ডগলাস দ্য সিলভা
ফুটবলের মহারণ। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ব্রাজিলের পতাকা নিয়ে কলকাতার রাস্তায় মিছিল দেখেছি। আর্জেন্টিনার পতাকা, বিশাল কাট আউট। মহানগরীর দেওয়ালে ফুটে উঠতে দেখেছি বিশ্ব ফুটবলকে। কেরালায় শুনলাম এবার মেসি-নেইমারের বিশাল কাটআউট লাগানো হয়েছে। কেউ ব্রাজিল, কেউ আর্জেন্টিনা। কেউ বা আবার ফ্রান্স। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চে কবে উড়বে ভারতের পতাকা? মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
                        
                        
কলকাতার খেলার সময় থেকেই এই প্রশ্ন শুনে আসছি। এখন আমি ব্রাজিলে। কিন্তু এতবছর পরে কলকাতা থেকে আবার এরকম একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। আসলে বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই কলকাতার ফুটবলপ্রেমীদের মনে একটা দুঃখ হয়, তা থেকে মনের মধ্যে এই প্রশ্ন উঁকি দেয়।
দুঃখ লাগে ভারতের ফুটবল নিয়ে কথা বলতে গেলে। সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। কিন্তু অঙ্কুরে বিনাশ ঘটেছে অচিরেই। ভারতীয় ফুটবল কর্তাদের মিশন ও ভিশন নিয়ে কোনও ধ্যানধারণা আছে বলে আমার মনে হয় না। এমনকি কর্তারা ফুটবলটা বোঝেন এমনও নয়, বছরের পর বছর গদি আঁকড়ে বসে থাকার নাম যদি ফুটবলের উন্নতি হয়, তাহলে বলার কিছু নেই। ভারতে যারা ফুটবল চালায় তাদের ৭০% ফুটবল জানে না। যারা জানেন তাঁরা সুযোগ পায় না।
ভারতীয় ফুটবল এখনও কর্পোরেটের দখলে থাকা ক্লাব সর্বস্ব। যা দিয়ে কিস্যু হবে না। শুনতে পাচ্ছি, কলকাতা ফুটবল মৃতপ্রায়। যত লড়াই দুই ক্লাব ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানকে ঘিরে ছিল। সেটাও শেষের পথে। বিশাল এই উন্মাদনা ভারতীয় ফুটবল টিমকে নিয়ে নেই। কিছু বিদেশি কোচ আসে আর যায়, তাঁদের পরিকল্পনার কথা মনে দিয়ে শোনাও হয় না। কার্যকরী করা দূরের কথা। 
                        
                        
এখনও তো ইন্ডিয়ান সুপার লিগ নিয়ে চুড়ান্ত মাতামাতি। গুড ফর নাথিং। আমার মনে হয়, আইএসএল আরও ক্ষতি করে দিচ্ছে ভারতীয় ফুটবলকে। ব্রাজিলে বসেই শুনতে পাই, ৪০ বছর বয়সি ফুটবলারদের মিলিয়ন ডলার দিয়ে আনা হচ্ছে। ফুটবলের স্বার্থে না কর্পোরেটের? যে ক্লাব কর্তারা আনছেন, ক্লাব চালাচ্ছেন, তাঁদের বিন্দুমাত্র ধারণা থাকলে ৪০ বছরের ফুটবলারকে আনতেন না। যে পরিমাণ অর্থ প্রথম চারটে আইএসএলে খরচ করেছে, তা দিয়ে বিভিন্ন ক্লাবে নার্সারি কোচিং ক্যাম্প করা যেত। পরিকাঠামোর অনেক উন্নতি করা যেত যা সব থেকে বেশি জরুরি। সেই টাকায় বিদেশি কোচ এনে বিদেশি ফুটবলের পরিকল্পনা নিয়ে চললে আখেরে লাভই হতো ভারতীয় ফুটবলের। সিনিয়র লেভেল নয় ভাবতে হবে জুনিয়র লেভেল থেকে। 
                        
