বাড়ির ঠিকানা? এলপি ২২২/৩/১০। বাড়িটি কেমন? একটি সরু লোহার দন্ডের মতো।
কারণ— এটি একটি ল্যাম্পপোস্ট।
অর্থাৎ এক ব্যক্তির বসবাস ল্যাম্পপোস্টে। অন্তত ভোটার তালিকা তাই বলছে। যাদবপুর বিধানসভার অন্তর্গত বুধেরহাট এলাকার ভোটার তালিকায় এমন ভোটদাতার নাম, ঠিকানা মিলেছে।
‘রাজ্যে একটিই পোস্ট। বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট।’ মমতা ব্যানার্জির সরকার সম্পর্কে এমন একটি কথা গ্রামে, শহরে প্রচারিত। মমতা ব্যানার্জি ছাড়া বাকি সব মন্ত্রী, আমলাদের কোনও গুরুত্ব নেই, মুখ্যমন্ত্রীর মুখে আলো ফেলা ছাড়া— প্রচারটির এমনই মানে। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই ওই মন্ত্রী, আমলাদের। শুধু মমতা ব্যানার্জির কথায় ঘাড় নাড়া ছাড়া তাঁদের কোনও দায়িত্ব নেই। তৃণমূলের এই গণতন্ত্রের ধারণা ভোটার তালিকাকেও ছুঁয়েছে। মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী থাকতে চান। তাই তাঁর দলের প্রার্থীকে জিততে হবে নির্বাচনে। আর তাই ভোটার তালিকায় হাজির হয়েছেন ‘ল্যাম্পপোস্ট’ ঠিকানা বিশিষ্ট ভোটদাতা। মমতা ব্যানার্জির পোস্টের জন্য ভোটদাতারা হয়েছেন ল্যাম্পপোস্টের বাসিন্দা।
যদি ল্যাম্পপোস্ট কারও বাড়ি হয়, তাহলে কি রোমান অ্যান্ড (&) কারও বাড়ির ঠিকানা হতে পারে না? স্বাভাবিক ব্যবস্থায় হতে পারে না। কিন্তু শাসক দল যেখানে তৃণমূল এবং বিরোধী দল যেখানে তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলা বিজেপি, তখন এমন বাড়ির ঠিকানা হতেই পারে। এবং দেখাও যাচ্ছে। যাদবপুরের ৬৫নং অংশের ভোটার তালিকায় দেখা যাচ্ছে এক মহিলা ভোটদাতার বাড়ির নং ‘&’। একজনেরই এমন? না। এমন আরও আছে। কারও কারও আবার বাড়ির ঠিকানা ‘এন ০০০৬&। এমন নম্বরের বাড়ি কলকাতা সহ রাজ্যের কোথাও নেই। কিন্তু ভোটার তালিকা বলছে আছে।
জাল ভোট দেওয়ার হরেক কৌশল আছে তৃণমূলের। টাকা, জমি, বালি, কয়লা, চাকরি চুরির মতো ভোট চুরিরও ব্যবস্থা করেছেন তৃণমূলের নেতারা। যেমন, ওই যাদবপুরের ওই বুধেরহাট তথা ১৩৪নং অংশে এক ভোটদাতার বাড়ির ঠিকানা ‘জিরো জিরো জিরো।’ আর একজনের ঠিকানা ‘জিরো জিরো জিরো জিরো।’ আর একজনের ঠিকানা ‘এনওও।’ এমনই ‘এনওও’ ঠিকানার মানুষ একজন নয়। আরও আছেন। ভোটার তালিকা বলছে মোহন দাস এবং সীমা দাস, দু’জনেরই বাড়ির ঠিকানা ‘এনওও।’ দু’জনেরই বয়স ৪৪। কিন্তু দু’জনে আত্মীয় নন।
এলাকার কাউন্সিলর অনন্যা ব্যানার্জি রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের গোষ্ঠীর বিশ্বস্ত সৈনিক। দলের গোষ্ঠী বিন্যাসে অরূপ-অনন্যার বিরোধী এক তৃণমূল নেতা জানিয়েছেন,‘‘এলাকার ভোটার তালিকা খুঁটিয়ে দেখলে এমন অনেক কিছুই দেখতে পাবেন, যা অবিশ্বাস্য। দেখবেন মহাবীর মুখার্জি নামে এক ভোটদাতার নাম আছে। তাঁর নামের পাশে বয়স, ভোটার কার্ড নম্বর, তাঁর বাবার নাম পাবেন। কিন্তু ঠিকানার জায়গা ফাঁকা। কখনও দেখেছেন ভোটার তালিকায় ঠিকানাহীন ভোটদাতা? হঠাৎ দেখবেন একজন ভোটদাতার ঠিকানা লেখা হয়েছে বুধেরহাট। বুধেরহাট এক বিরাট এলাকা। সেই এলাকার কোন বাড়িতে, কোন পাড়ায়, কোন গলিতে তিনি থাকেন? বুঝবেন কী করে? বোঝার উপায় নেই।’’ সেই তৃণমূল নেতা বারবার অনুরোধ করেছেন কোনও ভাবেই তাঁর নাম উল্লেখ না করতে।
