Netaji

নেতাজী-সন্ধানের হাল জানাচ্ছে পুলিশের মিউজিয়াম

ফিচার পাতা

অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়

শুধু কি ২৩ জানুয়ারিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে আমাদের নেতাজী-সন্ধান? 
ক্যালকাটা পুলিশ মিউজিয়াম অনেকটা তাই বলছে।
প্রতিবছরের মতো এবারও সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে রাজ্যে নানা অনুষ্ঠান হবে। সরকারি, বেসরকারি না উদ্যোগে রক্তদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এমনকি যারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে প্রধান স্বাধীনতা সংগ্রাম মনে করে না, যাদের সংগঠনের কেউ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশই নেয়নি, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ(আরএসএস)-ও নেতাজীর জন্মদিনে বিশেষ কুচকাওয়াজের পরিকল্পনা করেছে। সেই সাম্প্রদায়িক আরএসএস-কে ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ বলে অনেকদিন আগেই সার্টিফিকেট দিয়ে বসে আছেন মমতা ব্যানার্জি। সঙ্ঘের সেই অনুরাগিণী মুখ্যমন্ত্রীও নেতাজীর জন্মদিনে সরকারের নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন।


কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন সম্পর্কে আগ্রহ কী সমাজে গড়ে তোলা যাচ্ছে? কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার মিলিয়ে ১৬৪টি নেতাজী সংক্রান্ত ফাইল প্রকাশ করেছে। কিন্তু তারপর? মানুষকে, বিশেষত নতুন প্রজন্মকে কী উৎসাহিত করা গেল? নাকি পুরোটাই কে কত ‘নেতাজী-অন্ত প্রাণ’ তার প্রতিযোগিতা? মানিকতলা সংলগ্ন ‘ক্যালকাটা পুলিশ মিউজিয়াম’ কী বলছে? 
নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ সংক্রান্ত প্রামাণ্য নথি সকলের দেখার জন্য উন্মুক্ত। অথচ প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ জন ওই মিউজিয়ামে গেলেও ওই নথিগুলি দেখার উৎসাহী পাওয়া যায় না। জনা কয়েক গবেষক তাও পিএইচডি’র স্বার্থে মিউজিয়ামের দোতলার সেই মহাফেজখানায় পা রাখেন। ২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকারের তরফে নেতাজী সংক্রান্ত ৬৪টি গোপন ফাইল প্রকাশ করা হয়। সাধারণের দেখার জন্যই সেসব পুলিশ ফাইল কলকাতা পুলিশের এই মিউজিয়ামে যত্ন সহকারে রাখা হয়েছে। মিউজিয়ামের দোতলায় আসল ফাইলগুলোকে কাঁচ বন্দি করার পাশাপাশি কম্পিউটারে তা দেখার জন্য রয়েছে সুন্দর ব্যবস্থা। আসল ফাইলগুলোকে স্ক্যান করে তা পিডিএফ আকারে সংরক্ষিত করা রয়েছে।
গবেষকদের তো বটেই যেকোনও উৎসাহী সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সেখানে বসে পড়াশুনা বা গবেষণা  করতে পারেন। কোনও রেস্তই গুনতে হবে না। বিশ্বযুদ্ধে কলকাতায় পড়া জাপানি নেপাম বোমার খোল কিংবা গোলাগুলি দেখতে পুলিশ মিউজিয়ামে দর্শকরা যতটা উৎসাহ দেখান, নেতাজী নিয়ে সেরকম দেখা যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মিউজিয়াম কর্মীর মতে, ‘‘হাতেগোনা দু একজন শুধুই ওই ফাইল দেখতে আসেন। হয়ত জেনারেশন গ্যাপে পড়ে গেছেন নেতাজী।’’ কাজের দিনে নেতাজী নথি দেখার ঘরে ঢুকলে দুই কিংবা তিন জনকে মিউজিয়ামের দোতলায় গবেষণা করতে দেখা যায়। বিদেশী দর্শক ছাড়া সাধারণ মানুষরা কখনই ওই পথে যান না। পরিস্থিতি এমনটা দেখে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ নেতাজীর সব ফাইলের পিডিএফ ‘ডিভিডি’ আকারে প্রকাশ করেছে। মাত্র ৩০০ টাকার বিনিময়ে তা কেনার সুযোগ থাকলেও এখানেও উৎসাহের বেশ অভাব।
ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই মিউজিয়ামে থাকা ১৯০৮ থেকে ১৯৩০ সালের সব প্রদর্শনী আলিপুর মিউজিয়ামে নিয়ে যেতে হবে। আলিপুর সংশোধনাগার বন্ধ করে সেখানে আলাদা করে মিউজিয়াম তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন কিছু কিছু করে মানিকতলার থেকে আলিপুরে যাচ্ছে। জলুস অনেকটাই হারাবে ২৭ বছরের এই কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম।