                        
ভারতে বিদেশি কোচ আনা হয় শুধু ক্লাব ফুটবলে, কর্তাদের পিঠ বাঁচাতে। খারাপ রেজাল্ট করলেই তাড়িয়ে দেওয়া হয় বিদেশি কোচদের। ভালোমানের বিদেশি কোচদের সঙ্গে দেশের কোচদের কাজ দিতে হবে, শিখতে হবে তাঁদের। বিদেশিরা কি আমাদের থেকে বেশি জানে? কলকাতার কোচদের মুখে এ প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এখন নাকি, বিদেশি কোচদের সঙ্গে ভারতীয় কোচদের তালমিল ঘটানোর কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এতদিন যা হয়নি, নার্সারি কোচিং। অনেক বলতে পারেন, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অ্যাকাডেমি হয়েছে। সেখানে বিদেশি কোচরা কাজ করছেন। হয়তো করছেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরিকল্পনার অভাব প্রতিপদে। কলকাতার খেলার সময়, কিছুটা কোচিং করানোর সময় অনেক প্ল্যানিংয়ের কথা বলেছিলাম। টাকার অভাব দেখিয়ে সেই সব পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছেন কর্তারা। দেশের ক্লাবগুলো চটজলদি রেজাল্ট চায়। বাংলার ভালো ফুটবলার নেই, তাহলে ভিন্ন রাজ্যে গিয়ে দেখো। সেখানে না পেলে বিদেশি নিয়ে এসো, তাহলেই চলবে-এ রকমই একটা পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় ক্লাবগুলো টিম তৈরি করে। 
জোর দিয়ে বলছি, এভাবে চলবে না। খেয়াল রাখতে হবে ভারতীয় ফুটবলাররা শারীরিক সক্ষমতায় পিছিয়ে অনেকটাই। শুরু করতে হবে আট বছর বয়স থেকে। চালু করতে হবে বেবি লিগ, ফিজিক্যাল ট্রেনিং। ছোট থেকে শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতে হয়েছে, মাত্র একবার। তারপরে আর হয়নি বেবি লিগ। ব্রাজিলে কেউ এলে দেখতে পাবেন, কীভাবে এখানে বেবি লিগ করা হয়। বাচ্চাদের অ্যাকাডেমিতে রেখে ফুটবলের শিক্ষার পাশাপাশি পড়াশোনাও শেখানো হয়। এই লেখা পড়লে অনেকেই বলতে পারেন, ভারতে এরকম অ্যাকাডেমি প্রচুর আছে। কিন্তু সেখানে দিশা নেই কোনও। এ ভাবে করলে শুধু স্বপ্ন দেখেই যেতে হবে ভারতকে।
                        
                        
জিকো জাপান খেলতে যাওয়ার পর সে দেশের ফুটবলকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছিল। ব্রাজিল থেকে ফুটবলার গিয়েছিলেন। তাদের জাপান নাগরিকত্ব দিয়েছিল। বিশ্বকাপেও খেলেছিল সেই সব বিদেশিরা। কিন্তু ভারতে নাগরিকত্ব আইন একেবারে অন্যরকম। খেলার ক্ষেত্রে এই নাগরিকত্ব ব্যাপারটা কিছুটা ছাড় দিলে আখেরে লাভ ভারতীয় ফুটবলের। চিমা থেকে শুরু করে হোসে রামিরেজ ব্যারেটো সহ অনেককেই নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত ছিল। এতদিন সে দেশের থাকার পরেও কোনও বিদেশি দক্ষ খেলোয়াড়দের স্বীকৃতি নেই। খারাপ লাগে দেশটার সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পরেও শুনতে হয় ‘বিদেশি’ বলে। ফুটবলের উন্নতিতে ফেডারেশনের উচিত সরকারকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা।
এতসব বলার পরেও জোর গলায় বলতে পারছি না, ভারত ঠিক কবে ফুটবল বিশ্বকাপে পা রাখবে। ব্রাজিলে বসে নিজেও মাঝে মাঝে ভাবি, ভারতের ফুটবল নিয়ে। সম্ভাবনা প্রচুর ছিল। ১৩০ কোটির দেশ থেকে ১১জন বিশ্বমানের ফুটবলার বেরোবে না! অনেকের মতো, এটা আমিও বিশ্বাস করি না। পরিকল্পনা থাকলে অবশ্যই তা সম্ভব।
(সাক্ষাৎকার ভিত্তিতে লেখা এই প্রতিবেদন)
 
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0