পার্থপ্রতিম নাগ 
 
আশঙ্কা যা ছিল এখন তাই ক্রমে প্রকাশ পাচ্ছে। মোদী-অমিত শাহের ফতোয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্রীয় সরকারি নানা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, নগর-বন্দর তার ঐতিহ্যের পরিচয় হারাচ্ছে। নতুন করে নামকরণের নামে মুছে ফেলা হচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এদেশের সমন্বয়ের যে সংস্কৃতি, বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে পরিকল্পনামাফিক। ‘বিকাশ’ এর নাম করে ধ্বংস করা হচ্ছে দেশের সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্টগুলি। এই ব্যাপারে কোনও প্রকার বিরোধিতাই নেই আমাদের রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারেরও। আসলে এই রাজ্য সরকারের ‘উন্নয়ণ’ আর কেন্দ্রের ‘বিকাশ’ এই দুটি শব্দই হলো নিরেট ধাপ্পাবাজি ও বিদ্রুপাত্মক। তাই বদলাচ্ছে যেখানে যা তার সবটাই নেতিবাচক। জনগণের কল্যাণের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই। চলছে দেদার লুটতরাজ আর দখলদারি। একজনের অপকর্মকে অপরজন সমর্থন করছে। বিরোধিতা যা তার সবটাই দেখনদারি।
কলকাতায় আলিপুর এলাকায় বেলভেডিয়া রোড তথা আলিপুর এলাকায় ৩০একর জমির ওপর গড়ে ওঠা দেশের জাতীয় গ্রন্থাগারের ওপর আগ্রাসনের কার্যকলাপ তার একটি প্রমাণ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই গ্রন্থাগারে সংবিধানের বৈশিষ্ট বজায় রেখে ২০০৪সালের ৮অক্টোবর গড়ে ওঠে ভাষা ভবন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি ভবনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দেশিয় বিভিন্ন ভাষা সহ দুনিয়ার নানান দেশের ভাষার সাহিত্যও সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদানের সঙ্গম স্থল হিসাবেই লক্ষ্য ছিল এর ব্যপ্তি ঘটানো। তার আয়োজনও ছিল এবং কাজও হচ্ছিল নিয়মিত। ২০১৪সালে কেন্দ্রে মোদী ও শাহের গেরুয়া সরকার আসীন হতেই বদলাতে থাকে ছবিটা। যেহেতু এটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সেহেতু এখানে মূল প্রশাসক বা অধিকর্তা হিসাবে একজন আরএসএসপন্থী অধ্যাপককে উত্তর প্রদেশ থেকে উড়িয়ে আনা হয় এবং আসীন করা হয় ওই পদে। তিনি আসার পর থেকেই কলকাতা জাতীয় গ্রন্থাগার ক্রমেই হয়ে ওঠে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি ও তার জোট সঙ্গী হিন্দুত্ববাদীদের আখড়া। গত বছর ৫ জুলাই এই অধিকর্তা তাঁর পছন্দের কয়েকজন আধিকারিককে পাশে রেখে বাতাসে একটা কথা ছেড়ে দেন; তাহলো ভাষা ভবনের নতুন নাম হবে ‘ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ভাষা ভবন’ এই নামে। পরের দিন ৬ জুলাই গ্রন্থাগারের নিজস্ব ওয়েবসাইটে তা জানান দেওয়া হয়। যদিও পরে তা আবার সরিয়েও দেওয়া হয়, যাতে তা সাধারণ কারোর নজরে না আসে। একই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ভাষা ভবনের নাম বদলের অনুমোদন আদায় করে নিয়ে তাও পরে ওয়েবসাইট থেকে মুছে ফেলা হয় একই উদ্দেশ্যে। এভাবেই এখন এখানে প্রায় প্রতিদিনই এদের কোনও না কোনও দলীয় সভা লেগেই রয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক মানের পাঠক অতিথিশালা এখন কেন্দ্রের এই মোদী শাহের সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ সহ নানান মাপের নেতা-নেত্রীদের বিশ্রামালয় হয়ে উঠেছে। খরচ জুটছে সরকারি অর্থে। এসবের সবটাই জানেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। অথচ তিনি  চুপ। নেই কোনও বাদানুবাদ। কেন? এইটাই হলো এখনকার কেন্দ্র ও এই রাজ্যের সরকার তথা শাসক দলের মধ্যে বোঝাপড়া। যার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। অথচ গ্রন্থাগার নিয়ে পাঠকদের আগ্রহ কতনা পরবর্তী সময়ে আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে মাসে ১০হাজারেরও বেশি পাঠক প্রতিদিন গ্রন্থাগারে এসে বসে পঠন-পাঠন করছেন। সংগ্রহ করছেন ই-পুস্তক ও নানান প্রকাশনা। পাঠকদের পক্ষে  নতুন নতুন বই আনার প্রস্তাবগুলি ঠেলে সরিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। রাজ্য তথা দেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রকাশনাগুলি তাদের নতুন প্রকাশনা গ্রন্থাগারে জমা  দেবার আইন থাকলেও তা রক্ষিত নয়। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে কোনও উদ্যোগই নিচ্ছে না। দেশের জাতীয় গ্রন্থাগারের সঙ্গে বিশ্বের যে ৭৫টি দেশের বই আদান-প্রদানের চুক্তি এখনও রয়েছে তা কার্যকর নেই। এর অন্যতম কারণ, আগে জাতীয় গ্রন্থাগারে বিদেশি বিভিন্ন ভাষা-সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ পদগুলি শূন্য। বিদেশ থেকে বই এলেও তার পাঠোদ্ধার করার উপযুক্ত কেউ নেই।
এই নিয়ে প্রতিবাদ এবং সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছে একমাত্র একটি কর্মচারী সংগঠন। এই গ্রন্থাগারের কর্মচারীদের মধ্যে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলীদের সংগঠন ছাড়াও আছে সদ্য গজিয়ে ওঠা বিজেপি অনুমোদিত একটি সংগঠন। তাদের প্রত্যেকের মুখেই কুলুপ। প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে একমাত্র প্রগতিশীল বামপন্থী ও সর্ববৃহৎ সংগঠন ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন’। আর এই কারণেই এই সংগঠনের ওপর শুরু হয়ে গেছে ছক করা আক্রমণ। সংগঠনের নেতৃত্বের একধিক পদাধিকারী  জনকে জাতীয় গ্রন্থাগারের মূল ক্যাম্পাস থেকে অন্যত্র সরানো হয়েছে। তাঁকে রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের কাজে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন এর প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং প্রতিকারও চেয়েছে। উল্লেখ্য, এই অ্যাসোসিয়েশনের পঁচাত্তর বছর পূর্তি হলো গত বছর। সংগঠনের সেই ইতিহাসকে সামনে রেখে সংগঠনের পক্ষে প্রকাশিত হয়েছে একটি মূল্যবান স্মারক গ্রন্থ। বহু বিদগ্ধ ব্যক্তির লেখা নিবন্ধ সেই স্মারকে স্থান পেয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনের স্পষ্ট বক্তব্য, ওই ঐতিহ্যশীল জাতীয় গ্রন্থাগারের সম্ভ্রম ও সুখ্যাতি বাঁচিয়ে রাখতে তাদের প্রতিবাদ ও কার্যকর প্রতিরোধ আন্দোলন চলবে। চলতি বছর আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বিজেপি জোট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে জাতীয় গ্রন্থাগারের পরিকাঠামো ব্যবহার করতে চাইলে প্রতিবাদ জানাবেন কর্মীরা।
উল্লেখ্য, এই প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য জাতীয় গ্রন্থাগার নির্মাণের গোড়ার কথায় ফিরে যেতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশের কাছে গর্ব আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক এই জাতীয় গ্রন্থাগার কলকাতায় আলিপুর এলাকায় ৩০একর জমির ওপর বিপুল জ্ঞান ভান্ডার নিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিলে একে বর্ণিত করা হয়েছে অন্যতম জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে। দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বেলভেডিয়ার হাউসে ১৯৫২সালে ১ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবেই এই প্রতিষ্ঠানের পথ চলার সূচনা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন দেশে তো বটেই সারা দুনিয়ায় এই গ্রন্থাগার তার যোগ্য মর্যাদা আদায় করতে পারবে। বাস্তবে তা হয়েও ছিল। জওহরলাল নেহরুর আমল থেকে রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বে এই গ্রন্থাগারের গ্রহণযোগ্যতা এবং দুনিয়ার ৭২টি দেশের মধ্যে বইয়ের মাধ্যমে চিন্তা ভাবনার পারস্পরিক আদান প্রদান বেড়েছিল। মাঝখানে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬সালটা ছিল অস্বস্তিকর। কারণ, তখন প্রশাসনিকভাবে একটা চেষ্টা চলে জাতীয় গ্রন্থাগারকে স্বশাসিত সংস্থা করার। যদিও গ্রন্থাগারের গরিষ্ঠ অংশের কর্মী, পাঠক, বিশিষ্টজন, শিক্ষক-ছাত্ররা সেই উদ্দেশ্যে বাধা দেন। কেন্দ্রীয় প্রশাসন তখন সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। এরপর ২০০৬সালে বিশ্বায়নের প্রভাবে এই গ্রন্থাগারের কর্মী সংখ্যা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে শুরু করে। যা এখনও বজায় আছে। এর জন্যেই দেখা যায় গ্রন্থাগারের মোট ৫৩৯ জন কর্মীর মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ শূন্য। এই বছরটা লোকসভা নির্বাচন থাকায় এই শূন্য পদের মধ্যে ১০০জন নিযুক্ত হয়েছে। আর একটা অংশ আছে যাঁরা বার্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে ২০থেকে ২৫হাজার টাকায় কাজ করছেন মাত্র এক বছরের জন্য। বাড়েনি গ্রন্থাগারের সম্পদ, কর্মী সংখ্যা ও ব্যবহারকারী।
উদ্বেগ এখানেই। কারণ কেন্দ্রে আসীন বর্তমান সরকার জাতীয় গ্রন্থাগারের অবমূল্যায়ন করতে দ্রুত ধাবমান। গ্রন্থাগারের মধ্যে পাঠযোগ্য পরিবেশের পরিবর্তে রাজনৈতিক কার্যকলাপ বাড়ার প্রশ্রয় দিচ্ছে কেন্দ্রের সরকারের পছন্দের প্রশাসক ও একাংশের কর্মী। ক্যাম্পাস জুড়ে যত্রতত্র দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসক দলের নেতা নেত্রীদের ছবির কাটআউট। এটাই রাজনৈতিক প্রলেপ। যা সম্পূর্ণটাই পরিকল্পনামাফিক। এই নিয়ে প্রতিবাদ, আপত্তি এখন প্রতিদিনের। জাতীয় গ্রন্থাগারকে নিয়ে এখনও গর্ব অনুভব করেন এমন সাধারণ মানুষের প্রশ্ন জাতীয় গ্রন্থাগার গড়ে তোলা ও তার ক্রম-শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবদান না থাকলেও কেন এই উদ্যোগ? এর বিহিত হতেই হবে। ফিরিয়ে আনা হোক হারানো সমৃদ্ধি। জাতীয় গ্রন্থাগারে আসুক দেশ-বিদেশের নতুন নতুন বইয়ের সংগ্রহ। এর জন্য বিজেপিওয়ালারা নয় রাজ্য সহ সারা দেশের বিদগ্ধদের নিয়ে গড়ে তোলা হোক একটি গ্রন্থ নির্বাচন সমিতি। তাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হোক গ্রন্থাগারকে নতুন সম্পদে ভরিয়ে তোলার বিষয়টি। আন্তর্জাতিক মানের আলোচনা যেমন চলত অতীতে তা আবার শুরু হোক। দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রকাশক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে তাদের নতুন প্রকাশিত বই আনা হোক গ্রন্থাগারে। পারস্পরিক প্রতিনিধিত্ব হোক বিশ্বের আঙিনায়। 
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0