঠে এই গান যখন ভেসে আসে তখন চারপাশটাই বদলে যায়। নেহাত এই দুনিয়ায় জন্ম। নাহলে ‘প্রায়’ লিখতাম না।
গ্রিক পুরাণের সেরা গায়ক ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর বরপুত্র অর্ফিউস। তিনি যখন তার বীণা বাজিয়ে গান গাইতেন তখন সাগর, নদী, পাহাড় এবং দেব-দানব সকলেই তন্ময় হয়ে শুনতেন। তার অপূর্ব সুরের মায়ায় দেবরাজ জিউসও মুগ্ধ হতেন। অর্ফিউস যদি বাস্তবে বিশ শতকের ভারতে জন্মাতেন এবং বলিউডের সিনেমায় গান গাইতেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি হতেন মহম্মদ রফি। এমনটাই বলেছিলেন সুরকার উষা খান্না।
‘খুদারা কাশ ম্যায় দিওয়ানা হোতা’ — এই লাইনটা শুনে মনে হলো আচ্ছা গায়ক নিজে নিজের কণ্ঠের উন্মাদনা অনুভব করছেন? নাকি স্বভাবজাত বিনম্রতা তাঁকে শুধু গানই গাইয়েছে ? তারপরই মনে হলো একদিকে ভালোই হয়েছে।নিজে চিনি না হয়ে, চিনির স্বাদ গ্রহণ করেই আনন্দ।
‘অ্যায় মেরে দিল / অব খাবোঁ সে মুহ মোড় লে/ বিতি হুই সব বাতেঁ য়হী ছোড় দে’— ঠিক যেন কুয়াশাছন্ন উপত্যকা থেকে পাইনের বন ভেদ করে আসছে এক কণ্ঠ। মাদকতায় মাতিয়ে দিচ্ছে।
‘ঢলতি যায় রাত / কহলে দিল কি বাত/ শম্মা পরওয়ানে কা ন হোগা ফির সাথ’— আসলে রফি মানে অনেক কিছু। আজ যা লিখলাম কাল তা হয়তো লিখবো না। রফি নিজেই ইটারনাল। পছন্দগুলো বদলাবে। বদলে যাবে অনুভব। কখনও ‘পর্বতোঁ কে পের পড় শাম কা বসেরা হ্যায়’ কখনও আবার ‘তুমনে মুঝে দেখা’ কিংবা পরক্ষণেই হয়তো ‘ভিগা ভিগা প্যার কা সমা’। এভাবেই আবহমান কাল ধরে চলবেন তিনি। ‘বস্তি বস্তি পর্বত পর্বত’।
Comments :0