চমকে ওঠার মতো কত কিছুই তৃণমূল করেছে ভোটার তালিকায়। ১৩৩ নং অংশের ১৭৪ থেকে ১৮০ নম্বর পর্যন্ত পরপর সাতজন ভোটদাতার বাড়ির ঠিকানা ‘জিরো জিরো।’ আবার এমন একজনকে পাওয়া যাচ্ছে, ৩৯ বছরের যে মহিলার বাড়ির ঠিকানা ‘এনএ।’ অর্থাৎ ‘জানা নেই।’
তবে শুধু ১০৯নং এলাকাতেই নয়, অন্য ওয়ার্ড এলাকাতেও ভোটার তালিকায় চমকের পর চমক। যেমন ১০৪ নং ওয়ার্ড এলাকা। কারও ঠিকানা ‘এনওডি’, অর্থাৎ ‘নড’ হতে পারে? ইংরাজি ‘নড’-র বাংলা প্রতিশব্দ ‘ঘাড় নাড়া।’ যাদবপুরের ১০৪নং ওয়ার্ড এলাকায় ‘ঘাড় নাড়া’ কিংবা ‘নড’ বাড়ির নম্বর আছে। তৃণমূলের দেদার ভুয়ো নাম ঢোকানো ভোটার তালিকা তাই বলছে। সেই ওয়ার্ড এলাকার ১৪০নং অংশ বলছে সেই এলাকায় আঙুরবালা হালদারের ছেলে হিসাবে নাম নথীভুক্ত হওয়া মৃত্যুঞ্জয় হালদারের বাড়ির নম্বর ‘নড’। তাঁর পরেই যাঁর নাম, সেই তরুণীর বাড়ির ঠিকানা আবার ‘এনওও।’ সিপিআই(এম) নেতা ধ্রুব দাসের বক্তব্য,‘‘ভোটার তালিকা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন পার্টিকর্মীরা। আমরা এমন অনেককাণ্ড পেয়েছি। আমরা চাই ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা। পার্টি বলেছে এসআইআর প্রক্রিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়তে। পাশাপাশি ভুয়ো, মৃত ভোটদাতাদের নাম আমরা চিহ্নিত করছি। সেই কাজ চলছে। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছি। আরও জানাবো।’’
আগামী নভেম্বরে রাজ্যে বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন(এসআইআর)-এর প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। বামফ্রন্ট ইতিমধ্যেই এক বিবৃতিতে এসআইআর-এর নামে কোনও প্রকৃত ভোটারের নাম যাতে ভোটার তালিকা থেকে বাদ না যায় তার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতা নিয়ে সব জেলায় প্রতিটি বিধানসভা এলাকায় বামপন্থী কর্মীদের নামতে নির্দেশ দিয়েছে বামফ্রন্ট। সম্প্রতি রাজ্য বামফ্রন্টের সভায় আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী ২৯অক্টোবর কলকাতায় গণজমায়েত করে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে বামপন্থী দলগুলির পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে বামফ্রন্ট এবং সিপিআই(এম)’র স্পষ্ট অবস্থান, ভোটার তালিকায় থাকা ভুয়ো, মৃত ভোটদাতাদের নামও বাদ দিতে হবে। পার্টির বিভিন্ন জেলা কমিটির পক্ষ থেকে অনেক ভুয়ো, মৃত ভোটদাতাদের তালিকা সহ অভিযোগ পত্র নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিজেপি এমন কোনও উদ্যোগ নেয়নি। তারা শুধু চিৎকার করছে সংবাদমাধ্যমের সামনে। ভুয়ো, মৃত, জাল ভোটারদের নাম চিহ্নিত করার মতো সাংগঠনিক ক্ষমতা রাজ্যে বিজেপি’র নেই। তৃণমূলের ভোট জোচ্চুরির রোখার কোনও ইচ্ছা আদৌ আছে কিনা, তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
Jadavpur Voter list
কারও বাড়ি ল্যাম্পপোস্টে, কারও ঠিকানা এন ০০০৬&!

×
Comments :0