কমপক্ষে ১২ হাজার পৃষ্ঠার ওই ফাইলে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দাদের সংগ্রহ করা অনেক তথ্য রয়েছে। সব নথিই স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত ভারতের। তবে ৬৪টি ফাইলে কোনটিতে নেতাজী’র অন্তর্ধান নিয়ে কোন তথ্য নেই। স্বাধীন ভারতের পুলিশ লাগাতার যে বসু পরিবারের ওপর  নজরদারি চালিয়েছে তা প্রমাণ রয়েছে নথিতে।
বসু পরিবার ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের মধ্যে আদান প্রদান হওয়া সব গোপন চিঠিই সেন্সর করার নামে গোপনে খুলে পড়া হতো। আর তা নিয়ে নিয়মিত নোট করে সে সময় সরকারকে চালান করত পুলিশ। বাদ পড়ত না বিদেশ থেকে কোনও ব্যক্তিগত চিঠিও। নেতাজী সংক্রান্ত আট নম্বর ফাইলে রাষ্ট্রের নজরদারি কতটা কঠিন হতে পারে তা প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে মিসেস এনসি ভেটারের লেখা চিঠি থেকে শুরু করে নেতাজীর ভাইপো অমিয় নাথ বসু’র কাছে আসা সব চিঠি খুলে পড়া হতো স্বাধীন ভারতে। পার্ক স্ট্রিট সংলগ্ন প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের সিকিউরিটি কন্ট্রোল অফিস এবং লর্ড সিনহা রোডের রাজ্য সরকারের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ লাগাতার সেকাজ করে গেছে। নেতাজীর ভাইপো অমিয় নাথ বসু’র ওপর নজরদারি সংক্রান্ত তিন তিনটে গোপন ফাইল ছিল। 
কলকাতায় গৃহবন্দি অবস্থা থেকে ১৯৪১ সালে নেতাজীর অন্তর্ধান হয়ে যাওয়াটা কিছুতে মানতে পারেনি ব্রিটিশ পরিচালিত সে সময়ের কলকাতা পুলিশ। আধুনা বাংলাদেশ, তৎকালীন বরিশাল সিআইডি থেকে কলকাতায় লাগাতার তথ্য চালাচালির নজির রয়েছে।  
হাওড়া সিআইডি’র একটি ফাইল অনুযায়ী, চল্লিশের দশকের শেষ দিকে নেতাজীকে রাশিয়া এবং চীনে দেখা গেছে। মার্কিন এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, তিনি নতুন একটি সেনাবাহিনী নিয়ে দেশে ঢুকতে চেয়েছিলেন। সুখিয়া স্ট্রিট সংলগ্ন পুলিশ মিউজিয়ামে প্রকাশিত নেতাজী ফাইলস্‌-এ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত পাক্কা দশ বছরের নথি রয়েছে। ১৯২২ সালের একটি ফাইলও রয়েছে। ফাইলে ছেঁড়া-ফাটা-ভালো মিলিয়ে মোট ১২ হাজার ৭৪৪ পাতা রয়েছে। নথিগুলোকে নির্দিষ্ট ক্রমে বিন্যস্ত করে ডিজিটাল রূপ দেওয়া হয়েছে।


রাজ্য সরকারের তরফে এই পুলিশ ফাইল প্রকাশের পরের বছর  ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত ১০০টি গোপন ফাইল প্রকাশ্যে আনে মোদী সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার ওই ১০০টি ফাইলের ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশ করে। কেন্দ্র সরকারের প্রকাশিত একটি ফাইল থেকে জানা যায়, জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে নেতাজী’র কন্যা অনিতা পাফ’কে এআইসিসি পেনশন দেওয়া শুরু করেছিল। বছরে ৬০০০ টাকা করে পেনশন দেওয়া হতো। স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার হিসাবেও অনিতা পেতেন ওই পেনশন। তবে ১৯৬৫ সালে নেতাজী’র কন্যার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সেই পেনশন বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে ওই পেনশন নেতাজী’র স্ত্রীকেই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু তিনি পেনশন নিতে অস্বীকার করায় মেয়ে অনিতার নামে পেনশন দেওয়া শুরু হয়।
কেন্দ্র-রাজ্যের প্রকাশিত ১৬৪ ফাইলে অনেক অজানা বিষয় থাকলেও কোনটাতেই  নেতাজী’র অন্তর্ধান নিয়ে কোন বিশেষ বক্তব্য নেই। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দি থাকাকালীন নেতাজীর অন্তর্ধান সংক্রান্ত একটাও পুলিশ রিপোর্ট প্রকাশিত ফাইলে নেই।
১৯৪০ সালে ৩ জুলাই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে সত্যাগ্রহ করার আগে, ২ জুলাই ঢাকা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নেতাজীকে গ্রেপ্তার করা যায়, তখন কলকাতা থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার কোনও সূত্র তৎকালীন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের কাছে থাকবে না তা হতে পারে না। নেতাজী চলে যাওয়া পর কলকাতায় একনাগাড়ে চলতে থাকা খানা-তল্লাশি থেকে কয়েকজনকে জেরা-জিজ্ঞাসাবাদের রিপোর্ট পড়ে আছে সিক্রেট ফাইলে। কিন্তু অন্তর্ধান সংক্রান্ত কোনও নথি নেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment